সারেঙ বললে, ‘কী বেহদ তকলীফে জানিপানি হয়ে যে কুলুম শহরে পৌঁছলাম-’
আমি শুধুলাম, ‘সে আবার কোথায়?’
বললে, ‘বাংলায় যারে লঙ্কা কয়।’
আমি বললুম, ‘ও, কলম্বো!’
‘জী। আমাদের উচ্চারণ তো আপনাদের মত ঠিক হয় না। আমরা বলি কুলুম শহর। সেখানে ডাঙায় বেড়াবার জন্য আমাদের নামতে দিল বটে, কিন্তু যারা পয়লা বার জাহাজে বেরিয়েছে, তাদের উপর কড়া নজর রাখা হয়, পাছে জাহাজের অসহ্য কষ্ট এড়াবার জন্যে পালিয়ে যায়। সমীরুদী বন্দরে নামলেই না। বললে, নামলেই তো বাজে খরচা। আর সেকথা ঠিকও বটে, হুজুর, খালাসীরা কাঁচা পয়সা বন্দরে যা ওড়ায়! যে জীবনে কখনও পাঁচ টাকার নোট দেখে নি, আধুলির বেশি কামায় নি, তার হাতে পনের টাকা। সে তখন ক্যাগের বাচচা কেনে।
‘আমরা পেট ভরে যা খুশি তাই খেলাম। বিশেষ করে শাক-সবজি। জাহাজে খালাসীদের কপালে ও জিনিস কম। নেই বললেও হয়-দেশে যার ছড়াছড়ি।
‘তারপর কুলুম থেকে আদন বন্দর।’
আমার আর ইংরিজি ‘এইডন’ বলার দরকার হল না।
‘তারপর লাল-দরিয়া পেরিয়ে সুসোর খাড়ি—দু দিকে ধু-ধু মরুভূমি, বালু আর বালু, মাঝখানে ছোট্ট খাল।’
বুঝলুম, সুসোর খাড়ি’ মানে সুয়েজ কানাল।
‘তারপর পুসঁই। সেখানে খালের শেষ। বাড়িয়া বন্দর। আমরা শাকসবজি খেতে নামলাম সেখানে। ঝানুরা গেল খারাপ জায়গায়।’
পোর্ট সাঈদের গণিকালয় যে বিশ্ববিখ্যাত, দেখলুম, সারেঙের পো সে খপরটি রাখে। পুর্সই থেকে মার্সই, মার্সই থেকে হামবুর–জার্মানির মুলুকে।’
ততক্ষণে সিলেটি উচ্চারণে বিদেশী শব্দ কী ধ্বনি নেয়, তার খানিকটা আন্দাজ হয়ে গিয়েছে, তাই বুঝলুম, মারসেইলজ, হামবুর্গের কথা হচ্ছে। আর এটাও লক্ষ্য করলুম যে, সারেঙ বন্দরগুলোর নাম সোজা ফরাসি-জার্মান থেকে শুনে শিখেছে, তারা যে-রকম উচ্চারণ করে, ইংরিজির বিকৃত উচ্চারণের মারফতে নয়।
সারেঙ বলল, হামবুরে সব মাল নেমে গেল। সেখান থেকে আবার মাল গাদাই করে আমরা দরিয়া পাড়ি দিয়ে গিয়ে পৌঁছলুম নুউক বন্দরে–মিরকিন মুলুকে।
নিয়া ঝুনা কোন খালাসীকে নুউক বন্দরে নামতে দেয় না। বড় কড়াকড়ি সেখানে। আর হবেই বা না কেন? মিরকিন মুলুক সোনার দেশ। আমাদের মত চাষাভুষাও সেখানে মাসে পাঁচ-সাত শো টাকা কামাতে পারে। আমাদের চেয়েও কালা, একদম মিশকালা আদমীও সেখানে তার চেয়েও বেশি কামায়। খালাসীদের নামতে দিলে সব কটা ভোগে গিয়ে তামাম মুলুকে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণভরে টাকা কামাবে। তাতে নাকি মিরকিন মজুরদের জবর লোকসান হয়। তাই আমরা হয়ে রইলাম জাহাজে বন্দী।’
‘নুউক পৌঁছবার তিন দিন আগে থেকে সমীরুদ্দীর করল শক্ত পেটের অসুখ। আমরা আর পাঁচজন ব্যামোর ভান করে হামেশাই কাজে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সমীরুদী এক ঘণ্টার তরেও কোন প্রকারের গাফিলি করে নি বলে ডাক্তার তাকে শুয়ে থাকবার হুকুম দিলে।’
‘নুউক পৌঁছবার দিন সন্ধ্যেবেলা সমীরুদী আমাকে ডেকে পাঠিয়ে কসমকিরে খাইয়ে কানে কানে বললে, সে জাহাজ থেকে পালাবে। তারপর কী কৌশলে সে পারে পৌঁছাবে, তার ব্যবস্থা সে আমায় ভাল করে বুঝিয়ে বললে।
‘বিশ্বাস করবেন না। সায়েব, কী রকম নিখুঁত ব্যবস্থা সে কত ভেবে তৈরি করেছিল। কলকাতার চোরা-বাজার থেকে সে কিনে এনেছিল একটা খাসা নীল রঙের সুট, শার্ট, টাইকলার, জুতা, মোজা।
‘আমাকে সাহায্য করতে হল। শুধু একটা পেতলের ডেগচি যোগাড় করে দিয়ে। সন্ধ্যার অন্ধকারে সমীরুদী সাঁতারের জঙিয়া পড়ে নামল জাহাজের উলটো ধার দিয়ে, খোলা সমুদ্রের দিকে। ডেগচির ভিতরে তার সুট, জুতো, মোজা আর একখানা তোয়ালে। বুক দিয়ে সেই ডেগচি ঠেলেঠেলে বেশ খানিকটা চক্কর দিয়ে সে প্রায় আধা-মাইল দূরে গিয়ে উঠবে ভাঙায়। পাড়ে উঠে, তোয়ালে দিয়ে গা মুছে, জঙিয়া ডেগচি। জলে ডুবিয়ে দিয়ে শিস দিতে দিতে চলে যাবে শহরের ভিতর। সেখানে আমাদেরই এক সিলেটি ভাইকে সে খবর দিয়ে রেখেছিল হামবুর থেকে। পুলিশের খোঁজাখুঁজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে কয়েকদিন তারপর দাড়িগোঁফ কামিয়ে চলে যাবে নুউক থেকে বহুদূরে, যেখানে সিলেটিরা কাঁচা পয়সা কামায়। পালিয়ে ডাঙায় উঠতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার যে কোন ভয় ছিল না তা নয়, কিন্তু একবার সুটটি পরে রাস্তায় নামতে পারলে পুলিশ দেখলেও ভাববে, সে নুউকবাসিন্দা, সমুদ্রপারে এসেছিল হাওয়া খেতে।
‘পেলেনটা ঠিক উতরে গেল, সায়েব। সমীরুদ্দীর জন্য খোজ-খোঁজ রব উঠল। পরের দিন দুপুরবেলা। ততক্ষণে চিড়িয়া যে শুধু উড় গিয়া তা নয়। সে বনের ভিতর বিলকুল উধাও। একদম না-পাত্তা। বরঞ্চ বনের ভিতর পাখিকে পেলেও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু নুউক শহরের ভিতর সমীরুদীকে খুঁজে পাবে কোন পুলিশের গোসাঁই?’
গল্প বলায় ক্ষান্ত দিয়ে সারেঙ গেল জোহরের নমাজ পড়তে। ফিরে এসে ভূমিকা না। দিয়েই সারেঙ বললে, ‘তারপর হুজুর আমি পুরো সাত বচ্ছর জাহাজে কটাই। দু-পাঁচবার খিদিরপুরে নেমেছি বটে, কিন্তু দেশে যাবার আর ফুরসৎ হয়ে ওঠে নি। আর কী-ই বা হত গিয়ে, বাপ-মা মরে গিয়েছে, বউ-বিবিও তখন ছিল না। যতদিন বেঁচে ছিল, বাপকে মাঝে মাঝে টাকা পাঠাতাম-বুড়া শেষের কি বছর সুখেই কাটিয়েছে-খুদাতালার শুকুর-বুড়ি নাকি আমার জন্য কাঁদত। তা হুজুর দরিয়ার অথৈ নোনা পানি যাকে কাতর করতে পারে না, বুড়ির দু ফোঁটা নোনা জল তার আর কী করতে পারে বলুন!’