দ্বিপ্রহরে পরিপাটি আহারাদি করে ডেকচেয়ারে শুয়ে দূর-দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। কবিত্ব আমরা আসে না, তাই প্রকৃতির সৌন্দর্য আমার চোখে ধরা পড়ে না, যতক্ষণ না রবি ঠাকুর সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তাই আমি চাঁদের আলোর চেয়ে পছন্দ করি গ্রামোফোনের বাক্স। পোর্টেবলটা আনিব আনব করছি, এমন সময় চোখে পড়ল একখানা মন্দিতা ‘দেশ’—মালিক না আসা পর্যন্ত তিনি যদি পরিহস্তে কিঞ্চিৎ আভ্ৰষ্টা’ও হয়ে যান, তা তার স্বামী বিশেষ বিরক্ত হবেন না নিশ্চয়ই।
‘রূপদশী’ ছদ্মনাম নিয়ে এক নতুন লেখক খালাসীদের সম্বন্ধে একটি দরদ-ভরা লেখা ছেড়েছে। ছোকরার পেটে এলেম আছে, নইলে অতখানি কথা গুছিয়ে লিখল কী করে, আর এত সব কেচ্ছা-কাহিনীই বা যোগাড় করল কোথা থেকে? আমি তো একখানা ছুটির আর্জি লিখতে গেলেই হিমসিম খেয়ে যাই। কিন্তু লোকটা যা সব লিখেছে, এর কি সবই সত্যি? এতবড় অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে খালাসীরা লড়াই দেয় না কেন? হুঁ:! এ আবার একটা কথা হল! সিলেট নোয়াখালির আনাড়ীরা দেবে ঘুঘু, ইংরেজের সঙ্গে লড়াই-আমিও যেমন!
জাহাজের মেজো সারেঙের আজ বোধ হয় ছুটি। সিল্কের লুঙ্গি, চিকনের কুর্তা আর মুগার কাজ-করা কিস্তি টুপি পরে ডেকের ওপর টহল দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার আমার দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছেও। ডিসপ্যাচের পুঁটি ও মানওয়ারির তিমি দুইই মাছএকেই জিজ্ঞাসা করা যাক না কেন, ‘রূপদৰ্শ’ দর্শন করেছে কতটুকু আর কল্পনায় বুনেছে কতখানি!
একটুখানি গলা খাকারি দিয়ে শুধালুম, ‘ও সারেঙ সাহেব, জাহাজ লেট যাচ্ছে না। তো?’
লোকটা উত্তর দিয়ে সবিনয়ে বলল, ‘আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। সাহেব। আমি আপনাকে দু-একবারের বেশি দেখি নি, কিন্তু আপনার আব্বা সাহেব, বড় ভাই সাহেবেরা এ-গরিবকে মেহেরবানি করেন।’
খুশি হয়ে বললুম, ‘তোমার বাড়ি কোথা? বাস-না, তার ফুরসত নেই?’ ধাপ করে ডেকের উপর বসে পড়ল।
আমি বললুম, ‘সে কী? একটা টুল নিয়ে এসো। এসব আর আজকাল—’ কথাটি শেষ করলুম না, সারেঙও টুল আনল না। তারপর আলাপ পরিচয় হল। দ্যাশের লোক— সুখ-দুঃখের কথা অবশ্যই বাদ পড়ল না। শেষটায় মোক পেয়ে ‘রূপদশী-দর্শন’। তাকে আগাগোড়া পড়ে শোনালুম। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার জাতভাই চাষারা যেরকম পুঁথিপড়া শোনে সে রকম আগাগোড়া শুনল, তারপর খুব লম্বা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
আল্লাতালার উদ্দেশে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে বললে, ইনসাফের (ন্যায়ধর্মের) কথা তুললেন, হুজুর, এ-দুনিয়ায় ইনসাফ কোথায়? আর বে-ইনসাফি তো তারাই করেছে। বেশি, যাদের খুদা ধনদৌলত দিয়েছেন বিস্তর। খুদাতালাই কার জন্যে কী ইনসাফ রাখেন, তাই বা বুঝিয়ে বলবে কে? আপনি সমীরুদীকে চিনতেন, বহু বছর আমেরিকায় কাটিয়েছিল, অনেক টাকা কমিয়েছিল?’
আমেরিকার কথায় মনে পড়ল। ‘চোঁতলি পরগণায় বাড়ি, না, যেন ওই দিকেই কোনখানে।’
সারেঙ বললে, ‘আমারই গা ধলাইছড়ার লোক। বিদেশে সে যা টাকা কমিয়েছে। ওরকম কামিয়েছে অল্প লোকই! আমরা খিদিরপুরে সাইন (Sign) করে জাহাজের কামে ঢুকেছিলাম-একই দিন একই সঙ্গে।’
আম শুধালুম, ‘কী হল তার? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’
সারেঙ বললে, ‘শুনুন।’
‘যে লেখাটি হুজুর পড়ে শোনালেন, তার সব কথাই অতিশয় হক। কিন্তু জাহাজের কাজে, বিশেষ করে গোড়ার দিকে যে কী জান মারা খাটুনি তার খবর কেউ কখনও দিতে পারবে না যে সে জাহান্নামের ভিতর দিয়ে কখনও যায় নি। বয়লারের পাশে দাঁড়িয়ে যে লোকটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কয়লা ঢালে, তার সর্বাঙ্গ দিয়ে কী রকম ঘাম ঝরে দেখেছেন-এই জাহাজেই যার দুদিক খোলা, পদ্মার জোর বাতাসের বেশ খানিকটা যেখানে স্বচ্ছন্দে বেশ আনাগোনা করতে পারে। এ তো বেহেশৎ। আর দরিয়ার জাহাজের গর্ভের নীচে যেখানে এঞ্জিন-ঘর, তার সব দিক বন্ধ, তাতে কখনও হাওয়া-বাতাস ঢোকে না। সেই দশ বারো চোদ্দ হাজার টনী ডাঙর ডোঙর জাহাজের বয়লারের আকারটা কত বড় হয় এবং সেই কারণে গরমিটার বহর কতখানি, সে কি বাইরের থেকে কখনও অনুমান করা যায়? খাল বিল নদীর খোলা হাওয়ার বাচ্চা আমরা-হঠাৎ একদিন দেখি, সেই জাহান্নামের মাঝখানে কালো-কালো বিরাট-বিরাট শয়তানের মত কলকব্জা, লোহালক্কড়ের মুখোমুখি।
‘পয়লা পয়লা কামে নেমে সবাই ভিরমি যায়। তাদের তখন উপরে টেনে জলের কলের নীচে শুইয়ে দেওয়া হয়, হাঁশ ফিরলে পর মুঠো মুঠো নুন গেলান হয়, গায়ের ঘাম দিয়ে সব নুন বেরিয়ে যায় বলে মানুষ তখন আর বাঁচতে পারে না।
‘কিংবা দেখবেন কয়লা ঢেলে যাচ্ছে বয়লারে ঠিক ঠিক, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, বেলচা ফেলে ছুটে চলেছে সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে, খোকা ডেক থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। অসহ্য গরমে মাথা বিগড়ে গিয়েছে, জাহাজী বুলিতে একেই বলে ‘এখম’’—’
আমি শুধালুম ‘একেই কি ইংরাজিতে বলে এমাক (amuck)? কিন্তু তখন তো মানুষ খুন করে!’
সারেঙ বললে, ‘জী হাঁ। তখন বাধা দিতে গেলে হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়ে খুন করতে আসে।’ তারপর একটু থেমে সারেঙ বললে, ‘আমাদের সকলেরই দু-একবার হয়েছে, আর সবাই জীবড়ে ধরে চুবিয়ে আমাদের ঠাণ্ডা করেছে—শুধু সমীরুদী ককখনো একবারের তরেও কাতর হয় নি। তাকে আপনি দেখেছেন, সায়েব? বাং মাছের মত ছিল তার শরীর, অথচ হাত দিয়ে টিপলে মনে হত কচ্ছপের খোল। জাহাজের চীনা বাবুর্চির ওজন ছিল তিন মণের কাছাকাছি—তাকে সে এক থাবড়া মেরে বসিয়ে দিতে পারত। লাঠি খেলে খেলে তার হাতে জন্মেছিল বাঘের থাবার তাগিদ। কিন্তু সে যে ভিরমি যায় নি, ‘এমখ’ হয় নি, তার কারণ তার শরীরের জোর নয়-দিলের হিম্মৎ-সে মন বেঁধেছিল, যে করেই হোক পয়সা সে কামাবেই, ভিরমি গেলে চলবে না, বিমারি পাকড়ানো সখৎ মানা।’