জ্যাঠামশাই নার্ভাস সুরে বলেন, ‘হেঁ-হেঁ, এটা যেন, কেমন যেন,–হেঁ-হেঁ, তোমার লাক—হেঁ-হেঁ-নইলে আমি খেলাতে—’
আবার লাক! এক মুহূর্তে আমার হাসি থেমে গিয়ে হল বেজায় রাগ। বিলিয়ার্ডের বেলায়ও আমাকে শুনতে হয়েছিল ওই গুডুড্যাম লাকের দোহাই।
টং হয়ে এক ঝটিকায় টেবিলের তাস ছিটকে ফেলে বললুম, ‘তার মানে? আপনারা আমাকে কী পেয়েছেন? ইউ অ্যান্ড ইয়োর ড্যাম লাক, ড্যাম, ড্যাম—’
বাপ-জ্যাঠা কী বলে আমায় ঠাণ্ডা করতে চেয়েছিলেন আমরা সেদিকে খেয়াল নেই। কতক্ষণ চলেছিল তাও বলতে পারব না, আমরা গলা পর্দার পর পর্দা চড়ে যাচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার যত কটুকটব্য।
এমন সময় দেখি, ক্লারা।
কোথায় না। আমি তখন ইশে ফিরব-আমি তখন সপ্তমে না, একেবারে সেঞ্চারির নেশায়। শেষটায় বোধ হয়, ‘ছোটলোক’, ‘মীন’, এইসব অশ্রাব্য শব্দও ব্যবহার করেছিলুম। ক্লারা আমার কাঁধে হাত দিয়ে নিয়ে চলল। দরজার দিকে। অনুনয় করে বললে, ‘অত চটছ কেন, ওঁদের সঙ্গে না খেললেই হয়, ওঁরা ওই রকমই করে থাকেন।’
বেরুবার সময় পর্যন্ত শুনি ওঁরা বলছেন, ‘সিরি, সরি, প্লীজ প্লীজ। আমাদের দোষ হয়েছে।’
তবু আমার রাগ পড়ে না।’
চাচা কফিতে চুমুক দিলেন। রায় বললেন, ‘ঢের ঢের মদ খেয়েছি, ঢের ঢের মাতলামো দেখেছি, কিন্তু এরকম বিদঘুটে নেশার কথা কখনও শুনি নি।’
চাচা বললেন, ‘যা বলেছ! তাই আমি রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে গেলুম শোবার ঘরে! ঈভনিং-কোট, পাতলুন খোলার সঙ্গে সঙ্গে মাথা কিন্তু ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছে, বিয়ারের মগও হাতের কাছে নেই।
বালিশে মাথা দিতে না দিতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, সমস্ত সন্ধ্যা আর রাতভোর কী ছুচোমিটাই না করেছি!’ ছি-ছি, ক্লারার বাপ-জ্যাঠামশায়ের সামনে কী ইতরোমেই না করে গেলুম ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে!
আর এদেশে সবাই ভাবে ইন্ডিয়ার লোক কতই না বিনয়ী, কতই না নম্ৰ!
যতই ভাবতে লাগলুম, মাথা ততই গরম হতে লাগল। শেষটায় মনে হল, কাল সকলে, আজ সকালেই বলা ভাল, কারণ ভোরের আলো তখন জানলা দিয়ে ঢুকতে আরম্ভ করেছে, এঁদের আমি মুখ দেখোব কী করে? জানি, মাতালকে মানুষ অনেকখানি মাফ করে দেয়, কিন্তু এ যে একেবারে চামারের মাতলামো!
তা হলে পালাই।
অতি ধীরে ধীরে কোন প্রকারের শব্দটি না করে সুটকেসটি ওখানেই ফেলে গাছের আড়ালে আড়ালে কাসল থেকে বেরিয়ে স্টেশন পানে দে ছুটি। মাইলখানেক এসে ফিরে তাকালুম; নাঃ, কেউ পিছু নেয় নি।
চোরের মত গাড়িতে ঢুকে সোজা বার্লিন।’
মৌলা বললে, ‘শুনলেন, মামা?’
চাচা বললেন, ‘আরো শোনই না শেষ অবধি।’
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় তখন ঘরে বসে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছি, এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্লারা। হায়, হায়, আমি ল্যান্ডলেডিকে একদম বলতে ভুলে গিয়েছিলুম, সবাইকে যেন বলে, আমি মরে গিয়েছি কিংবা পাগলা-গারদে বন্ধ হয়ে আছি কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা!
শেষটায় মর-মর হয়ে ক্লারার কাছে মাতলামোর জন্য মাফ চাইলুম।
ক্লারা বললে, ‘অত লজ্জা পোচ্ছ কেন? ও তো মাতলামো না, পাগলামো। কিংবা অন্য কিছু, তুমি সব কিছু বুঝতে পার নি, আমরাও যে পেরেছি তা নয়।
‘তুমি যখন দাদার সুট পরে ডিনারে এলে তখনই তোমার সঙ্গে কোথায় যেন দাদার সাদৃশ্য দেখে বাবা আর আমি দুজনাই আশ্চর্য হয়ে গেলুম, বিশেষ করে ব্যাকব্রাশ করা চুল আর একটুখানি ট্যারীচা করে বাঁধা বো। দেখে। তার পর তুমি জোর গলায় চাইলে বিয়ার, দাদাও বিয়ার ভিন্ন অন্য কোন মদ খেত না; তুমি আরম্ভ করলে দাদারই মত বকতে, ‘লেখাপড়ার সময় কোথায়? আমি তো করি হৈ হৈ’–আমি জানতুম একদম বাজে কথা; কিন্তু দাদা হৈ হৈ করত। আর বলতেও কসুর করত না।’
‘শুধু তাই নয়। দাদাও ডিনারের পর বাবার সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলত এবং শেষটায় দুজনাতে ঝগড়া হত। জ্যাঠামশাই তখন নেমে এসে ওদের সঙ্গে তাস খেলা আরম্ভ করতেন এবং আবার হত ঝগড়া। অথচ তিনজনাতে ভালবাসা ছিল অগাধ।’
‘তোমাকে আর সব বলার দরকার নেই; তুমি যে ঘরে উঠছিলে ওই ঘরেই একদিন দাদা আত্মহত্যা করে।’
‘কিন্তু আসলে যে কারণে তোমার কাছে এলুম, তুমি মনে কষ্ট পেয়ে না; বাবাজ্যাঠামশাই আমাকে বলতে পাঠিয়েছেন, তারা তোমার ব্যবহারে কিছু মাত্র আশ্চর্য কিংবা দুঃখিত হন নি।’
চাচা থামালেন।
রায় বললেন, ‘চাচা, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, শিস দিয়েছিল সুন্টটাই, বিয়ারও ও-ই খেয়েছিল।’
চাচা বললেন, ‘হক কথা। মদ মানে স্পিরিট, স্পিরিট মানে ভুত, তাই স্পিরিট স্পিরিট খেয়েছিল।’
নোনাজল
সেই গোয়ালন্দ চাঁদপুরী জাহাজ। ত্রিশ বৎসর ধরে এর সঙ্গে আমার চেনাশোনা। চোখ বন্ধ করে দিলেও হাতড়ে হাতড়ে ঠিক বের করতে পারব, কোথায় জলের কল, কোথায় চাখিলির দোকান, মুর্গীর খাঁচাগুলো রাখা হয় কোন জায়গায়। অথচ আমি জাহাজের খালাসী নই-অবরের-সবরের যাত্রী মাত্র।
ত্রিশ বৎসর পরিচয়ের আমার আর সবই বদলে গিয়েছে, বদলায়নি। শুধু ডিসপ্যাচ স্টীমারের দল। এ-জাহাজের ও-জাহাজের ডেকে-কেবিনে কিছু কিছু ফেরফার সব সময়ই ছিল, এখনও আছে, কিন্তু সব কটা জাহাজের গন্ধটি হুবহু একই। কীরকম ভেজা-ভেজা, সোদা-সোদা যে গন্ধটা আর সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেটা মুর্গী-কারি রান্নার। আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, সমস্ত জাহাজটাই যেন একটা আস্ত মুর্গী, তার পেটের ভেতর থেকে যেন তারই কারি রান্না আরম্ভ হয়েছে। এ-গন্ধ তাই চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, যে কোন স্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই পাওয়া যায়। পুরনো দিনের রূপরসগন্ধস্পর্শ সবই রয়েছে, শুধু লক্ষ্য করলুম ভিড় আগের চেয়ে কম।