তারপর আমি কী বকর-ব্যকর করেছিলুম আমার স্পষ্ট মনে নেই। সঙ্গে সঙ্গে চলছে বিয়ারের পর বিয়ার, কখনও বা বেশ উঁচু গলায় বলে উঠি, ‘গুস্টাফ, আরও বিয়ার নিয়ে এস।’
এ কী অভদ্রতা! কিন্তু কারও মুখে এতটুকু চিত্তবৈকল্যের লক্ষণ দেখতে পেলুম না, কিংবা হয়তো লক্ষ্য করি নি। আর ভাবছি, ডিনার শেষ হলে বাঁচি।
শেষ হলও। আমরা ড্রইংরুমে গিয়ে বসলুম। কফি লিকার সিগার এল। আমি অভদ্রতার চূড়ান্তে পৌঁছে বললুম, ‘নো লিকার, বিয়ার প্লীজ!’
বাবা হেসে বললেন, ‘আমাদের বিয়ার তোমার ভাল লাগাতে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু একটু বিলিয়ার্ড খেললে হয় না? তুমি খেলো?’
বললুম, ‘আলবত!’ অথচ আমি জীবনে বিলিয়ার্ড খেলেছি মাত্র দুদিন, কলকাতার ওয়াই.এম.সি.এ-তে। এখানকার বিলিয়ার্ড টেবিলে আবার পকেট থাকে না, এতে খেলা অনেক বেশি শক্ত।
জ্যাঠামশাই দাঁড়িয়ে বললেন, ‘গুড বাই, তোমরা খেলোগে।’
ক্লারাও আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ‘গুড নাইট’ বললে।
খুব নিচু ছাতওয়ালা, প্রায় মাটির নীচে বিরাট জলসাঘর, তারই এক প্রান্তে বিলিয়ার্ডটেবিল। দেওয়ালের গায়ে গায়ে সারি সারি বিয়ারের পিপে। এত বিয়ার খায় কে? এরা তো কেউ বিয়ার খায় না দেখলুম।
ইতিমধ্যে লিকারের বদলে ফের শ্যাম্পেন উপস্থিত। আমি বললুম, ‘নো শ্যাম্পেন।’ আবার চলল বিয়ার।
মার্কার কিউ এনে দিলে। আমি সেটা হাতে নিয়ে একটু বিরক্তির সঙ্গে বললুম, ‘এ আবার কি কিউ দিলে?’
মার্কারের মুখ কোন অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল না। বরঞ্চ যেন খুশি হয়েই আলমারি খুলে একটি পুরনো কিউ এনে দিলে! আমি পাকা খেলোয়াড়ির মত সেটা হাতে ব্যালানস করে বললুম, ‘এইটেই তো, বাবা, বেশী; তবে ওই পচা মাল পাচার করতে গিয়েছিলে কেন?’
আমার বেয়াদবি তখন চুড়া ছেড়ে আকাশে উঠে ঢলাচলি আরম্ভ করে দিয়েছে। অবশ্য তখনও ঠিক ঠিক ঠাহর হয় নি, মালুম হয়েছিল অনেক পরে।
গ্রামের একঘেয়ে জীবনের ঝানু খেলোয়ারকে আমি হারাব এ আশা অবিশ্যি আমি করি নি; কিন্তু খেলতে গিয়ে দেখলুম, খুব যে খারাপ খেলছি তা নয়, তবে আমার প্রত্যাশার চেয়ে ঢের ভাল। আর প্রতিবারেই আমি লীড পেয়ে যাচ্ছিলুম অতি খাসা, স্বপ্নের বিলিয়ার্ডেও মানুষ ও রকম লীড পায় না।
রাত কটা অবধি খেলা চলেছিল বলতে পারব না। আমি তখন তিনটি বলের বদলে কখনও ছটা কখনও নটা দেখছি, কিন্তু খেলে যাচ্ছি ঠিকই, খুব সম্ভব ভাল লীডের লাকে।
হের ফন ব্ৰাখেল শেষটায় না বলে থাকতে পারলেন না, ‘তোমার লাক বড় ভাল।’
অত্যন্ত বেকসুর মন্তব্য। আমি কিন্তু চটে গিয়ে বেশ চড়া গলায় বললুম, ‘লাক, না। কচুর ডিম! নাচতে না জানলে শহর বাঁকা। আই লাইক দ্যাট্!’
ব্ৰাখেল কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, আমিও অষ্টমে উঠে আরও কথা শুনিয়ে দিলুম। ওদিকে দেখি মার্কার ব্যাটা মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি আরও চটে গিয়ে হুঙ্কার দিলুম, ‘তোমার মুলোর দোকান বন্ধ কর, এখন রাত সাড়ে তেরোটায় কেউ মূলো কিনতে আসবে না।’ অথচ বেচারি বুড়ো থুত্থুড়ো, সব কটা দাঁত জগন্নাথ দেবতাকে দিয়ে এসেছে।
চিৎকার-চেল্লাচেল্লির মধ্যিখানে হঠাৎ দেখি সামনে জ্যাঠামশাই, পরনে তখনও পরিপাটি ঈভনিং-ড্রেস।
আবার সেই নার্ভাস স্বরে বললেন, ‘সরি সরি, তোমরা কিছু মনে কোর না, আমি শব্দ শুনে এলুম।’ তারপর ক্লারার বাপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই বড় ঝগড়াটে, ভালফগাঙ, নিত্য নিত্য এর সঙ্গে ঝগড়া করিস।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘তার চেয়ে বরঞ্চ একটু তাস খেললে হয় না? আমার ঘুম হচ্ছে না।’
আমি বললুম, ‘হুঁ হুঁ হুঁ।’
তাসের টেবিল এল।
আমি স্কট খেলেছি বিলিয়ার্ডের চেয়েও কম।
জ্যাঠা বললেন, কী স্টেক?’
বাপ বললেন, ‘নিত্যিকার।’
‘নিত্যিকার’ বলতে কী বোঝাল জানি নে। ওদিকে আমার পকেটে তো ছুঁচো ডিগবাজি খেলছে। জ্যাঠা হিসাব করে বললেন, ‘হানস পনেরো মার্ক ভলফগাঙ দুই।’
আপনার থেকে আমার বাঁ হাত কোটের ভিতরকার পকেটের দিকে রওনা হল। তখনই মনে পড়ল, এ কোটি তো ক্লারার দাদার। আমার মানিব্যাগ তো পড়ে আছে আমার খাটে, উপরের তলায়। কিন্তু তারই সঙ্গে সঙ্গে হাত গিয়ে ঠেকাল এক তাড়া করকরে নোটে। ঈশ্বর পরম দয়ালু, তাহার কৃপায় টাকা গজায়, এই টাকা দিয়েই আজকের ফাড়া কাঁটাই, পরের কথা পরে হবে। ক্লারাকে বুঝিয়ে বললে সে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না। আর নিজের মনিব্যাগে রেস্ত আছেই বা কী? দশ মার্ক হয় কি না-হয়।
এদিকে রেস্ত নেই, ওদিকে খেলার নেশাও চেপেছে। পরের বাজিতে আবার হারলুম, এবার গেল আরও কুড়ি মার্ক, তারপর পঞ্চাশ, তারপর কত তার আর আমার হিসেব নেই। নোটের তাড়া প্রায় শেষ হতে চলল। আমি যুধিষ্ঠির নই, অর্থাৎ কোন রমণীর উপর টুয়েন্টি পার্সেন্ট অধিকারও আমার নেই, না হলে তখন সে রেস্তও ভাঙাতে হত, এমন সময় আস্তে আস্তে আমার ভাগ্য ফিরতে লাগল। দশ কুড়ি করে সব মার্ক তোলা হয়ে গেল, তারপর প্রায় আরও শ দুই মার্ক জিতে গেলুম।
ওদিকে মদ চলছে পাইকারি হিসেবে আর জ্যাঠামশাই দেখি হারার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি নার্ভাস হয়ে যাচ্ছেন। আমি তো শেষটায় না থাকতে পেরে খলখল করে হোসে উঠলুম। কিছুতেই হাসি থামাতে পারি নে। গলা দিয়ে এক ঝলক বিয়ার বেরিয়ে এল, কোন গতিকে সেটা রুমাল দিয়ে সামলালুম। কিন্তু হাসি আর থামাতে পারি নে। বুঝলুম, এরেই কয় নেশা।