টেবিলের এক প্রান্তে ক্লারা ফন ব্ৰাখেল, অন্য প্রান্তে যে ভদ্রলোক বসেছেন তাকে ঠিক ক্লারার বাপ বলে মনে হল না, অতখানি বয়স যেন ওঁর নয়।
প্রথম দর্শনেই দুজন কেমন যেন হ’কচাকিয়ে গেলেন। বাপের হাত থেকে তো ন্যাপকিনের আংটিটা ঠং করে টেবিলের উপর পড়ে গেল। আমি আশ্চর্য হলুম না, ভদ্রলোক হয়তো জীবনে এই প্রথম ইন্ডার (ভারতীয়) দেখেছেন, কালো ঈভনিং-ড্রেসের ওপর কালো চেহারা-গোসাঁইয়ের পদাবলীতে—
‘কালোর উপরে কালো।’
হকচাকিয়ে যাওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। কিন্তু ক্লারা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকালে ঠিক বুঝতেই পারলুম না। তবে কি বোটা ঠিক হেডিং মাফিক বীধা হয় নি! কই, আমি তো একদম রেডিমেডের মত করে বেঁধেছি, এমন কি হালফ্যাশান মাফিক তিন ডিগ্রি ট্যারীচাও করে দিয়েছি। তবে কি ঈভনিং ড্রেস আর ব্যাকব্রাস করা চুলে আমাকে ম্যাজিসিয়ানের মত দেখাচ্ছিল?
সামলে নিয়ে ক্লারা ভদ্রলোককে বললে, ‘পাপা, এই হচ্ছে আমার ইন্ডিয়ার আফে!’
অর্থাৎ, ভারতীয় বাঁদর।
বাপও ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন। মিষ্টি হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে শেক-হ্যান্ড করলেন। ক্লারাকে বললেন, ‘পফূই-ছিঃ, ও-রকম বলতে নেই।’
আমি হঠাৎ কী করে বলে ফেললুম, ‘আমি যদি বাঁদর হই। তবে ও জিরাফ।’
বলেই মনে হল, তওবা, তওবা, প্রথম দিনেই ও-রকম জ্যাঠামো করা উচিত হয় নি।
পিতা কিন্তু দেখলুম, মন্তব্যটা শুনে ভারি খুশ। বললেন ‘ডাঙ্কে—ধন্যবাদ-ক্লারাকে ঠিক শুনিয়ে দিয়েছ। আমরা তো সাহস পাই নে।’
পালিশ-আয়নার মত টেবিল, স্বচ্ছন্দে মুখ দেখা যায়। তার উপর ওলন্দাজ লেসের গোল গোল হালকা চাকতির উপর প্লেট পিরিচ সাজানো। বড় প্লেটের দুদিকে সারি বাঁধা অন্তত আটখানা ছুরি, আটখানা কাঁটা, আধা ডজন নানা ঢঙের মদের গেলাস। সেরেছে। এর কোন ফর্ক দিয়ে মুরগী খেতে হয়, কোনটা দিয়ে রোস্ট আর কোনটা দিয়েই বা সাইডু ডিশ?
আসল খাবার পূর্বের চাট—’আর দা অভূরে’র নাম দিয়েছি আমি চাট, তখন দেওয়া হয়ে গিয়েছে। খুঞ্চার ছ। পদ থেকে আমি তুলেছি মাত্র দুপদ, কিঞ্চিৎ সসেজ আর দুটি জলপাই, এমন সময় বাটলার দুহাতে গোটা চারেক বোতল নিয়ে এসে শুধাল, শেরি? পোর্ট? ভোরমুট? কিংবা হুইস্কি সোডা?
আমি এসব দ্রব্য সসম্রামে এড়িয়ে চলি। হঠাৎ কী করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘নো বিয়ার!’
বলেই জিভ কাটলুম। আমি কী বলতে কী বললুম! একে তো আমি বিয়ার জীবনে কখনও খই নি, তার উপরে আমি ভাল করেই জানি, বিয়ার চাষাড়ে ড্রিঙ্ক, ভদ্রলোকে যদিবা খায়। তবে গরমের দিনে, তেষ্টা মেটাবার জন্যে। অষ্টপদী ব্যানকুয়েটে বিয়ার! এ যেন বিয়ের ভোজে কালিয়ার বদলে শুটকি তলব করা!
ক্লারা জানত, আমি মদ খাই নে, হয়তো বোপকে তাই আগের থেকে বলে রেখে আমার জন্যে মাফ চেয়ে রেখেছিল, তাই সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালে।
বাটলার কিন্তু কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে এক ঢাউস বিয়ারের মগ নিয়ে এল, তার ভিতর অনায়াসে দু বোতল বিয়ারের জায়গা হয়।
যখন নিতান্তই এসে গিয়েছে তখন খেতে হয়। ভাবলাম, একটুখানি ঠোঁটে ভেজাব মাত্র, কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করবে না, খেতে গিয়ে ঢক ঢক করে প্রায় আধ মগ সাফ করে দিলুম।
মৌলা এক বিঘাত হাঁ করে বললে, ‘এক ধাক্কায় এক বোতল? মামুও তো পারবে না।’
চাচা বললেন, ‘কোন শরম দিচ্ছিস, বাবা? ওরকম ঈভনিং-ড্রেস পরে ব্যানকুয়েট হলে বসলে তোর মামাও এক ঝটিকায় দু পিপি বিয়ার গিলে ফেলত। বিয়ার কি আমি খেয়েছিলুম? খেয়েছিল ওই শালার ড্রেস!’
গোসাঁই মর্মাহত হয়ে বললে, ‘চাচা।’
চাচা বললেন, ‘অপরাধ নিস নি গোসাঁই, ভাষা বাবদে আমি মাঝে মাঝে এটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে যাই। জানিস তো আমার জীবনের পয়লা গুরু ছিলেন এক ভশচয, তিনি শকার ব’–কার ছাড়া কথা কইতে পারতেন না। তা সে কথা থাক।’
তখনও খেয়েছি মাত্র আড়াই চাক্তি সসেজ আর আধখানা জলপাই, পেট পদ্মার বালুচর। সেই শুধু-পেটে বিয়ার দু মিনিট জিরিয়েই চচ্চড় করে চড়ে উঠল মাথার ব্ৰহ্মরন্ধে।
এমন সময় হের ফন ব্ৰাখেল জিজ্ঞেস করলেন, ‘বার্লিনে কী রকম পড়াশোনা হচ্ছে?’
বুঝলুম এ হচ্ছে ভদ্রতার প্রশ্ন, এর উত্তরে বিশেষ কিছু বলতে হয় না, হুঁ হুঁ করে গেলেই চলে। কিন্তু আমি বললুম, ‘পড়াশোনা? তার আমি কী জানি? সমস্ত দিন, সমস্ত রাত বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না, তো কাটে হৈ হৈ করে ইয়ার-বকশীদের সঙ্গে।’
বলেই অবাক হয়ে গেলুম। আমার তো দিনের দশ ঘণ্টা কাটে স্যাটস বিবলিওটেকে, স্টেট লাইব্রেরিতে, ক্লারারও সে খবর বেশ জানা আছে। ব্যাপার কী? সেই গল্পটা তোদের বলেছি?—পিপের ছাদা দিয়ে হুইস্কি বেরুচ্ছিল, ইঁদুর চুক চুক করে খেয়ে তার হয়ে গিয়েছে নেশা, লাফ দিয়ে পিপের উপরে উঠে আস্তিন গুটিয়ে বলছে, ‘ওই ড্যাম ক্যাটটা গেল কোথা? ব্যাটাকে ডেকে পাঠাও, তার সঙ্গে আমি লড়াব।’
কিন্তু এত সাত-তাড়াতাড়ি কি নেশা চড়ে?
ইতিমধ্যে আপন অজানাতে বিয়ারে আবার লম্বা চুমুক দিয়ে বসে আছি।
করে করে তিন-চার পদ খাওয়া হয়ে গিয়েছে। যখন রোস্ট টার্কীতে পৌঁছেছি, তখন দেখি অতি ধোপদূরস্ত ঈভনিং-ড্রেস-পরা আর এক ভদ্রলোক টেবিলের ওদিকে আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। ক্লারা তাকে বললে, ‘জ্যাঠামশাই, এই আমাদের ইন্ডার।’ বড় নার্ভাস ধরনের লোক। হাত অল্প অল্প কাঁপছে। আর বার বার বলছেন, ‘তোমরা ব্যস্ত হয়ো না, সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে, আমি শুধু ইয়ে—’ তারপর আমার দিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমি শুধু রোস্ট আর পুডিং খাই বলে একটু দেরিতে আসি।’