মহবুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘হা, আপনার তাতে কী?’
আবদুর রহমানের উপদেশ স্মরণে এল। বললুম, না, না, আপনি আমাকে এতখানি হৃদয়হীন মনে করবেন না। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমাকে যেখানে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং যেস্থলে আমার হাতে কোনও সমাধা নেই, সেখানে আমি উপদেশই বা দিই। কী প্রকারে?’
***
কাবুলে এপিডেমিক সর্দিকাসি দেখা দিল। ঝাড়া দশ দিন ঘরে বন্ধ থাকতে হল। সেরে উঠে শুনি, মহবুব আলী আমার চেয়েও বে-এক্তেয়ার। ভেবেছিলুম। কিছুদিন ও-পাড়া মাড়াব না। তবু যেতে হল।
এবারে মণি দরজা খুলেই যা পশতুর তুবড়ি বাজি, বিডন বিশপ ফলস চালালে, তার সামনে আমি একদম হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। কুমারী পার্বতী কাম্য পতিনিন্দা শুনে ন যযৌ ন তস্থেী হয়েছিলেন, আমি উলটো অবস্থায়। ফল কিন্তু একই।
লক্ষ্য করলুম, মণিকে ভয়ঙ্কর রোগা দেখাচ্ছে। ফার্সীতে শুধালুম, সির্দি হয়েছে নাকি?’ মণি এক বর্ণ ফাঁসী বোঝে না। খলখল করে হেসে বাড়ির ভিতর চলে গেল।
মহবুব এলেন লাঠিতে ভর করে। ঠাণ্ডা দেশের সর্দি, যাবার বেলা মানুষকে অর্ধমৃত করে দিয়ে যায়। বিশেষ করে যাদের চর্বি নিয়ে কারবার।
আমি জানতুম ওই কথাই উঠবে, যদিও আশা করেছিলুম, নাও উঠতে পারে। মণির বেশ উত্তেজনা থেকে অবশ্য আমেজ করেছিলুম, আরও কিছু একটা হয়েছে।
বললেন, ‘ওই যে আমাদের ছোকরা চাপরাসী মাহমুদ জান, রাসকেল না ইডিয়ট কী বলব! সেই ঘটিয়েছে কাণ্ডখানা। আপনি যখন দিন সাতেক এলেন না, তখন ওই মাহমুদ মণিকে একটা খাসা আরব্য উপন্যাস শোনালে। রাসকেলটা গল্প বানাতে আস্ত পাঠান। সে মণিকে বললে, ‘বাদশা আমানুল্লা খান সৈয়দ সায়েবকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এদেশে বিয়ে না করে দামড়ার মত ঘুরে বেড়ানো অত্যন্ত অনুচিত। লোকনিন্দা হয়, বিশেষ করে আপনি যখন শিক্ষক। তারপর সৈয়দ সায়েবের হাত ধরে তাকে নিয়ে গেলেন তার মেয়েইস্কুলে। সেখানে দু’শো মেয়েকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হুকুম দিলেন, বেছে নাও। সৈয়দ সাহেব আর কি করেন! শাহানবাদশার হুকুম। না মানলে গর্দন। আর মেয়েগুলোই বা কি কম খাপসুরত! সৈয়দ সায়েব বিয়ে করে মশগুল। তাই এদিকে আসার ফুরসৎ তার আর কই?’
আমি জীবনে ওই একবারই গীতাবর্ণিত নিষ্কল্প প্রদীপ-শিখাবৎ!
মহবুব আলী বললেন, ‘মণি তো চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তার পর শয্যা নিল, এই ড্রইং-রুমের দরজার গোড়ায়। একটানা রোজার উপবাস। রাত্রেও খায় না।–’
আমিও শুধালুম, ‘মণি বিশ্বাস করলে ওই গাঁজাখুরি?’
‘কেন করবে না? মণি মাঝে মাঝে মোটরে করে আমার বিবির সঙ্গে শহরে যায়। পথে পড়ে মেয়ে-ইস্কুল! দেখেছে, মেয়েগুলোর বরফের মত ফরসা রঙ, বেদানার মত ট্যাবট্যাবা লাল গাল, ধনুকের মত ভুরু—’
আমি বললুম, ‘থাক থাক। আপনাকে আর কবিত্ব করতে হবে না। কিন্তু আমি তো পছন্দ করি শ্যামবর্ণ—’।
এইবার মহবুব আলীর মুখে ফুটল মধুর হাসি। ন্যাকরা-গলা আবদেরে আবদেরে সুরে বললেন, ‘তা হলে মণিকে ডেকে সেই সুসমাচার শুনিয়ে দি এবং এটাও বলব কি যে, আপনি মণিকে কাবুলী মেয়েদের চেয়ে বেশি খাপসুরত বলে মনে করেন?’
আমি তো রেগে টঙ। চিৎকার করে বললুম, বিলুন, বলুন, বিশ্বসুদ্ধকে বলুন। আমার কী আপত্তি? মণি যখন বিশ্বাস করে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তখন তো আপনার সব সমস্যা সমাধান হয়ে গিয়েছে।’
মহবুব আলী হাসলেন, আরও মধুর হাসি। আমার গা জ্বলে গেল।
অমিয় ছানিয়া বললেন, ‘ওই তো আপনার ভুল। তাই যদি হত। তবে আপনাকে দেখামাত্রই মণি হাসির বন্যা জাগাল কেন? চিৎকার করে তখন কী বলেছে, শুনেছেন? না, আপনি পশতু বোঝেন না। বলেছে, ওঁর হাতে মেহদীর দাগ নেই, উনি বিয়ে করেন নি।’
আমি চুপ। শেষটায় কাতর কণ্ঠে শুধালুম, ‘মেহদীর দাগ ছাড়া কি কখনও বিয়ে হয় না?
মহবুব আলী বললেন, ‘বোঝান গিয়ে মণিকে। আপনাকে কতবার বলেছি, ও পাঠানমেয়ে, ও বোঝে পাঠানদের কায়দাকানুন। ও শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় পাঠানজগতে। বিশ্বভুবনের খবর ও রাখে না। ’
আমি শুধালুম, আপনাকে গতবারে দেখেছিলুম, এ-ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত দুশ্চিস্তাগ্রস্ত। সেটা হঠাৎ কেটে গেল কী প্রকারে? আমার তো মনে হচ্ছে জিনিসটে আরও বেশি প্যাঁচালো হয়ে যাচ্ছে।’
তিন বললেন, ‘পাঠান-মেয়েরা সচরাচর ব্যাপ-চাচার আদেশমত নাক কান বুজে বিয়ে করে। কিন্তু হঠাৎ কখনও যদি পাঠান মেয়ে কাউকে ভালবেসে ফেলে তখন সে আগুনে হাত না দেওয়াই ভাল। ব্যাপারটায় গুরুত্ব গোড়ার দিকে আমি বুঝতে পারি নি; তাই তার একটা সমাধান খুঁজেছিলুম। এখন নিরাশ হয়ে অভয় মেনে বসে আছি।’
আমি আর কী বলব! অত্যন্ত চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরলুম।
***
সমস্যার ফয়সালা করে দিল বাচ্চায়ে সকাও কাবুল আক্রমণ করে। আমি থাকি শহরের মাঝখানে, ব্রিটিশ লিগেশন শহরের বাইরে মাইল দেড়েক দূরে। বাচ্চা এসেছে সেদিক থেকেই এবং থানা গেড়েছে লিগেশন আর শহরের মাঝখানে। লিগেশন আর শহর একে অন্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সেখানে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
কয়েকদিন পরে বাচ্চা হটে গেল। তখন ব্রিটিশ প্লেন এসে বিদেশী মেয়েদের পেশাওয়ার নিয়ে যেতে লাগল। খবর পেয়েই ছুটে গেলুম আমার বন্ধু মৌলানা জিয়াউদ্দীনের স্ত্রীর জন্য একটা সীট যোগাড় করতে।
মহবুব আলীর কলিং-বেল টেপা মাত্রই এবারে দরজা খুলল না। তখন হ্যান্ডেল ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল।