মণি আমাকে দেখে নিঃসঙ্কোচে পশতু ভাষায় কিচির-মিচির করে উঠল। কিছুতেই থামতে চায় না। আমি একবার সামান্য সুযোগ পেয়ে বললুম, পশতু, তারপর বাঁ হাত উপরের দিকে তুলে ভরতনাট্যম কায়দায় পদ্মফুল ফোঁটাবার মুদ্রা দেখিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, ‘ড্ডনং’। অর্থাৎ আমি পশতু বুঝিনে। কিন্তু কে বা শোনে কার কথা! ভরতনাট্যমে আমি যদি হই খুচরো কারবারী, মণির বেসাতি দেখলুম পাইকিরি লাটের। ডান হাত দিয়ে এক অদৃশ্য বঁটা নিয়ে আকাশের বেশ খানিকটা বঁট দেবার মুদ্রা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলে, ‘কুছ পরওয়া নহী।’ কিন্তু শুধু মুদ্রা দিয়ে তো আর বেশিক্ষণ কথাবার্তা চালানো যায় না। তা হলে মানুষ ভাষার সৃষ্টি না করে শুধু নোচে কুদে ও মুদ্রা দেখিয়েই শঙ্করদর্শনের আলোচনা চালাত, একে অন্যকে এটম বাম বানাবার কৌশল শেখাত।
ইতিমধ্যে গফুর এসে আমার পায়ের কাছে কার্পেটের উপর বসে জানালে মহবুব আলী শহরে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে। তবে পইপই করে বলে গিয়েছেন, আমাকে যেন আটকে রাখা হয়। মণি ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গিয়েছে।
গফুর তার মনিবের সঙ্গে যে-রকম খোলা-দিলে গল্প জমায় আমার সামনে সেই ভাবেই উজির-নাজির কতল করতে আরম্ভ করল। আশকথা-পাশকথা বলে সে শুধালে, ‘মণিকে আপনার কী রকম লাগে?’
আল্লা জানেন, মৌলা আলীর দোহাই, আমি সব নই। দাসী পরিচারিকা সম্বন্ধে আন্তরিকতার সঙ্গে আলোচনা করতে আমার কণামাত্র আপত্তি নেই। আমার সেবক আবদুর রহমানের সঙ্গে আমার বে-ভাবের আদান-প্ৰদান রস-রসিকতা চলত, সে-রকম ধারা আমি বহু ‘শিক্ষিত’। ‘খানদান’ লোকের সঙ্গে করতে রাজী নই। কিন্তু এখানে তো ব্যাপারটা অতখানি সরল নয়। তাই একটু বিরক্তির সুরে বললুম, ‘আমার লাগা না-লাগার কী আছে?’
গফুর আমরা উত্তর শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে বললে, ‘এ আপনি কী বলছেন! আপনি শেখ মহবুব আলীর দোস্ত। তাঁর ইষ্টকুটুম, গোষ্ঠীপরিবারের পাঠান-পখাতুনের চেয়ে আপনাকে উনি ঢের ঢের বেশি ভালবাসেন। আর আপনি যেভাবে কথা বললেন, তাতে মনে হল ওঁর পরিবারের জন্য আপনার যেন কোন দরদ নেই। আজ যদি মণির বিয়ের সম্বন্ধ আসে। তবে কি মহবুব আলী আপনার সঙ্গে ওই বাবদে সলা পরামর্শ না নিয়ে থাকতে পারবেন?’
আমি শুধালুম, ‘এসেছে নাকি?’ সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে বললুম, থুড়ি, ভুল করলুম, এতখানি ঔৎসুক্য দেখানো উচিত হয় নি। শান্দির পয়লা রাতে বেড়াল মারবে, এ যে দুসারা রাত খতম হবার উপক্রম!’
আমার ভাবান্তর লক্ষ্য না করেই গফুর সোৎসাহে বললে, ‘গণ্ডায় গণ্ডায়। সুবে পেশওয়ার-কোহট, বনু দেরা ইসমাইল খান, ইস্তেক জম্মু জলন্ধর অবধি। লিগেশনের সব কটা পাঠান চাপরাসী-দফতরি, কেরানী খাজাঞ্চী মণিকে শান্দি করতে চায়।’
আমি জানতুম, পাঠানদের আপনি গোষ্ঠীর ভিতর জাতবিচার নেই। কিন্তু সেটা ছিল থিয়োরেটিকল জানা, এখন দেখলুম। সেটা কীরকম মারাত্মক প্র্যাকটিকাল। লিগেশনের খাজাঞ্চী মেলের লোকও পরিচারিকা মণিকে বিয়ে করতে চায়!
ইতিমধ্যে মণি দু-তিনবার ঘরে এসে অগ্নিবাণ হেনে গফুরের দিকে তাকিয়েছে। ভাষা না জেনেই বুঝতে পেরেছে, ওর সম্বন্ধেই কথাবার্তা হয়েছে। আমি গতিক সুবিধের নয় দেখে বললুম ‘থাক্ থাক।’
মণি আমার জন্য এক অজানা পেশাওয়ারি কাবাব বানিয়েছে। ভারি মোলায়েম। দেখে মনে হয়। কাঁচা, কিন্তু হাত দিয়ে মুখের কাছে তুলতে না তুলতেই ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে। আমি আগের থেকেই হাঁ করে ছিলুম; মুখে কিছু পৌঁছল না দেখে মণি খিলখিল করে হেসে উঠল। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ভিতরের দরজা দিয়ে অন্তর্ধান করল।
মহবুব আলী এলেন। দাবার ফাঁকে বললেন, মণিকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি।’
আমি বললুম, ‘কিস্তি সামলান। ঘোড়া উঠে, নৌকা ঘোড়ার ডবল কিস্তি।’
মহবুব আলী বললেন, ‘মণিকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি।’
আমি বললুম, হঁয়া, আমিও বিপদে পড়েছি। আবদুর রহমান বলছিল, এখন থেকে সবাইকে রাস্তায় দেরেশী পরে বেরুতে হবে। দর্জির দোকানে ভিড় লেগেছে। কী করি, বলুন তো?’
ততক্ষণে খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি যথারীতি হেরে গিয়েছি।
পূর্বেই বলেছি, মহবুব আলী চাণক্যস্য চাণক্য। তাই এটাও জানেন, কখন সাফসাফ খোলাখুলি কথা কইতে হয়। বললেন, মণিকে বিয়ে করার জন্য সব কটা পাঠান আমার দোরে। ধন্না দিচ্ছে। ওদিকে মণি বলে, সে কাউকে বিয়ে করতে চায় না। কেন? আমার বিবি বললেন, সে নাকি—’
আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘বাস, বাস।’
মহবুব আলী আমার উম্মার জন্য তৈরি ছিলেন। আমার দুখানা হাত ধরে বললেন, ‘দোস্ত, আমি জানি, এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আপনি সৈয়দ বংশের ছেলে। আপনারা পাঠানমোগলে বিয়ে শান্দি করেন না। যদিও কুরান হাদিসের রায়, যে-কোনও মুসলমান যে-কোনও মুসলমানীকে বিয়ে করতে পারে। হক কথা। কিন্তু লোকাচার দেশাচারও আছে। সেগুলো মানতে হয়। আজ যদি আপনি আমার বোন কিংবা শালীকে বিয়ে করে দেশে ফেরেন তবে আমি কোনও রকম দুশ্চিন্তা করব না। কিন্তু মণিকে বোঝাই কী করে, আপনার সঙ্গে তার বিয়ে সম্পূর্ণ অসম্ভব। সে ছেলেবেলা থেকে দেখেছে যে-কোনও মেয়ের সঙ্গে যে-কোনও ছেলের বিয়ে হয়। তা যে শুধু পাঠানদের ভিতরেই, সে কী করে জানবে বলুন? বাইরের সংসারে যে অন্য ব্যবস্থা, কী করে বুঝবে বলুন?’
আমি আরও বিরক্ত হয়ে বললুম, আঃ! কী এক স্টর্ম ইন এ টি-পট! তিলকে তাল! আপনার বাড়ির মেয়ে কাকে বিয়ে করতে চায়, না-করতে চায়, তাতে আমার কী?’