আমি ভয় পেয়ে শুধালুম, ‘ওই আকাশে চড়তে হবে?’
কোচম্যান ঘাড় ফিরিয়ে গর্বের হাসি হেসে বললে, ‘ইয়াঃ মাইন হের!’ দেমাকের ঠ্যালায় তার গোঁপের ডগা দুটো আরও আড়াই ইঞ্চি প্রমোশন পেয়ে গেল। তারপর ভরসা। দিলে, ‘এক মিনিটে পৌঁছে যাব স্যারা’ আমি মনে মনে মৌলা আলীকে স্মরণ করলুম।
এ কী বিদঘুটে ঘোড়া রে বাবা, এতক্ষণ সমান জমিতে চলছিল আমাদের দিশী টাটুর মত কদম আর দুলকি চাল মিশিয়ে, এখন চড়াই পেয়ে চলল লাষী চালে। রাস্তাটা অজগরের মত পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠে যেন কাস্লটায় ফণা মেলেছে; কিন্তু ফণার কথা থাক, উপস্থিত প্রতি বীকে গাড়ি যেন দুচাকার উপর ভর দিয়ে মোড় নিচ্ছে।
হঠাৎ সামনে দেখি বিরাট খোলা গেট। কঁকারের উপর দিয়ে গাড়ি এসে যেখানে দাঁড়ালো তার ওপর থেকে গলা শুনে তাকিয়ে দেখি, ভিলিকিনি থেকে-’
মৌলা শুধাল, ‘ভিলিকিনি মানে?’
চাচা বললেন, ‘ও ব্যালকনি, আমাদের দেশে বলে ভিলিকিনি-সেই ভিলিকিনি থেকে ফন ব্ৰাখেল চেঁচিয়ে বলছে, যোহানেস, ওঁকে ওঁর ঘর দেখিয়ে দাও; গুস্টাফ টেবিল সাজাচ্ছে।’
তারপর আমাকে বললে, ‘ডিনারের পয়লা ঘণ্টা এখুনি পড়বে, তুমি তৈরি হয়ে নাও।’
চাচা বললেন, ‘পরি তো কারখানার চোঙার মত পাতলুম আর গলাবন্ধ কোট, কিন্তু একটা নেভি-ব্ল সুট আমি প্রথম যৌবনে হিম্মৎ সিং-এর পাল্লায় পড়ে করিয়েছিলুম, তার রঙ, তখন বাদামীতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এর পর কোন রঙ নেবে যেন মনঃস্থির করতে না পেরে নি যযৌ ন তস্থে হয়ে আছে। হাতমুখ ধুয়ে সেইটি পরে বেডরুমটার ফেন্সি জিনিসপত্রগুলো তাকিয়ে দেখছি। এমন সময় ব্ৰাখেল আমাকে নক করে ঘরে ঢুকল। আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এ কী? ডিনার-জ্যাকেট পর নি?’
আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘ওসব আমার নেই, তুমি বেশ জানি।’
ফন ব্ৰাখেল বললে, ‘উঁহু, সেটি হচ্ছে না। এ বাড়িতে এসব ব্যাপারে বাবা জ্যাঠা দুজনাই জোর রিচুয়াল মানেন, বড্ড পিটপিটে। তোমাদের পুজোপাজা নেমাজ-টেমাজের মত সসেজ থেকে মাস্টার্ড খসবার উপায় নেই।’ তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললে, ‘তা তুমি এক কাজ কর। দাদার কাবার্ড ভর্তি ডিনার-জ্যাকেট, শার্ট, বো—তারই এক প্রস্থ পরে নাও। এটা তারই বেডরুম; এই কাবার্ডে সাব-কিছু পাবে।’
আমি বললুম, ‘তওবা, তোমার দাদার জামা-কাপড় পরলে কোট মাটি পৌঁছে তোমার ডিনার গাউনের মত টেল করবে।’
বললে, ‘না, না, না। সবাই কি আমার মত দিক-ধেড়েঙ্গে! তুমি চটুপটু তৈরি হয়ে নাও, আমি চললুম।’
চাচা বললেন, ‘কী আর করি, খুললুম কাবার্ড। কাতারে কাতারে কোট পাতলুম বুলিছে-সদ্য প্রেসড, দেরাজ ভর্তি শার্ট, কলার, বো হীরে-বসানো শ্ৰীভ-লিনাক্স, আরও কত কী!
‘মানিকপীরের মেহেরবানি বলতে হবে, জুতোটি পর্যন্ত ফিট করে গেল দস্তানার মত।
মানিকপীরের মেহেরবানি বলতে হবে, জুতোটি পর্যন্ত ফিট করে গেল দস্তানার মত। মাথার মধ্যিখানে সিঁথি জুতসই হবে না, ব্যাকব্রাশ করলেই মানাবে ভাল। আর আশ্চর্য বিশ বছরের দুফাঁক করা চুল বিলকুল বেয়াড়ামি না করে এক লম্ফে তালুর উপর দিয়ে পিছনে ঘাড়ের উপর চেপে বসল, যেন আমি মায়ের গর্ভ থেকে ওই ঢঙের চুল নিয়েই জন্মেছি। আয়নাতে চেহারা দেখে মনে হল, ঠিক জংলীর মত তো দেখাচ্ছে না, তোরা অবিশ্যি বিশ্বাস করবি নে।’
চাচার ন্যাওটা ভক্ত গোসাঁই বললে, ‘চাচা, এ আপনার একটা মস্ত দোষ; শুধু আত্মনিন্দা করেন। ওই যে আপনি মহাভারতের শাস্তিপর্বের কথা বললেন, সেখানেই ভীষ্মদেব যুধিষ্ঠিরকে আত্মনিন্দার প্রচণ্ড নিন্দা করে গেছেন।’
চাচা খুশি হয়ে বললে, ‘হেঁ-হেঁ, তুই তো বললি, কিন্তু ওই পুলিনটা ভাবে সে-ই শুধু লেডি-কিলিং লিটবর। তা সে কথা যাক গে, ঈভনিং-ড্রেসে কালা কেষ্ট সেজে আমি তো শিস দিতে দিতে নোমলাম নীচের তলায়—’
পুলিন শুধালে, ‘স্যার, আপনাকে তো কখনও শিস দিতে শুনি নি, আপনি কি আদপেই শিস দিতে পারেন?’
চাচা বললেন, ‘ঠিক শুধিয়েছিস। আর সত্যি বলতে কী, আমি নিজেই জানি নে, আমি শিস দিতে পারি কি না। তবে কি জানিস, হাফপ্যান্ট পরলে লাফ দিতে ইচ্ছা করে, জোব্বা পরলে পদ্মাসনে বসে থাকবার ইচ্ছা হয়, ঠিক তেমনি ঈভনিং ড্রেস পরলে কেমন যেন সাঁঝের ফষ্টি-নিষ্টি করবার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে, না হলে আমি শিস দিতে যাব। কেন? শিস কি দিয়েছিলুম। আমি, শিস দিয়েছিল বিকাটে সুন্টটা। তা সে কথা যাক।’
ততক্ষণে ডিনারের শেষ ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে। আন্দাজে আন্দাজে ড্রইংরুম পেরিয়ে ঢুকলুম গিয়ে ব্যানকুয়েট-হলে।
কাসলের ব্যানকুয়েট-হল আমাদের চণ্ডীমণ্ডপ-সাইজ হবে। তার আর বিচিত্র কী এবং সিনেমার কৃপায় আজকাল প্রায় সকলেরই তার বিদঘুটে ঢাপ-ঢং দেখা হয়ে গিয়েছে; কিন্তু বাস্তবে দেখলুম। ঠিক সিনেমার সঙ্গে মিলল না। আমাদের দিণী সিনেমাতে চণ্ডীদাস পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে টিনের ছাতওলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন, যদিও বোতাম আর টিন এসেছে ইংরিজি আমলে। আর হলিউড যদি ব্যানকুয়েট-হল দেখায় অষ্টাদশ শতাব্দীর, তবে আসবাবপত্র রাখে সপ্তদশ শতাব্দীর, জাস্ট টু বী অনাদি সেফ সাইড।
ফন ব্ৰাখেলদের কাসল কোন শতাব্দীর জানি না। কিন্তু হলে ঢুকেই লক্ষ্য করলুম, মান্ধাতার আমলের টেবিল-চেয়ারের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর সুখ-সুবিধার সরঞ্জামও মিশে রয়েছে। তবে খাপ খেয়ে গিয়েছে দিব্যি, এদের রুচি আছে কোনও সন্দেহ নেই। এসব অবশ্য পরে খেতে খেতে লক্ষ্য করেছিলুম।