তবু তো ঊৰ্মিলার উল্লেখ রামায়ণে আছে। কিন্তু রামচন্দ্ৰ আর সীতাদেবীর কি আরও বহু অনুচর সখা বান্ধবী পরিচারিকা ছিলেন না, যাদের উল্লেখ আদিকবি আদপেই করেন নি? তাঁদের জীবনে সুখ-দুঃখ উৎসব-ব্যাসন বিরহ-বেদনা মিলনানন্দ সবা-কিছুই ছিল। এতৎসত্ত্বেও আদিকবি তাদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নি। তিনি তো কিছু নিছক কাল্পনিক চরিত্রসৃষ্টি করেন নি, নির্ভেজাল রূপকথাতে যে-রকম হয়। তিনি তো লিখেছিলেন ইতিহাস, অবশ্য রসের গামলায় চুবিয়ে নিয়ে, বাটিক প্রক্রিয়ায় হলেই বা। তাই বলে কি শেষমেশ ওইসব অভাগাদের জ্যান্ত পোতা হল না?
জানি নে, আদিকবিকে এ-ফরিয়াদ জানালে তিনি কী উত্তর দিতেন। যে চন্দ্ৰবৈদ্য শ্ৰীীরামচন্দ্রের নখ-চুল কেটে দিত, যে শুক্লবৈদ্য মা-জননী জনকতনয়ার দুকুল-কঁচুলি কেচে দিত তারা যদি কবিসমীপে নিবেদন করত, তাদেরই বা তিনি ভুলে গেলেন কেন? ঊৰ্মিলার মত নিদেন তাদের নামোল্লেখ করলেই তো তারা অজরামর হয়ে যেত, তবে তিনি কী উত্তর দিতেন?
অত দূরে যাই কেন? কবিগুরু শ্ৰী রবীন্দ্রনাথকে যদি জিজ্ঞেস করা হত, বিনয় এবং ললিতার মত দুটি অত্যুত্তর চরিত্রসৃষ্টি করার পর—হায়, বাংলার সচ্চরিত্র কী দুর্লভ-তিনি সে-দুজনকে পথমধ্যে গুম করলেন কেন, তা হলে তিনি কী উত্তর দিতেন?
আমি বাল্মীকি নই, রবীন্দ্রনাথও নই। এমন কি আমার আপনি গ্রামের প্রধান লেখক নই। আমার গ্রামের শুকুরুন্ন এবং পাগলা মাধ্যাই যে-সব ভাটিয়ালি রচে গিয়েছে, আমার রচনা তাদের সামনে লজ্জায় ঘোমটা টানে। মধাইয়ের একটি ভাটিয়ালির ভুলে-যাওয়া অন্তরা আমি তিরিশ বছর ধরে চেষ্টা করেও পূরণ করতে পারি নি। মাধ্যই আমি একই পাঠশালাতে একই শ্রেণীতে পড়েছি। মাধ্যই ফি বাচ্ছর ফেল মারত, আমি ফাস্ট হাতুম।
তাই, বিশেষ করে তাই, আমি মোক্ষম মনঃস্থির করেছি, আমি আমার সৃজনে যাদের প্রতি অনিচ্ছায় অবজ্ঞা প্রকাশ করেছি, তাদের প্রত্যেককে জ্যান্তগোর থেকে খুঁড়ে তুলে প্রাণবন্ত করব। অর্থাৎ অর্ধমৃত করব। কারণ, আমি শক্তিমান লেখক নই। অদ্যাবধি বৰ্ণিত আমার তাবৎ চরিত্রই জীবন্মত। অতএব এঁরাও অমৃত না হয়ে আমৃত হবেন। কিন্তু আমি তো নিষ্কৃতি পাব আমার জন্মপাপ থেকে।
আমি কাবুলে ছিলাম, তখন সেখানকার ব্রিটিশ লিগেশনের সঙ্গে আমার কণামাত্র হৃদ্যতা হয় নি। ‘দেশে-বিদেশে’ যারা পড়েছেন তারা সে-কথা হয়তো স্মরণ করতে পারবেন। তবে লিগেশনের একজন প্রধান কর্মচারির সঙ্গে আমার অত্যন্ত হাদিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ইনি পেশাওয়ারের খানদানী বাসিন্দা। অতিশয় খাস পাঠান। এঁর চতুর্দশ পুরুষের কেউ কখনও আপন গোষ্ঠীর বাইরে বিয়ে-শাদি করেন নি। পেশাওয়ারের পুলিশ ইনসপেক্টর আহম্মদ আলীর অগ্ৰজ। নাম শেখ মহবুব আলী। ব্রিটিশ লিগেশনে তিনি ছিলেন ওরিয়েন্টাল সেক্রেটারি।
এর মত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ কূটনৈতিক আমি অষ্টকুলাচল সপ্তসমূদ্র পরিক্রম করেও দেখতে পাই নি। আমার বিশ্বাস পাঠান-প্রকৃতি ধরে। কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু এইসব সরল পাঠানদের যাঁরা সর্দার হন, যেমন মনে করুন ইস্পাইয়ের ফকীর, ইংরেজিতে বলে ফকির অব ইপি (Ipi), তাঁদের মত ধুরন্ধর ইহসংসারে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শেখ মহবুব আলীই বলতেন, ‘পাঠানরা হয়। গাড়ল, নয় ঘড়েল। মাঝখানে কিছু নেই। পিগমিজ অ্যান্ড জাইন্টস, নো নির্মেলস’ অধ্যাপক বাগদানফ এবং বেনওয়ার সঙ্গে তাঁর প্রচুর হৃদ্যতা ছিল। বাগদানফ গত হয়েছেন। বেনওয়া আছেন, সৃষ্টিকর্তা তাঁকে শতায় দিন, তাকে জিজ্ঞেস করলেই মহবুব আলীর বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে সত্যাসত্য জানতে পারবেন।
মহবুব আলী বিলক্ষণ জানতেন, লিগেশনের ইংরেজ কর্তাদের সঙ্গে আমার অহিনকুল সম্পর্ক। ওদিকে তিনি যদিও ইংরেজের সেবা করতেন, তবু ভিতরে ভিতরে ওদের তিনি দিল-জান দিয়ে করতেন ঘেন্না, ঘৃণা’ নয়-ঘেন্না। এটা অবশ্য আমার নিছক অনুমান। মহবুব আলীর মত ঝাণ্ডু চাণক্য বাক্য বা আচরণে সেটা প্রকাশ করবেন, সে-চিন্তাও বরাহভক্ষণসম মহাপাপ! বোধ হয় প্রধানত এই কারণেই তিনি আমাকে অত্যন্ত মেহ করতেন। তদুপরি আমি আহমদ আলীর বন্ধু। এবং সর্বশেষ সত্য, আমি বহু-দূরদেশাগত রোগা-পাটকা, নির্বান্ধব, দুনিয়াদারি-বাবদে-বেকুব বাঙালি। এমত অবস্থায় আপনি ভগৱানের শরণ না নিয়ে পাঠানের শরণ নিয়েই বিবেচকের কর্মকরবেন। তবে এ-কথাও বলব, আমি তাঁর শরণ নিই নি। তিনিই আমাকে অনুজরাপে তার হৃদয়ে গ্ৰহণ করেছিলেন।
সে-কথা থাক। আমি আজ তাঁর জীবনী লিখতে বসি নি। আমি লিখতে বসেছি তার স্ত্রীর পরিচারিকা সম্বন্ধে। উল্লসিত পাঠক বিরক্ত হয়ে আমার বাকী লেখাটুকু পড়বেন না, সে-কথা আমি জানি; কিন্তু তার চেয়েও মোক্ষম জানি, আমি যে গুণীজনের মজলিসে দৈবে সৈবে মুখ খোলার অনুমতি পাই, তাদের পৌনে ষোল আনা সহৃদয় সদাশয় জন। তাদের অকৃপণ হৃদয় জন্মদাসী রাজরানী সবাইকে আসন দিতে জানে।
আমার সঙ্গে মহবুব আলীর হৃদ্যতা হওয়ার কয়েকদিন পর আমার ভৃত্য এবং সখা আবদুর রহমান আমাকে যা জানালে তার সারাংশ এই :
মহবুব আলীর পরিবার এবং অন্য এক পরিবারের দুশমনী-লড়াই ক্ষান্ত দেবার জন্য একদা স্থিরীকৃত হয়, দুই পরিবার যেন বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মহবুব আলী এ পরিবারের বড় ছেলে। তাই তাঁকেই বিয়ে করতে হল অন্য পরিবারের বড় মেয়েকে। নবদম্পতি গোড়ার দিকে সুখেই ছিলেন। ইতিমধ্যে বলা নেই-কওয়া নেই, হঠাৎ মহবুব আলীর এক অতি দূর চাচাতো ভাই তাঁর শ্বশুর-পরিবারের ততোধিক দূর এক মামাতো ভাইকে খুন করে। ফলে মহবুব আলীর স্ত্রী পিতৃগণের আদেশানুযায়ী স্বামীগৃহ বৰ্জন করে পিত্ৰালয়ে চলে যান।