ডাহা মিথ্যে বলি কী প্রকারে? আমার বিলক্ষণ জানা ছিল, ফ্রান্স চায় টুরিসটুি সে দেশে এসে আপন গাঁটের পয়সা খরচ করুক, কিন্তু তার বেকারীর বাজারে কেউ এসে পয়সা কামাক এ-অবস্থাটা সে যে করেই হোক রুখবে।
আমি চুপ করে রইলুম দেখে করীম মুহম্মদ মাথা নীচু করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে বললে, ‘রোমার মা আমার মনের সব কথা জানে। দেশের লোক ভাঙচি দেয়, আমি ভেড়া বনে গিয়েছি। এ-কথা বলে-এ-সব শুনে সে তাদের পছন্দ করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে ভোরের ঘুম ভেঙে গেলে দেখি সেও জেগে আছে। তখন আমার কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘তোমার দেশে যদি যেতে ইচ্ছে করে, তবে যাও। আমি একই বাচ্চা দুটোকে সামলাতে পারব।’ এ-সব আরম্ভ হল, নিজে মা হওয়ার পরের থেকে।
‘আজ আপনার কথা তুলে বললে, ‘এ ভদ্রলোকের শরীরে দয়ামায়া আছে। আমার ছেলেমেয়েকে কত আদর করলেন। আমি বললাম, ‘সুজন, তুই জানিস নে, আমাদের দেশের ভদ্রলোক আমাদের কত আপনজন। এই যে ভদ্রলোক এলেন, এর সায়েব (পিতা) আমার বাবাকে ‘পাতী।’ (ছেলে) বলে ডাকতেন। এ দেশের ভদ্রলোক তো গরিবের সঙ্গে কথা কয় না।’ আপনি-ই বলুন, হুজুর’
তার ‘আপনজন’। ওইটুকুই বাকী ছিল।
সুজনই আজ বললে, ‘ওঁর কাছে গিয়ে তুমি হুকুম নাও। উনি যা বলেন তাই হবে।’ এইবার আপনি হুকুম দিন, হুজুর’
আমি হাত জোড় করে বললুম, ‘তুমি আমায় মাপ কর।’
সে আমার পায়ে ধরে বললে, ‘আপনার বাপ-দাদা আমার বাপ-দাদাকে বিপদেআপদে সলা দিয়ে হুকুম করে বাঁচিয়েছেন, আজ আপনি আমায় হুকুম দিন।’
আমি নির্লজের মত পূৰ্ব ঐতিহ্য অস্বীকার করে বললুম, ‘তুমি আমায় মাপ কর।’
অনেক কান্নাকাটি করল। আমি নীরব।
শেষ রাত্রে আমার পায়ে চুমো খেল, আমি বাধা দিলুম না। বিদায় নিয়ে বেরবার সময় দোরের গোড়ায় তার বুক থেকে বেরল, ইয়া আল্লা!’
বাঁশী
তার মানে এ নয়, গুরুদেব নেই, দিনুবাবু নেই, ক্ষিতিমোহনবাবু ক্লাস নেন না। সে তো জানা কথা। কোম্পানির রাজত্ব, মহারানীর সরকারই যখন চলে গেল। তখন এরাও যে শালবীথি থেকে একদিন বিদায় নেবেন, সে তো আমাদের জানাই ছিল; কিন্তু এটা জানা ছিল না যে, আশ্রমের চেহারাটিও গুরুদেব সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।
খুলে কই।
তখন আশ্রমের গাছপালা ঘর-বাড়ি ছিল অতি কম। গাছের মধ্যে শালবীথি, বকুলতলা, আম্রকুঞ্জ আর আমলকি-সারি। বাস। হেথা-হোথা খানসাতেক ডরমিটরি, অতিথিশালা আর মন্দির। ফিরিস্তি কমপ্লিট। তাই তখনকার দিনে আশ্রমের যেখানেই বসো না কেন, দেখতে পেতে দূরদূরান্তব্যাপী, চোখের সীমানা-চৌহদি ছাড়িয়ে-খোয়াইয়ের পর খোয়াই, ডাঙার পর ডাঙা-চতুর্দিকে তেপান্তরী মাঠ। ভোরবেলা সুজ্জিঠাকুরের টিকিট বেরুনোমাত্র সিটিও আমাদের চোখ এড়াতে পারত না। রাত তেরটিার সময় চাদের ডিঙির গলুইখানা ওঠামাত্রই আমরা গেয়ে উঠতুম-চাঁদ উঠেছিল গগনে।’ যাবে কোথায়, চতুর্দিকে বেবাক ফাঁক। আর আজ? গাছে গাছে ছয়লাপ। আম জাম কাঁঠাল খানদানী ঘরানারা তো আছেনই, তার সঙ্গে জুটেছেন যত সব দেশ-বিদেশের নাম-না-জানা কলো নীল হলদে ইয়াইয়া ফুলের গাছ। এখন আশ্রমের অবস্থা কলকাতারই মত। সেখানে পাচতলা এমারত সুজি-চন্দর ঢেকে রাখে, হেথায় গাছপালায়।
ওই দূরদূরান্তে, চোখের সীমানার ওপারে তাকিয়ে থাকা ছিল আমাদের বাই। অবশ্য যারা লেখাপড়ায় ভাল ছেলে তারা তাকাত বইয়ের দিকে, আর আমার মত গবেটরা এক হাত দূরের বইয়ের পাতাতে চোখের চৌহদ্দি বন্ধ না রেখে তাকিয়ে থাকত সেই সুদূর বাটের পানে—তাকিয়ে আছে কে তা জানে। গুরুরা, অর্থাৎ শাস্ত্রীমশাই মিশ্রজী কিছু বলতেন না। তারা জানতেন, বরঞ্চ একদিন শালতলার শালগাছগুলো নর-নরৌ-নিরাঃ, গজ-গজৌ-গজাঃ উচ্চারণ করে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের দ্বারা আর যা হোক, লেখাপড়া হবে না। অন্য ইস্কুল হলে অবশ্য আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হত, কিন্তু তারা দরদ দিয়ে বুঝতেন, আমি বাপমা-খেদানো ছেলে, এসেছি। এখানে, এখান থেকে খেদিয়ে দিলে, হয় যাব ফাঁসি নয় যাব জেলে।
এই দুরের দিকে তাকিয়ে থাকার নেশা আপনাদের বোঝাই কী প্রকারে? আমি নিজেই যখন সেটা বুঝে উঠতে পারি নি, তখন সে চেষ্টা না করাই শ্রেয়। তবে এইটুকু বলতে পারি, এ-নেশাটা সাঁওতাল ছোঁড়াদের বিলক্ষণ আছে। আকাশের সুদূর সীমানা খুঁজতে গিয়ে তারা বেরিয়েছিল সাজে, তারপর অন্ধকার রাতে, পথ হারিয়ে একই জায়গায় সাত শো বার চক্কর খেয়ে পেয়েছে অক্কা। বুড়ো মাঝিরা বলে, পেয়েছিল ভুতে। সে-কথা। পরে হবে।
আমি শান্তিনিকেতনে আসি ১৯২১ সনে। গাঁইয়া লোক। এখানে এসে কেউ বা নাচে ভরতনৃত্যম, কেউ বা গায় জয়জয়ন্তী, কেউ বা লেখে মধুমালতী ছন্দে কবিতা, কেউ বা গড়ে নব নটরাজ, কেউ বা করে বাতিক, লেদার-ওয়ার্ক, ফ্রেস্কো, সন্টুককো, উড-ওয়ার্ক, এচিং, ড্রাই-পয়েন্ট, মেদজোঁ-টিনটু আরও কত কী। এক কথায় সবাই শিল্পী, সবাই কলাবৎ।
আমারও বাসনা গেল—শিল্পী হব। আর্টিস্ট হব। ওদিকে তো লেখাপড়ায় ডডনং, কাজেই যদি শিল্পীদের গোয়ালে কোন গতিকে ভিড়ে যেতে পারি। তবে সমাজে আমাকে বেকার-বাউণ্ডুলে না বলে বলবে শিল্পী, কলাবৎ, আরতিসৎ।
অথচ আমার বাপ-পিতামোর চোদ্দপুরুষ, কেউ কখনও গাওনা-বাজনার ছায়া মাড়ানো দূরে থাক, দূর থেকে ঝঙ্কার শুনলেই রামদা নিয়ে গাওয়াইয়ার দিকে হানা দিয়েছেন। আমরা কট্টর মুসলমান। কুরানে না হোক আমাদের স্মৃতিশাস্ত্ৰে গাওনা-বাজনা বারণ, বাঁদর-ওলার ডুগডুগি শুনলে আমাদের প্রচিত্তির করতে হয়। আমার ঠাকুদ্দদার বাবা নাকি সেতারের তার দিয়ে সেতারীকে ফাঁসি দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন।