‘আমাকে খেতে দিল গরম দুধের সঙ্গে। কাঁচা আণ্ডা ফেটে নিয়ে। বেহুঁশির ওত্তেজ্ঞ কী খেয়েছি জানি নে, হুজুর, কিন্তু হাঁশের পর দাওয়াই হিসেবেও আমি শরাব খাই নি। তাই ‘বরান্দি’ টা বাদ দিল।
রাতে খেতে দিল রুটি আর মাংসের হালকা ঝোল। চারটি ভাতের জন্য আমার জন্য তখন কী আকুলি-বিকুলি করেছিল। আপনাকে কখনও সমঝাতে পারব না, হুজুর।’
জাহাজের খালাসীদের স্মরণে আমি মনে মনে বললুম, সমঝাতে হবে না।’ বাইরে বললুম, ‘তারপর?’
একটুখানি ভেবে নিয়ে বললে, ‘সব কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে সায়েব। আর কী-ই বা হবে বলে? ও আমাকে খাওয়ালে পর্যালে, আশ্রয় দিলে-বিদেশেবিভুইয়ে সেখানে আমার জেলে গিয়ে পাথর ভাঙার কথা-এ সব খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে না বললে কি তার দাম কমে যাবে!
‘দাম কমবে না বলেই বলছি হুজুর, সুজন নার্সের কাম করে-’
আমি শুধালুম, কী নাম বললে?’
একটু লজ্জা পেয়ে বললে, ‘আমি ওকে সুজন বলে ডাকি-ওদের ভাষায় সুজান।’
বুঝলুম ওটা ফরাসি Suzzanne, এবং আরও বুঝলুম, যো-জাতের লোক আমাদের দেশে মরমিয়া ভাটিয়ালি রচেছে তাদেরই একজনের পক্ষে নামের এটুকু পরিবর্তন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কিছু কঠিন কর্ম নয়। অতখানি স্পর্শকাতরতা এবং কল্পনাশক্তি ওদের আছে।
আমি শুধালুম, ‘তার পর কী বলছিলে?’
বললে, ‘সুজন নার্সের কাম করে আমাকে যে এক বছর পুষেছিল তখন আমি তার বাড়ির কাজ করেছি। বেচারীকে নিজের রান্না নিজেই করতে হত—হাসপাতাল থেকে গতর খাটিয়ে ফিরে আসার পর। আমি পাক-রসুই করে রাখতাম। শেষ দিন পর্যন্ত সে আপত্তি করেছে, কিন্তু আমি কান দিই নি।’
আমি শুধালুম, কিন্তু তোমার পাড়ার পুলিশ কিছু গোলমাল করলে না?’
একটুখানি মাথা নিচু করে বললে, ‘অন্য দেশের কথা জানি না হুজুর, কিন্তু এখানে মহব্বতের ব্যাপারে। এরা কোন রকম বাগড়া দিতে চায় না। আর এরা জানত যে ওর বাড়িতে ওঠার এক মাস পরে ওকে আমি বিয়ে করি।
‘কিন্তু হুজুর, আমার বড় শরাম বোধ হত; এ যে ঘর-জামাই হয়ে থাকার চেয়েও খারাপ। কিন্তু করিই বা কী?
‘আল্লাই পথ দেখিয়ে দিলেন।
‘সুজন আমাকে ছুটি-ছাঁটার দিনে সিনেমায়-টিনেমায় নিয়ে যেত। একদিন নিয়ে গেল এক মস্ত বড় মেলাতে। সেখানে একটা ঘরে দেখি নানা দেশের নানা রকম তাত জড় করে লোকজনকে দেখানো হচ্ছে তাতগুলো কী করে চালানো হয়, সেগুলো থেকে কী কী নকশার কাপড় বেরয়। তারই ভিতর একটা দেখতে গেলাম, অনেকটা আমাদের দেশেরই তাঁতের মত।
‘আমার বাপ-ঠাকুরদা জেলার কাজ করেছে, ফসল ফলিয়েছে, দরকার হলে লাঠিও চালিয়েছে।
অনেক ইতি উতি কিন্তু-কিন্তু করে সুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাঁতের দাম কত?” বুঝতে পারল, ওতে আমার শখ হয়েছে। ভারি খুশি হল, কারণ আমি কখনও কোন জিনিস তার কাছ থেকে চাইনি। বললে, ‘ওটা বিক্রির নয়, কিন্তু মিস্ত্রী দিয়ে আমাকে একটা গড়িয়ে দেবে।
‘ও দেশে ধূতি, শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা কিনবে কে? আমি বানালাম স্কার্য, কৰ্ম্মফর্টার। দিশী নকশায়। প্রথম নকশায় আধখানা ফুটতে না ফুটতেই সুজনের কী আনন্দ! স্কার্ফ র্তত থেকে নামাবার পূর্বেই সে পাড়ার লোক জড় করে বসেছে, আজগুবী এক নূতন জিনিস দেখাবে বলে। সবাই পাই-পই করে দেখলে, অনেক তারিফ করলে। সুজনের ডবল আনন্দ, তার স্বামী নিষ্কৰ্মা ভবঘুরে নয়। একটা হুনুরী, গুণী লোক।
‘গোড়ার দিকে পাড়াতে, পরে এখানে—সেখানে বিস্তর স্কার্ফ বিক্রি হল। বেশ দু পয়সা আসতে লাগল। তারপর এখানকার এক তাঁতীর কাছে দেখে এলাম কী করে রেশমের আর পশমের কাজ করতে হয়। শেষটায় সুজন নিয়ে এল আমার জন্য বহুত কেতাব, সেগুলাতে শুধু কাশ্মীরী নকশায় নয়, আরও বহুত দেশের বহুত রকম-বেরকমের নকশাও আছে। তখন যা পয়সা আসতে লাগল তারপর আর সুজনের চাকরি না করলেও চলে। সেই কথা বলতে সে খুশির সঙ্গে রাজী হল। শুধু বলল, যদি কখনও দরকার হয় তবে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে পারবে। রোমা তখন পেটে। সুজন সংসার সাজাবার জন্য তৈরি।
‘আপনি হয়তো ভাবছেন আমি কেন বুড়ির কথা পাড়ছি নে। বলছি, হুজুর, রাতও অনেক ঘনিয়ে এসেছে, আপনি আরাম করবেন।
‘আপনি বিশ্বাস করবেন না, দু পয়সা হতে সুজন বললে, ‘তোমার মাকে কিছু পাঠাবে না?’ আমি আগের থেকেই বন্দরের ইমানদার লোক খুঁজছিলাম। রোমার মাই বললে, ব্যাঙ্ক দিয়েও নাকি দেশে টাকা পাঠানো যায়।
‘মাসে মাসে বুড়িকে টাকা পাঠাই। কখনও পঞ্চাশ কখনও একশো। ঢেউপাশাতে পঞ্চাশ টাকা অনেক টাকা। শুনি বুড়ি টাকা দিয়ে গায়ের জন্য জুম্মা-ঘর বানিয়ে দিয়েছে। খেতে-পরতে তো পারছেই।
টাকা দিয়ে অনেক কিছুই হয়, দেশে বলে, টাকার নাম জয়রাম, টাকা হইলে সকল কাম—কিন্তু হুজুর, টাকা দিয়ে চোখের পানি বন্ধ করা যায় না। একথা আমি খুব ভাল করেই জানি। বুড়িও বলে পাঠিয়েছে, টাকার তার দরকার নেই, আমি যেন দেশে ফিরে যাই।
‘আমার মাথায় বাজ পড়ল, সায়েব; যেদিন খবর নিয়ে শুনলাম, দেশে ফিরে যাওয়া মোটেই কঠিন নয়, কিন্তু ফিরে আসা অসম্ভব। আমি এখন আমার মহল্লার মুরুর্কীদের একজন। থানার পুলিশের সঙ্গেও আমার বহুত ভাব-সাব হয়েছে। আমার বাড়িতে প্রায়ই তারা দাওয়াত-ফাওয়াত খায়। তারা প্যারিস থেকে পাকা খবর আনিয়েছে, ফিরে আসা অসম্ভব। মুসাফির হয়ে কিংবা খালাসী সেজে পালিয়ে এলেও প্যারিসের পুলিশ এসে ধরে নিয়ে দেশে চালান দেবে। এমন কি তারা আমাকে বারণ করেছে। আমি যেন ওই নিয়ে বেশি। নাড়াচাড়া না করি। প্যারিসের পুলিশ যদি জেনে যায় আমি বিনা পাসপোর্টে এ দেশে আছি তা হলে তারা আমাকে মহল্লার পুলিশের কদর দেখাবে না। এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। আপনি কী বলেন, হুজুর?’