বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘এ কী আপদ!’
লজ্জা পেয়ে বললে, ‘হুজুরের বোধ হয় অস্বস্তি বোধ হচ্ছে সকলের সামনে আমার সঙ্গে কথা বলতে! তা হলে, দয়া করে আপনার কামরায়-’
আমি উম্মা প্রকাশ করে বললুম, ‘আদপেই না।’ এবং এ অবস্থায় শ্ৰীহট্টের প্রত্যেক সুসন্তান যা বলে থাকে, সেটাও জুড়ে দিলুম, ‘আমি কি এ ঘরে মাগনা’ বসেছি, না। এদের জমিদারির প্রজা। কিন্তু তুমি এ-রকম করছি কেন? তুমি কি আমার কেনা গোলাম নাকি? চল উপরে।’
সেখানে মেঝেতে বসে একগাল হেসে বললে, ‘কেনা গোলাম না তো কী? আমার চাচাতো ভাই আছমত ছিল আপনাদের বাসার চাকর। এখন আমি মাকে যখন টাকা পাঠাই সেটা যায় আপনার সাহেবের (পিতার) নামে। আমি আপনাদের বাসায় গিয়েছি, আপনার আম্মা আমাকে চীনের বাসনে খেতে দিতেন। আমি আপনাকে চিনি হুজুর।’
আমি শুধালুম, ‘বউকে ফাঁকি দিয়ে এসেছ?’
বলল, ‘না। হুজুর। খেতে বসে রোমার মা আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললে। আপনাকে সে রাত্রে খেতে বলতে পারেনি তার জন্য দুঃখ করলে। ও সত্যি বললে যে, আপনাতে আমাতে বাড়িতে নিরিবিলি কথাবার্তা হবে না, তাই আপনাকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে নি। আসবার সময় বললে, ‘উনি যা বলেন তাই হবে’।’
আমি শুধালুম, ‘তবু না বললে তুমি আসতে না?’
কিছুমাত্র না ভেবে বললে, ‘নিশ্চয়ই আসতাম। তবে ওকে খামক কষ্ট দিতে চাই নে বলে না-বলে আসতুম।’ বলে। লাজুক বাচ্চাটির মত ঘাড় ফেরালে। আমার বড় ভাল লাগল।
আমি শুধালুম, ‘আমি তোমাদের বাড়িতে বলতে গিয়েছিলুম তোমরা জানলে কী করে? আমি শুনেছি, তোমার বউ দেশের লোককে তাড়া লাগায়। আমাকে লাগাল না। কেন?’
যেন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, তা একটু-আধটু লাগায় বটে, হুজুর, ওরা যে বলে বেড়ায় আমাকে রোমার মা ভ্যাড়া বানিয়ে রেখেছে সে-খবরটা ওর কানে পৌঁছেছে। তাই গেছে সে ভীষণ চটে। আসলে ও বড় শাস্তপ্রকৃতির মেয়ে, ঝগড়া-কাজিয়া করে কয় আদপেই জানে না।’
আর মানুষকে কি কখনও ভ্যাড়া বানানো যায়? কামরূপে না, কোনখানেই না।’
‘আপনি তা হলে সব কিছু শুনে বিবেচনা করুন, হুজুর।
‘সতেরো বছর বয়সে আমি আর-পাঁচজন খালাসীর সঙ্গে নামি এই বন্দরে। কেন জানি নে, হুজুর, হঠাৎ পুলিশ লাগালে তাড়া। যে যার জান নিয়ে যেদিকে পারে দিলে ছুটি। আমি ছিটকে পড়লাম শহরের এক অজানা কোণে। জাহাজ আর খুঁজে পাই নে। শীতের রাতে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষটায় এক পোলের নীচে শুয়ে পড়লাম জিরাব বলে। যখন ইশ হল তখন দেখি, আমি এক হাসপাতালে শুয়ে। জুরে সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে-দেশে আমার ম্যালেরিয়া হত। তারপর ক-দিন কাটল হাঁশে আর বেষ্ট্ৰশে তার হিসেব আমি রাখতে পারি। নি। মাঝে মাঝে আবছা আবছা দেখতে পেতাম ডাক্তাররা কী সব বলাবলি করছে। সেরে উঠে পরে শুনতে পাই ওদের কেউ কখনও ম্যালেরিয়ায় রোগীর কড়া জ্বর দেখে নি বলে সবাই ভড়কে গিয়েছিল। আর জুরের ঘোরে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম। একটি নাসকে। সে আমায় জল খাইয়ে রুমাল দিয়ে ঠোঁটের দু-দিক মুছে দিত। একদিন শেষরাতে কম্প দিয়ে এল আমার ভীষণ জুর। নার্স সব কখানা কম্বল চাপা দিয়ে যখন কম্প থামাতে পারল না। তখন নিজে আমাকে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইল। দেশে মা যেরকম জড়িয়ে ধরত ঠিক সেই রকম। তারপর আমি ফের বেহুঁশি।
কিন্তু এর পর যখন জুর ছাড়ল তখন আমি ভাল হতে লাগলাম। শুয়ে শুয়ে দেশের কথা, মায়ের কথা ভাবি আর ওই নার্সটিকে দেখলেই আমার জানটা খুশিতে ভরে উঠত। সে মাঝে মাঝে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিত। আর ওদের ভাষায় প্রতিবারে একই কথা বলত। আমি না বুঝেও বুঝতাম, বলছে, ভয় নেই, সেরে উঠবে।
‘তারপর একদিন ছাড়া পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম বন্দরের দিকে। সেখানে জাতভাইয়ের সঙ্গে দেখা। অন্য এক জাহাজের—আমাদের জাহাজ তো কবে ছেড়ে দিয়েছে। সে সব কথা শুনে বললে-’ভাগো ভাগো, এখুনি ভাগো। তোমার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে, তুমি জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছ। ধরতে পারলেই তোমাকে পুলিশ জেলে দেবে।’
‘ক বছর? কে জানে? এক হতে পারে, চোদ্দও হতে পারে। আইন-কানুন হুজুর আমি তো কিছুই জানি নে।
‘কিন্তু যাই ই বা কোথায়? যে দিকে তাকাই সে-দিকেই দেখি পুলিশ। খানা-পিনার কথা তুলব না হুজুর, সে তখন মাথায় উঠে গিয়েছে। কিন্তু রাতটা কাঁটাই কোথায়?
‘শেষটায় শেষ অগতির গতির কথা মনে পড়ল। হাসপাতাল ছাড়ার সময় সেই নার্সটি আমার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে দিয়েছিল একখানা চিরকুট। তখনও জানতাম না, তাতে কী লেখা। যাকে দেখাই সে-ই হাত দিয়ে বোঝায়-আরও উত্তর দিকে যাও। শেষটায় একজন লোক আমাকে একটা বড় বাড়ির দেউড়ি দেখিয়ে চলে গেল।
সেখানে ঘণ্টাতিনেক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোঁদের পুলিশ আমাকে সওয়াল করতে লাগল। হাসপাতালে দু’মাস ওদের বুলি শুনে শুনে যেটুকু শিখেছিলাম তার থেকে আমেজ করতে পারলাম, ওর মনে সন্দ হয়েছে, আমি কী মতলবে ওখানে দাঁড়িয়ে আছি—আর হবেই না কেন? বুঝলাম রাশিয়তে জেল আছেই। মনে মনে বললাম, কী আর করি, একটা আশ্রয় তো চাই। জেলই কবুল। চাচা মামু অনেকেই তো লাঠালাঠি করে গেছেন, আমি না হয় না করেই গেলাম।
‘এমন সময় সেই নার্সটি এসে হাজির। পুলিশকে কী একটা সামান্য কথা বলে আমাকে হাতে ধরে নিয়ে গেল তার ছোট্ট ফ্ল্যাটে-পুলিশ যেভাবে তাকে সেলাম করে রাটি না কেড়ে চলে গেল তার থেকে আন্দেশ করলাম, পাড়ার লোক ওকে মানে।