মাদাম ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইনি তোদের বাবার দেশের লোক। ছেলেটি তৎক্ষণাৎ আমার কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। আমি আদর করতেই বলে উঠল, ল্যাদ, সে ত্য প্যাই ঈ ফাতাস্তিক নেসপা?–অর্থাৎ ভারতবর্ষ ফেনটাসটিক দেশ, সে দেশের অনেক ছবি সে দেখেছে, ভারি ইচ্ছে সেখানে যায়, কিন্তু বাবা রাজী হয় না–অঁকল (কাকা), আমাকে নিয়ে চল,’ ওই ধরনের আরও কত কী!
আমি আবার প্রমাদ গুনলুম। কথাটা যে-দিকে মোড় নিচ্ছে তাতে না মাদাম পিস্তল বের করে।
অনুমান করতে কষ্ট হল না, আলোচনাটা মাদামের পক্ষেও অপ্রিয়। তিনি শুধালেন, ‘মসিয়োর রুচি কিসে-চা, কফি, শোকালো (কোকো), কিংবা—
আমি বললুম, অনেক ধন্যবাদ।’
তবু শেষটায় কফি বানাতে উঠে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে করীম মুহম্মদ উঠে দাঁড়িয়ে সিলেটি কায়দায় পা ছুঁয়ে সেলাম করতে গেল। বুঝলুম, ওর চোখ ঠিক ধরতে পেরেছে। আমি সিলেটিতেই বললুম, ‘থাক থাক।’
যে ভাবে তাকাল তার থেকে বুঝতে পারলুম, সে পায়ের ধুলো নিতে যাচ্ছে না, সে পায়ের ধুলো নিচ্ছে তার দেশের মুরুর্কীদের যার ভিতর রয়েছেন আমার পিতৃ-পিতামহও, সে তার মাথায় ঠেকাচ্ছে দেশের মাটির ধুলো, তার মায়ের পায়ের ধুলো। আমি তখন বারণ করবার কে? আমার কী দম্ভ! সে কি আমার পায়ের ধুলো নিচ্ছে?
শুধু একটি কথা জিজ্ঞেস করলে, ‘হুজুর কোন হোটেলে উঠেছেন?? আমি নাম বললুম। স্টেশনের কাছেই।
আমি বললুম, ‘বস।’ সে আপত্তি জানাল না। তারপর দুজনই আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম। কারও মুখে কোনও কথা নেই।
এমন সময়ে মেয়েটি কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার গালে চুমো খেয়ে বললুম, মধু।’
বাপ হেসে বললে, ‘এবারে জন্মদিনে ওকে যখন জিজ্ঞেস করলাম ও কী সওগাত চায় তখন চাইলে ইন্ডিয়ান বর। আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের কথা পাড়লেই ঘেমে ওঠে।’
তার গলায় ঈষৎ অনুযোগের আভাস পেয়ে আমি বললুম, মনে মনে নিশ্চয়ই পুলকিত হয়। আর আসলে তো এসব বাড়ির দেশের দশের আবহাওয়ার কথা। এরা পেটের অসুখের কথা বলতে লজ্জা পায়, আমরা তো পাই নে।’
ইতিমধ্যে কফি এল। মাদাম বললেন, ‘মেয়ের নাম সারা (Sara ইংরিজিতে Sarah), ছেলেটির নাম রোমা।’ বাপ বললে, ‘আসলে রহমান।’ বুঝলুম লোকটার বুদ্ধি আছে। সারা’ নাম মুসলমান মেয়েদেরও হয়। আর রহমানের উচ্চারণ ফরাসিতে মোটামুটি রোমাই।
বেচারী মাদাম। কফির সঙ্গে দিলে দুনিয়ার যত রকমের কেক, পেসট্রি, গাতো, ব্রিয়োশ, ক্রোয়াসাঁ, বুঝলুম, পাড়ার দোকানের যাবতীয় চায়ের আনুষঙ্গিক ঝেঁটিয়ে কিনে আনিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, প্যাঁজের ফুলুরিও। মাদাম বললে, ‘ম মারি–ইল লেজ এম।’ আমার স্বামী এগুলো ভালবাসেন।
ছেলেটি চেঁচিয়ে বললে, ‘মোয়া ওসি, মামি’—আমিও মা।
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘মোয়া ওসি, মনোকলি’–আমিও চাচা।
আমি আর সইতে পারলুম না। কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি সে-সম্বন্ধে আমি সমস্তক্ষণ সচেতন ছিলুম। রোমার ভারত যাওয়ার ইচ্ছে, সারার ভারতীয় বরের কামনা এসব আমায় যথেষ্ট কাবু করে এনেছিল, কিন্তু ফ্রান্সের সেরা সেরা মিষ্টির কাছে ফুলুরির প্রশংসা—এ কোন দেশের রক্ত চেঁচিয়ে উঠে আমাকে একেবারে অভিভূত করে দিলে?
আমি দাঁড়িয়ে উঠে বললুম, ‘আজ তবে আসি। বার্লিনের টিকিট আমার এখনও কাটা হয় নি। সেটা শেষ না করে মনে শাস্তি পাচ্ছি নে।’
সবাই চোঁচামেচি করতে লাগল। ছেলেটা বললে, ‘কিন্তু আপনি তো এখনও আমাদের অ্যালবাম দেখেন নি।’ বলেই কারও তোয়াক্কা না করে অ্যালবাম। এনে পাতার পর পাতা উল্টে যেতে লাগল। ‘এই তো বাজান (বাবা + জান, সিলেটিতে বাজান), কী অদ্ভুত বেশে এদেশে নেমেছিলেন, এটার নাম লুঙ্গি না বাজান? কিন্তু ভারি সুন্দর, আমায় একটা দেবে, অকল-চাচা? বাবারটা আমার হয় না, (মাদাম বলেন, ‘চুপা’, ছেলেটা বললে, ‘পার্দো’ অর্থাৎ অর্থাৎ বে-আদবি মাফ কর) এটা মা, বিয়ের আগে, ক্যাল এ জনি, কী সুন্দর-’
ওঃ!
গুষ্টিসূদ্ধ আমাকে ট্রাম-টার্মিনাসে পৌঁছে দিতে এল। পৃথিবীর সর্বত্রই সর্বমহল্লা থেকে অন্তত একটা ট্রাম যায়-বিনা চেঞ্জে-স্টেশন অবধি। বিদেশীকে সেই ট্রামে বসিয়ে দিলেই হল। মাদাম কিন্তু তবু পইপই করে কন্ডাকটরকে বোঝালেন, আমাকে যেন ঠিক স্টেশনে নাবিয়ে দেওয়া হয়। মসিয়ো এ (ত্) এাত্রাজের, স্ট্রেঞ্জার, বিদেশী, (তারপর ফিশ ফিস করে)
ফরাসি বলতে পারেন না।–’
মনে মনে বড় আরাম বোধ করলুম। যাক, তবু একটি বুদ্ধিমতী পাওয়া গেল, যে
আমার ফরাসি বিদ্যের চৌহদি ধরতে পেরেছে।
মাদাম, কাচ্চাব্বাচ্চারা চোঁচালে, ‘ও রভোয়ার।’ করীম মুহম্মদ বললে, ‘সেলাম সায়েব।’
আহারাদির পর হোটেলের লাউঞ্জে বসে ওপরে ঘুমুতে যাব-যাচ্ছি, যাক-যাচ্ছি করছি, এমন সময় করীম মুহম্মদ এসে উপস্থিত। পরনে লুঙ্গি কম্ফর্টার।
ইয়োরোপের কোনও হোটেলে ঢুকে আপনি যদি লাউঞ্জে জুতো খুলতে আরম্ভ করেন, তবে ম্যানেজার পুলিশ কিংবা অ্যামবুলেনস ডাকবে। ভাববে আপনি খেপে গেছেন। এতত্ত্বটি নিশ্চয়ই করীমের জানা; তাই তার সাহস দেখে অবাক মানলুম। বরঞ্চ আমিই ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি তাকে বারণ করলুম। কিন্তু তারপর বিপদ, সে চেয়ারে বসতে চায় না। বুঝতে পারলুম, পরিবারের বাইরে এসে সে ঢেউপাশায় ‘কেরীম্যা’ হয়ে গিয়েছে। জুতো পরবে না; চেয়ারে বসবে না, কথায় কথায় কদমবোস-পদচুম্বন-করতে চায়।