বললে, ‘সেই গ্রামের করীম মুহম্মদের কথাই আপনাকে বলতে এসেছি, হুজুর। করীম ব্যাটা মহাপাষণ্ড, চোদ্দ বছর ধরে মোর্সই (মার্সেলেস) বন্দরে পড়ে আছে। ওদিকে বুড়ি মা কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো কানা করে ফেলেছে, কত খবর পাঠিয়েছে। হা-কিছুতেই দেশে ফিরবে না। চিঠিপত্রে কিছু হল না দেখে আমরা বন্দরে নেমে তার বাড়ি গিয়েছিলাম, তাকে বোঝাবার জন্য। ব্যাটার বউ এক রেঙখোকী, এমন তাড়া লাগালে যে আমরা পাঁচজন মন্দা মানুষ প্রাণ বাঁচিয়ে পালাবার পথ পাই নে। তবে শুনেছি, মেয়ে-মানুষটা প্রথম প্রথম নাকি তার ভাতারের দেশের লোককে আদর-কদর করতে। যবে থেকে বুঝেছে আমরা তাকে ভাঙচি দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার তালে আছি, সেই থেকে মারমুখে খাণ্ডার হয়ে আছে।’
আমি বললুম, ‘তোমরা পাঁচজন লেঠেল যে-কর্মটি করতে পারলে না, আমি সেইটে পারব? আমাকে কি গামা পাহলওয়ান ঠাউরেছ?’
বললে, ‘না, হুজুর, আপনাকে কিছু বলবে না। আপনি সুট টাই পরে গেলে ভাববে আপনি এসেছেন। অন্য কাজে। আমাদের লুঙ্গি আর চেহারা দেখেই তো বেটি টের পেয়ে যায়, আমরা তার ভাতারের জাত-ভাই। আপনি হুজুর, মেহেরবানি করে ‘না’ বলবেন না, আপনার যে কতখানি দয়ার শরীর সে-কথা বেবাক খালাসী জানে বলেই আমাকে তারা পাঠিয়েছে। আপনার জন্যই আজ আমরা ভাত-’
আমি বললুম, ‘বাস বাস, হয়েছে হয়েছে। কাপ্তান পাকড়ে নিয়ে শুধাল বলেই তো সব কথা বলতে হল। না হলে আমার দায় পড়েছিল।’
বললে, ‘তওবা, তওবা। শুনলেও গুনা হয়। তা হুজুর, আপনি দয়া করে আর ‘না।’ বলবেন না। আমি বুড়ির হয়ে আপনার পায়ে ধরছি।’
বলে সত্য-সত্যই আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরল। আমি হাঁ হাঁ, কর কী, কর কী’ বলে পা দুটো ছাড়ালুম।
ওরা আমাকে যা কোর্মা-পোলাও খাইয়েছে তার বদলে এ-কাজটুকু না করে দিলে অত্যস্ত নেমকহারামি হয়, ওদিকে আবার এক ফরাসিনী দজল। বঁটা কিংবা ভাঙা ছাতা নয়, পিস্তল হতে নিয়ে তাড়া লাগানোই ওদের স্বভাব।
কোন মুর্থ বেরয় দেশভ্রমণে! কত না বাহান্ন রকমের যত সব বিন্দকুট খুদার খামকা গেরো!
বন্দরে নেমে দেখি, পরদিন ভোরের আগে বার্লিন যাবার সোজা ট্রেন নেই। ফাঁকি দিয়ে গেরোটা কাটাব তারও উপায় আর রইল না। দুজন খালাসী নেমেছিল সঙ্গে–ঢেউপাশার নাগরের বাড়ি দেখিয়ে দেবে বলে। তাদের পরন লুঙ্গি, গায়ে রঙিন শার্ট, মাথায় খেজুর-পাতার টুপি, পায়ে বুট, আর গলায় লাল কৰ্ম্মফর্টার। ওই কৰ্ম্মফর্টারটি না থাকলে ওদের পোশাকী সজ্জাটি সম্পূর্ণ হয় না–বাঙালির যে-রকমী রেশমী উড়নি।
দুই হুজুরে আমাকে ‘হুজুর’ ‘হুজুর’ করতে করতে নিয়ে গেল বন্দরের এক সাবার্বে। সেখানে দূরের থেকে সন্তৰ্পণে ছোট্ট একটি ফুটফুটে বাড়ি দেখিয়ে দিয়েই তারা হাওয়া হয়ে গেল। আমি প্রমাদ গুনতে গুনতে এগলুম। পানির পীর বদর সায়েবকে এখন আর স্মরণ করে কোনও লাভ নেই। তাই সৌন্দরবনের ডাঙার বাঘের পীর গাজী সাহেবের নাম মনে মনে জপতে লািগলুম-যাচ্ছি বাঘিনীরই সঙ্গে মেলাকাত করতে।
বেশ জোরেই বোতাম টিপলুম—চোরের মায়ের বড় গলা।
কে বলে খাণ্ডার? দরাজ খুলে একটি ত্রিশ-বত্ৰিশ বছরের অতিশয় নিরীহ চেহারার গো-বেচারী যুবতী এসে আমার সামনে দাঁড়াল। ‘গো’-বেচারী বললুম তার কারণ আমাদের দেশটা গরুর। আসলে কিন্তু ওদের দেশের তুলনা দিয়ে বলতে হয়, ‘মেরি হ্যাড এ লিট্ল ল্যাম’–এর ভেড়াটি যেন মেরির রূপ নিয়ে এসে দাঁড়াল। ওদিকে আমি তৈরি ছিলুম পিস্তল, মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেডের জন্য। সামলে নিয়ে জাহাজে যে চোস্ত ফরাসিস আদব-কায়দার তালিম পেয়েছিলেন, তারই অনুকরণে মাথা নিচু করে বললুম, ‘আমি কি মাদম মা-ও মের (মুহম্মদের ফরাসি উচ্চারণ) সঙ্গে আলাপ করে আনন্দ লাভ করেছি?’ ইচ্ছে করেই কোন দিশী লোক সেটা উল্লেখ করলুম না। ফরাসিরা চীনা ভারতীয় এবং আরবীদের মধ্যে তফাত করতে পারেন না। আমরা যে রকম চীনা, জাপানী এবং বর্মী সবাইকে একই রূপে দেখি। চেহারা দেখে বুঝলুম মাদাম গুবলেট করে ফেলেছেন। বললেন, ‘আঁদ্রে (প্রবেশ করুন), মসিয়ো।’
ভরসা পেয়ে বললুম, মসিয়ো মাওমের সঙ্গে দেখা হতে পারে কি?’
‘অবশ্য!’
ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি, শেখ করীম মহম্মদ উত্তম ফরাসি সুট পরে টেবিলের উপর রকমারি নকশার কাপড়ের ছোট ছোট টুকরোর দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে।
আমি ফরাসিতে বললুম, ‘আমি মাদ্রাজ থেকে এসেছি, কাল বার্লিন চলে যাব। ভাবলুম, আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই।’ সে যে ভারতীয় এবং তার ঠিকানা জানলুম কী করে সে-কথা ইচ্ছে করেই তুললুম না।
ভাঙা-ভাঙা ফরাসিতে অভ্যর্থনা জানাল।
আমি ইচ্ছে করেই মাদামের সঙ্গে কথাবার্তা জুড়ে দিলুম। মার্সেলেস যে কী সুন্দর বন্দর, কত রকম-বেরকমের রেস্তোরাঁ-হোটেল, কত জাত-বেজাতের লোক কতশত রকমের বেশভূষা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আরও কত কী!
ইতিমধ্যে একটি ছেলে আর মেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল।
কী সুন্দর চেহারা! আমাদের করীম মুহম্মদ কিছু নটবরটি নন, তার বউও ফরাসি দেশের আর পাঁচটা মেয়ের মতো, কিন্তু বাচ্চা দুটির চেহারায় কী অপূর্ব লাবণ্য! কে বলবে এরা খাঁটি স্প্যানিশ নয়? সে দেশের চিত্রকরদের অয়েলপেন্টিঙে আমি যে রকম দেবশিশুর ছবি দেখেছি। ইচ্ছে করে, কোলে নিয়ে চুমো খাই। কিন্তু আশ্চর্য লাগল, পূর্বেই বলেছি, বাপের চেহারা তো বাংলা দেশের আর পাঁচজন হাল-চাষের শেখের যা হয় তা-ই, মায়ের চেহারাও সাধারণ ফরাসিনীর মত। তিন আর তিনে তা হলে সব সময় ছয় হয় না। দশও হতে পারে—ইনিফিনিটি অর্থাৎ পরিপূর্ণতাও হতে পারে। প্রেমের ফল তা হলে অঙ্কশাস্ত্রের আইন মানে না!