শুনে সে তো মহা উত্তেজিত। আমি অবাক! ছুরি কাঁটা টেবিলে রেখে, মিলিটারি গলায় বাঁজ লাগিয়ে বলতে শুরু করলে, ‘এ ভারি অন্যায়, অত্যন্ত অবিচার, ইনুই-অনহার্ড-অব–ফাতাস্তিক-ফেনটাসটিক আরও কত কী!’
আমি বললুম, ‘রোস রোস। এত গরম হচ্ছে কেন? এ অবিচার তো দুনিয়ায় সর্বত্রই হচ্ছে, আকছারই হচ্ছে। এই যে তুমি ইন্দোচীন থেকে ফিরছ, সেখানে কি কোন ড্যানিয়েলগিরি করতে গিয়েছিলে, যে গার্সে (বাছ)। ওসব কথা থাক, দুটি খাও।’
ছোকরাটির সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল বলেই কথাটা বলবার সাহস হয়েছিল। বরঞ্চ ইংরেজকে এ-সব কথা বলবেন, ফরাসিকে বললে হাতাহাতি বোতল-ফাটাফাটির সম্ভাবনাই বেশি।
চুপ মেরে একটু ভেবে বললে, ‘হঃ। কিন্তু এস্থলে তো দোষী তোমারই জাতভাই ইন্ডিয়ান সারেঙ!’
আমি বিষম খেয়ে বললুম, ‘ওই-যা-যা!’
পৃথিবীতে এমন কোন দেশ এখনও দেখলুম না যেখানে মানুষ সুযোগ পেলে দুপুরবেলা ঘুমোয় না। তবু কেন বাঙালির ধারণা যে, সে-ই এ ধনের একমাত্র অধিকারী, এখনও বুঝে উঠতে পারি নি। আপনি আপন ডেকচেয়ারে শুয়ে, চোখে ফেটা মেরে আর পাঁচটি ফরাসিসের সঙ্গে কোরাসে। ওই কর্মটি সবেমাত্র সমাধান করেছি, এমন সময় উর্দি-পরা এক নৌ-অফিসার আমার সামনে এসে অতিশয় সৌজন্য সহকারে অবনত মস্তকে যেন প্রকাশ্যে আত্মচিন্তা করলেন, ‘আমি কি মসিয়ো অমুকের সঙ্গে আলাপ করার আনন্দ করছি?’
আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে উঠে, আরও অবনত মস্তকে বললুম, ‘আদপেই না। এ শ্লাঘা সম্পূর্ণ আমার-ই।’
অফিসার বললেন, মসিয়ো ল্য কমাদ-জাহাজের কাপ্তান সাহেব—সিয়োকে–আমাকে–তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দাভিবাদন জানিয়ে প্রার্থনা করছেন যে, তিনি যদি মসিয়োর উপস্থিতি পান তবে উল্লসিত হবেন।’
পাপাত্মা আমি। ভয়ে আঁতকে উঠলুম। আবার কী অপকর্ম করে ফেলেছি যে, মসিয়ো ল্য কমাদাঁ আমার জন্য হুলিয়া জারি করেছেন। শুকনো মুখে টোক গিলে বললুম, ‘সেই হবে আমার এ-জীবনের সব চেয়ে বড় সম্মান। আমি আপনার পথপ্রদর্শনের জন্য ব্যাকুল।’
মসিয়ো ল্য কমাদাঁ যদিও যাত্রী-জাহাজের কাপ্তান, তবু দেখলুম তার ঠোঁটের উপর ভাসছে আর-একখানি জাহাজ এবং সেটা সবপ্রকার বিনয় এবং স্তুতিস্তোকবাক্যে টৈটম্বর লাদাই। ভদ্রতার মানওয়ারী বললেও অত্যুক্তি হয় না। তবে মোদ্দা কথা যা বললেন, তার অর্থ আমার মত বহুভাষী পণ্ডিত ত্ৰিভুবনে আর হয় না, এমন কী প্যারিসেও হয় না।
এত বড় একটা মারাত্মক ভ্ৰমাত্মক তথ্য তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করব করব করছি, এমন সময় তার কথার তোড় থেকেই বেরিয়ে গেল, তিনি তিনশো তিরানব্বই বার পৃথিবী প্ৰদক্ষিণ করে এই প্রথম একটি মহাপণ্ডিত আবিষ্কার করেছেন, যিনি তার খালাসীদের কিচির-মিচিরের একটা অর্থ বের করতে পারেন। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তা হলে আমার মত আরও বহু লক্ষ পণ্ডিত সিলেট জেলায় আছেন। তারপর তিনি অনুরোধ করলেন, আমি যদি দয়া করে তার খালাসীদের অসন্তুষ্টির কারণটি খোলসা করে বর্ণনা করি, তবে তিনি বড় উপকৃত হন। আমি তা-ই করলুম। তখন সেই খালাসীদের আর সারেঙের ডাক পড়ল। তারা কুরবানির পাঠার মত কাঁপিতে কাঁপিতে উপস্থিত হল।
কাপ্তান আর জজ ভিন্ন শ্রেণীর প্রাণী। সাক্ষীর বয়স কত, সেই আলোচনায় জজেরা হেসে-খেলে সাতটি দিন কাটিয়ে দেন; কাপ্তানরা দেখলুম, তিন-মিনিটেই ফাঁসির হুকুম দিতে পারেন। মসিয়ো ল্য কমার্দো অতি শাস্তকণ্ঠে এবং প্রাঞ্জল ফরাসিতে সারেঙকে বুঝিয়ে দিলেন, ভবিষ্যতে তিনি যদি আর কখনও এরকম কেলেঙ্কারির খবর পান, তবে তিনি একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে সারেঙকে সমুদ্রের জলে ফেলে তার উপর জাহাজের প্রপেলারটি চালিয়ে দেবেন।
যাক। বাঁচা গেল। মরবে তো সারেঙটা!
পানির পীর বদর সায়েব। তাঁর কৃপায় রক্ষা পেয়ে ‘বদর বদর’ বলে কেবিনে ফিরলুম।
খানিকক্ষণ পর চীনা কেবিন-বয়, তার নিজস্ব ফরাসিতে বলে গেল, খালাসীরা আমাকে অনুরোধ জানিয়েছে আজ যেন আমি মেহেরবানি করে কেবিনে বসে তাদের পাঠানো ‘ডাল-ভাত’ খাই।
গোয়ালন্দী জাহাজের মামুলী রাইস-কারি খেয়েই আপনারা আ-হা-হা করেন, সেই জাহাজের বাবুর্চিরা যখন কোর্মা কালিয়া পাঠায়, তখন কী অবস্থা হয়? নাঃ, বলব না। দুএকবার ভোজনের বর্ণনা করার ফলে শহরে আমার বদনাম রটে গিয়েছে, আমি পেটুক এবং বিশ্বনিন্দুক। আমি শুধু অন্যের রন্ধনের নিন্দা করতেই জানি। আমার ভয়ঙ্কর রাগ হয়েছে। তামা-তুলসী স্পর্শ করে এই শপথ করলুম-না, থাক, আপনার আমার বাড়িতে মাবোনদের আমি একটি লাস্ট চান্স দিলুম।
কাপ্তান সাহেব আমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে আছেন। খালাসীরা তাই এখন নিৰ্ভয়ে খাবার নিয়ে আমার কেবিনে আসে।
এমনি করে জাহাজের শেষ রাত্ৰি উপস্থিত হল। সে রাত্রের খালাসীদের তৈরি গ্যালা ব্যানকুয়েট খেয়ে যখন বাঙ্কে এ-পাশ ও-পাশ করছি, এমন সময় খালাসীদের মুরুঝবীটি আমার পায়ের কাছটায় পাটাতনে বসে হাতজোড় করে বললে, ‘হুজুর, একটি নিবেদন আছে।’
মোগলাই খানা খেয়ে তখন তবিয়ত বেজায় খুশ। মোগলাই কণ্ঠেই ফরমান জারি করলুম, নিৰ্ভয়ে কও।’
বললে, ‘হুজুর ইটা পরগণার ঢেউপাশা গায়ের নাম শুনেছেন?’
আমি বললুম, আলবত! মনু গাঙ্গের পারে।’
বললে, ‘আহা, হুজুর সব জানেন।’
মনে মনে বললুম, হায়, শুধু কাপ্তান আর খালাসীরাই বুঝতে পারল আমি কত বড় বিদ্যোসাগর। যারা বুঝতে পারলে আজ আমার পাওনাদারদের ভয় ঘুচে যেত তারা বুঝল না।’