তাই সে রাত্রে ব্যাপারটা আমার কিন্তুত বলেই মনে হল।
ডেকা-চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঠিক ঘুম নয়, তন্দ্ৰা। এমন সময় কানে এল, সেই লাল-দরিয়ায়, দেশ থেকে বহু দূরের সেই সাত সমুদ্রের এক সমুদ্রে–সিলেটের বাঙাল ভাষা। স্বপ্নই হবে। জানতুম, সে-জাহাজে আমি ছাড়া আর কোন সিলেটি ছিল না। এ-রকম মরমিয়া সুরে মাঝ রাতে, কে কাকে ‘ভাই, হি কথা যদি তলচস’—বলতে যায়? খেয়ালীপোলাও চাখতে, আকাশ-কুসুম শুকতে, স্বপ্নের গান শুনতে কোনও খরচা নেই; তই ভাবলুম চোখ বন্ধ করে স্বপ্নটা আরও কিছুক্ষণ ধরে দেখি।
কিন্তু ওই তো স্বপ্নের একটিমাত্র দোষ। ঠিক যখন মনে হবে, বেশ জমে আসছে, ঠিক তখনই ঘুমটি যাবে ভেঙে। স্থলেও সে আইনের ব্যত্যয় হল না। চোখ খুলে দেখি, সামনেআমার দিকে পিছন ফিরে দুজন খালাসী চাপা গলায় কথা বলছে।
বেচারীরা। রাত বারোটার পর এদের অনুমতি আছে ডেকে আসবার। তাও দল বেঁধে নয়। বাকী দিনের অসহ্য গরম তাদের কাটাতে হয়। জাহাজের পেটের ভিতরে।
সিলেট-নোয়াখালির লোক যে পৃথিবীর সর্বত্রই জাহাজে খালাসীর কাজ করে সে-কথা আমার অজানা ছিল না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, তারা কাজ করে মাল-জাহাজেই; এ ফরাসি যাত্রী-জাহাজে রাত্রি দ্বিপ্রহরে, তাও আমার নোয়াখলি চাটগাঁয়ের নয়, একদিম খাঁটি আমার আপনি দেশ সিলেটের লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে তার সম্ভাবনা স্বপ্নেই বেশি, বাস্তবে কম।
এরা কথা বলছিল খুবই কম। যেটুকু শুনতে পেলুম, তার থেকে কিন্তু এ-কথাটা স্পষ্ট বোঝা গেল, এদের একজন এই প্রথম জাহাজের কামে’ ঢুকেছে এবং দেশের ঘরবাড়ির জন্য তার মন বড্ড উতলা হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গী পুরনো লোক; নতুন বউকে যে-রকম বাপের বাড়ির দাসী সান্ত্বনা দেয় এর কথার ধরন অনেকটা সেই রকমের।
আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছিলুম। শেষটায় যখন দেখলুম ওরা উঠি-উঠি করছে তখন আমি কোনও প্রকারের ভূমিকা না দিয়েই হঠাৎ অতি খাঁটি সিলেটিতে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমাদের বাড়ি সিলেটের কোন গ্রামে?’
সিলেটের খালাসীরা দুনিয়ায় তাবৎ দরিয়ার মাছের মত কিলবিল করে এ-সত্য সবাই জানে, কিন্তু তার চেয়ে ঢের সত্য-সিলেটের ভদ্রসন্তান পারতপক্ষে কখনও বিদেশ যায় না। তাই লাল-দরিয়ার মাঝখানে সিলেটি শুনে আমার মনে হয়েছিল, ওটা স্বপ্ন; সেইখানে সিলেটি ভদ্রসন্তান দেখে ওদের মনে হল, আজ মহাপ্ৰলয় (কিয়ামতের দিন) উপস্থিত। শাস্ত্রে আছে, ওই দিনই আমাদের সকলের দেখা হবে এক-ই জায়গায়; ভূত দেখলেও মানুষ অতখানি লাফ দেয় না। দুজন যেভাবে একই তালে-লিয়ে লাফ দিল তা দেখে মনে হল ওরা যেন এই কর্মটি বহুদিন ধরে মহড়া দিয়ে আসছে।
উভয় পক্ষ কথঞ্চিৎ শান্ত হওয়ার পর আমি সিগারেট-কেস খুলে ওদের সামনে ধরলুম। দুজনেই একসঙ্গে কানে হাত দিয়ে জিভ কাটল। আমাকে তারা চেনে না বটেআমি দেশ ছেড়েছি ছেলেবেলায়-তবে আমার কথা তারা শুনেছে এবং আমার বাপ-ঠাকুর্দার পায়ের ধুলো তার বিস্তর নিয়েছে, খুদাতালার বেহদ্ মেহেরবানি আজ তারা আমার দর্শন পেল, আমার সামনে ওসব —তওবা, তওবা ইত্যাদি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার দেশের চাষারা ইয়োরোপীয় চাষার চেয়ে ঢের ভদ্র।
খালাসী-জীবনের কষ্ট এবং আর পাঁচটা সুখ-দুঃখের কথাও হল। দুঃখের কথাই পনের আনা তিন পয়সা। বাকী এক পয়সা সুখ—অর্থাৎ মাইনেটা, সেই এক পয়সাই পাঁচাত্তর টাকা। ওই দিয়ে বাড়িঘর ছাড়াবে, জমি-জমা কিনবে।
শেষটায় শেষ প্রশ্ন শুধালুম, ‘আহারাদি?’ রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে।
বললে, ‘ওই তো আসল দুঃখ হুজুর। আমি তো তবু পুরোন লোক। পাউরুটি আমার গলায় গিট বাঁধে। না। কিন্তু এই ছেলেটার জান পাস্তাভাতে পোতা। পাস্তাভাত! ভাতেরই নেই খোঁজ, ও চায় পাস্তাভাত। মূলে নেই ঘর, পূব দিয়া তিন দোর। হুঁঃ।’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘সে কী কথা! আমি তো শুনেছি, আর কিছু না হোক তোমাদের ডাল ভাত প্রচুর খেতে দেয়। জাহাজের কাম করে কেউ তো কখনও রোগ হয়ে দেশে ফেরে নি!’
বললে, ‘ঠিকই শুনেছেন সায়েব। কিন্তু ব্যাপার হয়েছে কী, কোনও কোনও বন্দরে চাল এখন মাগগি। সারেঙ আমাদের রুটি খাইয়ে চাল জমাচ্ছে ওই সব বন্দরে লুকিয়ে চাল বিক্রি করবে বলে। সারেঙ দেশের জাতভাই কি না, না হলে অমন মারার কৌশাল জানবে কী করে?’
আমি বললুম, ‘নালিশ ফরিয়াদ কর নি?’
বললে, ‘কে বোঝে কার বুলি? এদের ভাষা কি জানি ‘ফ্রিঞ্চি’ না কী, সারেঙই একটুখানি বলতে পারে। ইংরিজি হলেও না হয় আমাদের মুরুর্কীদের কেউ কেউ ওপরওয়ালদের জানাতে পারতেন। ওই তো সারেঙের কল! ধন্যি জাহাজ; ব্যাটারা শুনেছি কোলা ব্যাঙ ধরে ধরে খায়। সেলাম সায়েব, আজ উঠি! দেরি হয়ে গিয়েছে। আপনার কথা শুনে জানটা–’
আমি বললাম, ‘বাস, বাস।’
মাঝরাতের স্বপ্ন আর শেষরাতের ঘটনা মানুষ নাকি সহজেই ভুলে যায়। আমার আবার চমৎকার স্মৃতিশক্তি-সব কথাই ভুলে যাই। তাই ভাতের কেচ্ছা মনে পড়ল, দুপুরবেলা লাঞ্চের সময় রাইস-কারি দেখে।
জাহাজটা ফরাসিস, ফরাসিসে ভর্তি। আসলে এটা ইন্ডো-চীন থেকে ফরাসি সেপাই লস্কর লাদাই করে ফ্রান্স যাবার মুখে পণ্ডিচেরিতে একটা ঢু মেরে যায়। প্যাসেঞ্জার মাত্রই পল্টনের লোক, আমরা গুটিকয়েক ভারতীয়ই উটকো মাল। খানাটেবিলে আমার পাশে বসত একটি ছোকরা সূলিয়োৎনা—অর্থাৎ সাব অলটার্ন। আমার নিতান্ত নিজস্ব মৌলিক ফরাসিতে তাকে রাত্রের ঘটনাটি গল্পচ্ছলে নিবেদন করলুম।