রসায়নশাস্ত্র অনুসারে তাৰ্পিন কেরোসিন ও সর্ষপ তৈল তিন পৃথক শ্রেণীতে পড়ে। তার্পিন, চন্দন, নেবুর তৈল প্রভৃতি গন্ধতৈল প্রথম শ্রেণী। কেরোসিন, পেট্রল, ভ্যাসেলিন, এমন কি কঠিন প্যারাফিন—যাহা হইতে বর্মা-বাতি হয়, দ্বিতীয় শ্ৰেণী। সর্ষপ তৈল, তিল তৈল, ঘৃত, চর্বি প্রভৃতি উদভিজ্জ ও প্রাণিজ মেহদ্রব্য তৃতীয় শ্রেণী। তৃতীয় শ্রেণীর সাধারণ ইংরেজী নাম fat; আমরা এই শ্রেণীকেই তৈল’ নামে অভিহিত করিব। অপর দুই শ্রেণী এই প্রবন্ধের বিষয়ীভূত নয়।
তৈল মানুষের খাদ্যের একটি প্রধান উপাদান। ভারতের প্রদেশভেদে সর্ষপ তিল চীনাবাদাম ও নারিকেল তৈল বন্ধনে ব্যবহৃত হয়। ধৃতের ত কথাই নাই, ভারতবাসী মাত্রই ধৃতভক্ত। চর্বির ভক্তও অনেক আছে। কার্পাসবীজের তৈলও আজকাল রন্ধনে চলিতেছে। কোনও কোনও স্থানে তিসির তৈলও বাদ যায় না। মাদ্রাজে রেড়ির তৈলে প্রস্তুত উপাদেয় আমের আচার খাইয়াছি।
সাধারণ সাবানের উপাদান তৈল ও সোডা। তৈলভেদে সাবানের গুণের তারতম্য হয়। চর্বি ও নারিকেল তৈলের সাবান শক্ত, রেড়ি তিল চীনাবাদাম প্রভৃতি তৈলের সাবান নরম। লোকে নরম সাবান পছন্দ করে না, সেজন্য অন্য তৈলের সহিত কিছু চবি ও নারিকেল তৈল মিশানো হয়। নারিকেল তৈলের বিশেষ গুণ—সাবানে প্রচুর ফেনা হয়। কোনও কোনও কাজে নরম সাবানই দরকার হয়, সেজন্য নারিকেল তৈল ও চর্বি না দিয়া অন্য উদভিজ্জ তৈল বা মাছের তৈল ব্যবহার করা হয় এবং সোডার বদলে অল্লাধিক পটাশ দেওয়া হয়। কিন্তু মোটের উপর কঠিন সাবানেরই আদর বেশী, সেজন্য চর্বি ও নারিকেল তেলের কাটতি ক্রমে বাড়িতেছে।
কলের তাঁতে বুনিবার পূর্বে সুতায় যে মাড় দেওয়া হয় তাহার একটি প্রধান উপকরণ চবি। আমাদের দেশের তাঁতীরা নারিকেল তৈল দেয়, কিন্তু মিলে চর্বিই প্রকৃষ্ট বলিয়া গণ্য হয়। এই কারণেও চর্বির মূল্যবৃদ্ধি হইতেছে।
লুচি কচুরি প্রস্তুত করিবার সময় ময়দায় ঘিএর মোন দেওয়া হয়, তাহার ফলে খাবার খাস্তা হয়, অর্থাৎ ময়দাপিণ্ডের চিমসা ভাব দূর হয়। খাজা, ঢাকাই পরটা প্রভৃতিতে প্রচুর ময়ান থাকে, সেজন্য ভাজিবার সময় স্তরে স্তরে আলগা হইয়া যায়। কিন্তু যদি ঘিএর বদলে তেলের ময়ান দেওয়া হয় তবে তত ভাল হয় না। চর্বি দিলে ঘিএর চেয়েও ভাল হয়, অবশ্য সকলে সে পরীক্ষা করিতে রাজী হইবে না। বিলাতী বিস্কুটে এযাবৎ চর্বির ময়ান চলিয়া আসিতেছে। এদেশে যে হিন্দু বিস্কুট’ প্রস্তুত হয় তাহা বিলাতীর সমকক্ষ নয়। ইহার প্রধান কারণ—নিপুণতার অভাব, কিন্তু চর্বির বদলে ঘি বা মাখন ব্যবহারও অন্যতম কারণ।
তৈল চর্বি ইত্যাদির যতরকম প্রয়োগ আছে তাহার বর্ণনা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এখন ঘনীকৃত তৈলের কথা পাড়ি।
প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে একজন ফরাসী রসায়নবিৎ আবিষ্কার করেন যে নিকেল-ধাতুর সূক্ষ্ম চূর্ণের সাহায্যে তৈলের সহিত হাইড্রোজেন গ্যাস যোগ করা যায়, তাহার ফলে তরল তৈল ঘনীভূত হয়। এই প্রক্রিয়ায় নিকেল অনুঘটকের (catalyst) কাজ করে মাত্র, উৎপন্ন বস্তুর অঙ্গীভূত হয় না। উক্ত আবিষ্কারের পর বহু বিজ্ঞানী এই প্রক্রিয়ার উত্তরোত্তর উন্নতিসাধন করিয়াছেন, তাহার ফলে একটি বিশাল ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে।
যে-কোনও তৈল এই উপায়ে রূপান্তরিত করিতে পারা যায়। হাইড্রোজেনের মাত্রা অনুসারে ধৃতের তুল্য কোমল, চবির তুল্য, মোমের তুল্য কঠিন অথবা তদপেক্ষাও কঠিন বস্তু উৎপন্ন হয়। সর্ষপ তৈল, নিম তৈল, এমন কি পূতিগন্ধ মাছের তৈল পর্যন্ত বর্ণহীন গন্ধহীন ঘন বস্তুতে পরিণত হয়।
Hydrogenated oil বা solidified oil বা ঘনীকৃত তৈল এখন ইউরোপ ও আমেরিকার নানা স্থানে প্রস্তুত হইতেছে। এই ব্যবসায়ে হলাণ্ড মুখ্য স্থান অধিকার করিয়াছে এবং ইংলাও ক্রমশ অগ্রসর হইতেছে। এতদিন চর্বি দ্বারা যে কাজ হইত, এখন বহুস্থলে ঘনীকৃত তৈল দ্বারা তাহা সম্পন্ন হইতেছে। যেসকল উদভিজ্জ ও প্রাণিজ তৈল পূর্বে অতি নিকৃষ্ট ও অব্যবহার্য বলিয়া গণ্য হইত, এখন তাহাদেরও সদ্গতি হইতেছে।
রুটি-মাখন বিলাতের জনপ্রিয় খাদ্য। কিন্তু গরিব লোকে মাখনের খরচ যোগাইতে পারে না, সেজন্য মারগারিন’ নামক কৃত্রিম মাখনের সৃষ্টি হইয়াছে। পূর্বে ইহার উপাদান ছিল চর্বি, উদভিজ্জ তৈল, কিঞ্চিৎ দুগ্ধ এবং ঈষৎ মাত্রায় পিষ্ট গোস্তানের নির্যাস। শেষোক্ত উপাদান মিশ্রণের ফলে মারগারিনে মাখনের স্বাদ ও গন্ধ কিয়ৎপরিমাণে উৎপন্ন হয়। ভাল মারগারিনে কিছু খাঁটী মাখনও মিশ্রিত থাকে। আজকাল যে মারগারিন প্রস্তুত হইতেছে তাহাতে চর্বি ও স্বাভাবিক উভিজ্ঞ তৈল প্রায় থাকে না, তৎপরিবর্তে মাখনের তুল্য ঘনীকৃত তৈল দেওয়া হয়, কিন্তু অন্যান্য উপাদান পূর্ববৎ বজায় আছে। চকোলেট টফি প্রভৃতি খাদ্যে পূর্বে মাখন দেওয়া হইত, এখন প্রায় ঘনীকৃত তৈল দেওয়া হইতেছে, তাহার ফলে লাভ বাড়িয়াছে এবং বিকৃতির আশঙ্কাও কমিয়াছে। বিস্কুটেও ক্রমশ চর্বির বদলে ঘনীকৃত তৈল চলিতেছে, সেজন্য কোনও কোনও ব্যবসায়ী সগর্বে বলিতেছেন—তাহাদের জিনিস খাইলে হিন্দু-মুসলমানের জাতি যায় না। সাবান ও অন্যান্য বহু ব্যবসায়ে ঘনীকৃত তৈলের প্রয়োগ ক্রমশ প্রসারিত হইতেছে। মোট কথা, বিশেষ বিশেষ কর্মের উপযুক্ত অনেকপ্রকার ঘনীকৃত তৈল প্রস্তুত হইতেছে এবং লোকেও তাহার প্রয়োগ শিখিতেছে।