গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধ ছিলেন না, যীশু খ্রীষ্টও খ্রীষ্টান ছিলেন না। ধর্মের যাঁরা প্রবর্তক তাঁদের তিরোধানের পরে ধীরে ধীরে বহুকাল ধরে ধর্ম সম্প্রদায় গড়ে ওঠে এবং পরিবর্তনও ক্রমান্বয়ে হতে থাকে। অবশেষে মঠধারী, প্রচারক, পুরোহিত এবং লোকাঁচার দ্বারাই ধর্ম শাসিত হয়, এবং যাঁরা আদিপ্রবর্তক তাঁরা সাক্ষিগোপাল মাত্র হয়ে পড়েন। বিলাতেও তাই হয়েছে। খ্রষ্টীয় আদর্শ মানে খ্রীষ্টকথিত মার্গ নয়, আধুনিক প্রোটেস্টান্ট ধনীসমাজের আদর্শ। সে আদর্শ কি? গত দু শ বৎসরের মধ্যে বিলাতে যে সমৃদ্ধি হয়েছে তার কারণ অবশ্য প্রোটেস্টান্ট সমাজের উদ্যম। এই সমৃদ্ধির কারণ অবশ্য প্রোটেস্টান্ট ধর্ম নয়, যেমন এদেশের পারসী জাতি জরথুস্ত্রীয় ধর্মের জন্যই ধনী হন নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যাঁরা বিস্তার করেছেন এবং নিজের দেশে যাঁরা বড় বড় কারখানার পত্তন করে দেশ-বিদেশে মাল চালান দিয়ে ধনশালী হয়েছেন, দৈবকুমে তারা প্রোটেস্টান্ট–বিশেষ করে ইংল্যান্ডের অ্যাংলিক্যান এবং স্কটল্যান্ডের প্রেসবিটেরিয়ান সমাজ। ধনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক শক্তি আসে, সেজন্য এই দুই সমাজই বিলাতে প্রবল। এঁরা চার্চের পোষক, চার্চও এঁদের আজ্ঞাবহ। গীতায় আছে–’দেবা ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ, পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাস্যথ’-যজ্ঞের দ্বারা দেবগণকে তৃপ্ত কর, ঐ দেবগণও তোমাদের তৃপ্ত করুন, পরস্পরকে তৃপ্ত করে পরম শ্ৰেয় লাভ কর। বিলাতের দেবতা বিলাতবাসীকে ঐশ্বর্যদানে তৃপ্ত করেছেন, বিলাতের লোকেরাও তাদের যাজকসংঘকে সরকারী ও বেসরকারী সাহায্যে তৃপ্ত করে থাকেন। কিন্তু শুধু তৃপ্ত করেন না, পরোক্ষভাবে হুকুমও চালান। পার্লামেন্ট যেমন ধনীর করতলস্থ, চার্চও সেইরকম। পাদ্রীরা যথাসম্ভব ধনীর ইঙ্গিতে চলেন, অবাধ্য রাজাকে সরাবার বিধান দেন, কমিউনিস্টদের শয়তানগ্রস্ত বলে প্রচার করেন, অসহিষ্ণু দরিদ্রকে স্বর্গরাজ্যের আশ্বাস দিয়ে শান্ত রাখবার চেষ্টা করেন, অধীন দুর্বল জাতিদের চিরস্থায়ী হেপাজত সমর্থন করেন। আমাদের দেশেও ধনী আর পুরোহিতের মধ্যে একটু ঐরকম সম্বন্ধ আছে। কিন্তু ধর্মের ভেদ এখানে বেশী, রাজসাহায্যও নেই, তাই পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ ব্যাপারটা দেশব্যাপী হয়নি।
যে খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে এতটা শ্রীবৃদ্ধি জড়িত তার নামেই যে ব্রিটেনের যুদ্ধোত্তর আদর্শ ঘোষিত হবে তা বিচিত্র নয়। কিন্তু নূতন করে আদর্শ খ্যাপনের কারণ এ নয় যে পূর্বের আদর্শ ধর্মবিরুদ্ধ ছিল। কথাটা বিদেশীকে লক্ষ্য করে বলা হয় নি, বৃটিশ জাতিরই আত্মপ্রসাদ রক্ষার জন্য বলা হয়েছে, যাতে এই বিপকালে কারও মনে গ্লানি বা বৈরাগ্য না আসে। এই আদর্শের আন্তরিক অর্থ–যে উত্তম ব্যবস্থা সেদিন পর্যন্ত ইওরোপ এশিয়া আফ্রিকায় চলে এসেছে তাই কিঞ্চিৎ শোধনের পর পাকা করা। আদর্শটা ধূমাচ্ছন্ন, স্পষ্ট করে ব্যক্ত করা যায় না, সেজন্য একটা পবিত্র বিশেষণ আবশ্যক। আমাদেরও অনেক ক্ষুদ্র আদর্শ আছে, এক কথায়–আমরা রামরাজ্য চাই। বিলাসী ধনী তাতে বোঝেন–তার ন্যস্ত সম্পত্তি নিরাপদ থাকবে, দারজিলিং সিমলা বিলাত সুগম হবে, হীরে জহরত সিল্ক সাটিন পেট্রল ‘সার’-উপাধি সুলভ হবে, গৃহিণী পুত্র কন্যারা দুখানা মোটরেই সন্তুষ্ট থাকবেন। অতি নিরীহ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক বোঝেন–তার রোজগার বজায় থাকবে, ট্যাক্স বাড়বে না, দোকানদার সস্তায় জিনিসপত্র দেবে, চাকর কম মাইনেয় কাজ করবে, ছেলে-মেয়েরা আইন লঙ্ঘন বা বিয়ের আগে প্রেম করবে না। খ্রীষ্টীয় আদর্শ বা আমাদের অতি ক্ষুদ্র আদর্শ যতই প্রচ্ছন্ন হক, তার মানে–যা আছে বা ভূতপূর্ব তাই কায়েম করা বা আরও সুবিধাজনক করা। কিন্তু আমাদের একটা বড় আদর্শও আছে– স্বাধীনতা, যা অভূতপূর্ব, যার খসড়াও তৈরি হয় নি শুধু নামটিই সম্বল। সুতরাং কিছু উহ্য না রেখেই আমরা সে আদর্শ ঘোষণা করতে পারি, ভাবী স্বরাজ্যকে রামরাজ্য বা ধর্মরাজ্য বলবার দরকার নেই।
খ্রীষ্টীয় আদর্শ যাদের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হবে তাদের মধ্যে রাশিয়া আছে। সেদিন পর্যন্ত রাশিয়া অর্ধশত্রু ছিল, এখন পরমমিত্র। কিন্তু রাজনীতিক মৈত্রী আর বারবনিতার প্রেম একজাতীয়। যখন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবার সময় আসবে তখন সাম্যবাদী মিত্র কি বলবে? হয়তো বলবে–ব্রিটেন তার সাম্রাজ্য নিয়ে যা খুশি করুক, আমরা নিজের দেশ আগে সামলাই। হয়তো ব্রিটেন সেই ভরসাতেই নিজের আদর্শ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত আছে।
ঘনীকৃত তৈল
চলিত কথায় ‘তৈল’ বলিলে যেসকল বস্তু বুঝায় তাহাদের কতকগুলি সাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। সকল তৈলই দাহ, অম্লাধিক তরল এবং জলে অদ্রাব্য। তাৰ্পিন কেরোসিন ও সর্ষপ তৈলে এইসকল লক্ষণ বর্তমান। পক্ষান্তরে স্পিরিট তৈল নয়, কারণ তাহা দাহ ও তরল হইলেও জলের সহিত মিশে।
কিন্তু তাৰ্পিন কেরোসিন ও সর্ষপ তৈলের কতকগুলি প্রকৃতিগত বৈষম্য আছে। তাৰ্পিন সহজে উবিয়া . যায়, কেরোসিন উবিতে সময় লাগে, সর্ষপ তৈল মোটেই উবে না। সর্ষপ তৈলের সহিত সোডা মিশাইয়া সাবান করা যায়, কিন্তু তাৰ্পিন ও কেরোসিনে সাবান হয় না।
আমরা মোটামুটি কাজ চালাইবার জন্য পদার্থের সুল লক্ষণ দেখিয়া শ্রেণীবিভাগ করি, কিন্তু বিজ্ঞানী তাহাতে সন্তুষ্ট নন। তাঁহারা নানাপ্রকার পরীক্ষা করিয়া দেখেন কোন্ লক্ষণগুলি পদার্থের গঠন ও ক্রিয়ার পরিচায়ক, এবং সেই গুলিকেই মুখ্য লক্ষণ গণ্য করিয়া শ্রেণীবিভাগ করেন। শ্রেণী নির্দেশের জন্য বিজ্ঞানী নূতন নাম রচনা করেন, অথবা প্রচলিত নাম বজায় রাখিয়া তাহার অর্থ সংকুচিত বা প্রসারিত করেন। এজন্য লৌকিক ও বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিভাগে অনেক স্থলে বিরোধ দেখা যায়। লোকে বলে চিংড়ি-মাছ, বিজ্ঞানী বলেন চিংড়ি মাছ নয়। লোকে কয়েকপ্রকার লবণ জানে, যথা সৈন্ধব, করচ, লিভারপুল, বেআইনী, ইত্যাদি। বিজ্ঞানী বলেন, লবণ তোমার রান্নাঘরের একচেটে নয়, লবণ অসংখ্য, ফটকিরি তুতেও লবণ। কবি লেখেন—তাল-তমাল। বিজ্ঞানী বলেন-ও দুই গাছে টের তফাত, বরং ঘাস-বাঁশ লিখিতে পার।