একটা সোজা উপমা দিচ্ছি। চা আমরা অনেকেই খাই এবং তার স্বাদ গন্ধ মোটামুটি বিচার করতে পারি। কিন্তু চা বাগানের কতারা চাএর দাম স্থির করেন কোন্ উপায়ে? এখনও এমন যন্ত্র তৈয়ারী হয় নি যাতে চায়ের স্বাদ গন্ধ মাপা যায়। অগত্যা বিশেষজ্ঞের শরণ নিতে হয়। এই বিশেষজ্ঞ বিশেষ কিছুই জানেন না। এর সম্বল শুধু জিব আর নাক। ইনি গরম জলে চা ভিজিয়ে সেই জল একটু চেখে বলেন–এই চা দু-টাকা পাউণ্ড, এটা পাঁচ সিকে, এটা এক টাকা তিন আনা। তিনি কোন্ উপায়ে এইরকম বিচার করেন। নিজেই বলতে পারেন না। তাঁর ঘ্রাণেন্দ্রিয় ও রসননেন্দ্রিয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, অতি অল্প ইতরবিশেষও তাঁর কাছে ধরা পড়ে। এই বিধিদত্ত ক্ষমতার খ্যাতিতে তিনি টি-টেস্টারের পদ লাভ করেন এবং চা-ব্যবসায়ী তার যাচাইকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়। তিনি যদি বলেন এই চাএর চেয়ে ঐ চা ঈষৎ ভাল, তবে দু-দশ জন সাধারণ লোক হয়ত অন্য মত দিতে পারে। কিন্তু বহু শত বিলাসী লোক যদি ঐ দুই চা খেয়ে দেখে তবে অধিকাংশের অভিমত টি-টেস্টারের অনুবর্তী হবে।
যাঁরা সাহিত্যে বৈদগ্ধের খ্যাতি লাভ করেন তারা টি-টেস্টারের সহিত তুলনীয়। টি-টোরের লক্ষণস্বাদ গন্ধের সূক্ষ্ম বোধ আর অসংখ্য পেয়ালার সঙ্গে পরিচয়। বিদ ব্যক্তির লক্ষণ—সূক্ষ্ম রসবোধ আর সাহিত্যে বিপুল অভিজ্ঞতা। স্বাদ গন্ধ কাকে বলে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, আমরা কেবল মনে মনে বুঝি। কিন্তু রসের স্বরূপ সম্বন্ধে মনে মনে ধারণা করাও শক্ত। সাহিত্য-বিচারককে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়—আপনি কি কি গুণের জন্য এই রচনাটিকে ভাল বলছেন—তবে তিনি কিছুই স্পষ্ট করে বলতে পারবেন না। যদি বলতে পারতেন তবে রসবিচারের একটা পদ্ধতি খাড়া হতে পারত। তাঁর যদি বিদ্যা জাহির করবার লোভ থাকে (থাকতেও পারে, কারণ, বিদ্যা দদাতি বিনয়ং সব ক্ষেত্রে নয়), তবে তিনি হয়তো আর্টের উপর বক্তৃতা দেবেন, অলংকারশাস্ত্র উদ্ঘাটন করবেন, রসের বিশ্লেষণ করবেন। সেই ব্যাখ্যান শুনে হয়তো শ্রোতা অনেক নূতন জিনিস শিখবে। কিন্তু রসবিচারের মাপকাঠির সন্ধান পাবে না।
সাহিত্যের যে রস তা বহু উপাদানের জটিল সমন্বয়ে উৎপন্ন। সংগীতের রস বোধ হয় অপেক্ষাকৃত সরল। আমরা লোকপরম্পরায় জেনে এসেছি যে অমুক স্বরের সঙ্গে অমুক স্বর মিষ্ট বা কটু শোনায়, কিন্তু কিজন্য এমন হয় তা ঠিক জানি না। বিজ্ঞানী এইটুকু আবিষ্কার করেছেন যে আমাদের কানের ভিতরের শ্রুতিযন্ত্রে কতকগুলি তন্তু আছে, তাদের কম্পনের রীতি বিভিন্ন কিন্তু নির্দিষ্ট। বিবাদী স্বরের আঘাতে এই তন্তুগুলির স্বচ্ছন্দ স্পন্দনে ব্যাঘাত হয়, কিন্তু সংবাদী স্বরে হয় না। শ্রবণেন্দ্রিয়ের রহস্য যদি আরও জানা যায় তবে হয়তো সংগীতের অনেক তত্ত্ব বোধগম্য হবে। যত দিন তা না হয় তত দিন সংগীতবিদ্যাকে কলা বা আর্ট বলা চলবে কিন্তু বিজ্ঞান বলা চলবে না।
সাহিত্যের রসতত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান নিতান্তই অস্পষ্ট। সুললিত বর্ণনার মায়াজালে এই অজ্ঞতা ঢাকা পড়ে না। কেউ বলেন—art for art’s sake, কেউ বলেন—মানুষের কল্যাণই সাহিত্যের কাম্য, কেউ বলেন—সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনসাধন। এই সমস্ত ঝাপসা কথায় রসতত্বে নিদান পাওয়া যায় না। আমরা এইটুকু বুঝি যে সাহিত্যরসে মানুষ আনন্দ পায়, কিন্তু রসের বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা ও যোজনার বিষয় আমরা কিছুই জানি না। যে যে উপাদান সাহিত্যরসের উপজীব্য, তার কয়েকটির সম্বন্ধে আমরা অস্পষ্ট ধারণা করতে পারি, যথা—জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের রুচিকর বিষয় বর্ণন, চিরাগত সংস্কার ও অভ্যাসের আনুকূল্য, মানুষের প্রচ্ছন্ন কামনার তর্পণ, অপ্রিয় বাধার খণ্ডন, অস্ফুট অনুভূতির পরিস্ফুটন, জ্ঞানের বর্ধন, আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা, প্রভৃতি। এইসকল উপাদানের কতকগুলি পরস্পরবিরোধী কতকগুলি নীতিবিরোধী। কিন্তু সাহিত্যরচয়িতা কোনও উপাদান বাদ দেন না। ওস্তাদ পাচক যেমন কটু অস্ত্র মিষ্ট সুগন্ধ দুর্গন্ধ নানা উপাদান মিশিয়ে বিবিধ সুখাদ্য তৈয়ার করে, ওস্তাদ সাহিত্যিকও সেই রকম করেন। খাদ্যে কতটা ঘি দিলে উপাদেয় হবে, কটা লঙ্কা দিলে মুখ জ্বালা করবে না, কতটুকু রসুন দিলে বিকট গন্ধ হবে না,-এবং সাহিত্যে কতটুকু শান্তরস বা বীভৎসরস, তত্ত্বকথা বা দুর্নীতি বরদাস্ত হবে, এসবের নির্ধারণ একই পদ্ধতিতে হয়। কয়েকজন ভোজার হয়ত বিশেষ বিশেষ রসে অনুরক্তি বা বিরক্তি থাকতে পারে, কিন্তু তাদের পছন্দই জগতে চরম বলে গণ্য হয় না। যিনি কেবল দলবিশেষের তৃপ্তিবিধান করেন অথবা কেবল সাধারণ। ভোক্তার অভ্যস্ত ভোজ্য প্রস্তুত করেন, তিনি সামান্য পেশাদার মাত্র। যিনি অসংখ্য খোশখোরাকীর রুচিকে নিজের অভিনব রুচির অনুগত করতে পারেন তিনিই প্রকত সাহিত্যস্রষ্টা এবং যিনি অন্যের রচনায় এই প্রভাব স্বয়ং উপলব্ধি করে সাধারণকে তৎপ্রতি আকৃষ্ট করতে পারেন তিনিই সমালোচক হবার যোগ্য।
তামাক একটা বিষ, কিন্তু ধূমপান অসংখ্য লোকে করে এবং সমাজ তাতে আপত্তি করে না। কারণ, মোটের উপর তামাকে যতটা স্বাস্থ্যহানি হয় তার তুলনায় লোকে মজা পায় ঢের বেশী। পাশ্চাত্ত্য দেশে মদ সম্বন্ধেও এই ধারণা, এবং অনেক সমাজে পরিমিত ব্যভিচারও উপভোগ্য ও ক্ষমাই গণ্য হয়। মজা পাওয়াটাই প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু তাতে যদি বেশী স্বাস্থ্যহানি ঘটে তবে মজা নষ্ট হয় এবং রসের উদ্দেশ্যই বিফল হয়। সাহিত্যরসের উপাদান বিচারকালে সুধীজন এবিষয়ে স্বভাবত অবহিত থাকেন। যিনি উত্তম বোদ্ধা বা সমালোচক তিনি মজা ও স্বাস্থ্য উভয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে রসের যাচাই করেন। তাঁর যাচাইএর নিক্তি আর কষ্টিপাথর কিরকম তা তিনি অপরকে বোঝাতে পারেন না, নিজেও বোঝেন না। তথাপি তার সিদ্ধান্তে বড় একটা ভুল হয় না, অর্থাৎ শিক্ষিতজন সাধারণত তাঁর মতেই মত দেয়।