যোগেশচন্দ্র-প্রবর্তিত দুটি পরিভাষা এই প্রবন্ধে প্রয়োগ করছি—মৌখিক ও লৈখিক। আমার একটা অযত্নলব্ধ মৌখিক ভাষা আছে তা রাঢ়ের বা পূর্ববঙ্গের বা অন্য অঞ্চলের। চেষ্টা করলে এই ভাষাকে অম্লাধিক বদলে কলকাতার মৌখিক ভাষার অনুরূপ করে নিতে পারি, না পারলেও বিশেষ অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমার মুখের ভাষা যেমনই হোক, আমাকে একটা লৈখিক বা লেখাপড়ার ভাষা শিখতেই হবে— যা সর্বসম্মত, সর্বাঞ্চলবাসী বাঙালীর বোধ্য, অর্থাৎ সাহিত্যের উপযুক্ত। এই লৈখিকভাষা সাধু হতে পারে কিংবা চলিত হতে পারে। কিন্তু যদি দুটিই কষ্ট করে শিখতে হয় তবে আমার উপর অনর্থক জুলুম হবে। যদি চলিতভাষাই যোগ্যতর হয় তবে সাধুভাষার লোপ হ’লে হানি কি? সাধুভাষায় রচিত যেসব সগ্রন্থ আছে তা নাহয় যত্ন করে তুলে রাখব। কিন্তু যে ভাষা অবাঞ্ছনীয় এখন আর তার বৃদ্ধির প্রয়োজন কি? পক্ষান্তরে, যদি সাধুভাষাতেই সকল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় তবে এই সুপ্রতিষ্ঠিত বহুবিদিত ভাষার পাশে আবার একটা অনভ্যস্ত ভাবা খাড়া করবার চেষ্টা কেন?
যাঁরা সাধু আর চলিত উভয় ভাষারই ভক্ত তাঁরা বলবেন কোনওটাই ছাড়তে পারি না। সাধুভাষার প্রকাশশক্তি একরকম, চলিতভাষার অন্যরকম। দুই ভাষাই আমাদের চাই, নতুবা সাহিত্য অঙ্গহীন হবে। ভাষার দুই ধারা স্বত ফুর্ত হয়েছে, সুবিধা-অসুবিধার হিসাব করে তার একটিকে গলা টিপে মারতে পারি না।
কোনও ব্যক্তি বা বিদ্বৎসংঘের ফরমাশে ভাষার সৃষ্টি স্থিতি লয় হতে পারে না। শক্তিশালী লেখকদের প্রভাবে ও সাধারণের রুচি অনুসারে ভাষার পরিবর্তন কালক্রমে ধীরে ধীরে ঘটে। কিন্তু প্রকৃতির উপরেও মানুষের হাত চলে। সাধারণের উপেক্ষার ফলে যদি একটা বিষয় কালোপযোগী হয়ে গড়ে না ওঠে, তথাপি প্রতিষ্ঠাশালী কয়েকজনের চেষ্টায় অল্পকালেই তার প্রতিকার হতে পারে। অতএব সাধু আর চলিত ভাষার সমস্যায় হাল ছেড়ে দেবার কারণ নেই।
একটা ভ্রান্ত ধারণা অনেকের আছে যে চলিতভাবা আর পশ্চিম বঙ্গের মৌখিকভাষা সর্বাংশে সমান। এর ফলে বিস্তর অনর্থক বিতণ্ডা হয়েছে। মৌখিকভাষা যে অঞ্চলেরই হোক, মুখের ধ্বনি মাত্র, তা শুনে বুঝতে হয়। লৈখিকভাষা দেখে অর্থাৎ পড়ে বুঝতে হয়। মৌখিকভাষার উচ্চারণই তার সর্বস্ব। লৈখিকভাষার চেহারাটাই আসল, উচ্চারণ সকলে একরকমে না করলেও ক্ষতি নেই, মানে বুঝতে পারলেই যথেষ্ট। লৈখিকভাষা সর্বসাধারণের ভাষা, সেজন্য বানানে মিল থাকা দরকার, উচ্চারণ যাই হোক।
‘ভাষা’ শব্দটি আমরা নানা অর্থে প্রয়োগ করি। জাতিবিশেষের কথা ও লেখার সামান্য লক্ষণসমূহের নাম ভাষা, যথা-বাংলা ভাষা। আবার, শব্দাবলীর প্রকার (form)—অর্থাৎ কোন শব্দ বা শব্দের কোন রূপ প্রয়োজ্য বা বর্জনীয় তার রীতিও ভাষা, যথা—সাধুভাষা। আবার, প্রকার এক হ’লেও ভঙ্গী(style)র ভেদও ভাষা, যথা—আলালী, বিদ্যাসাগরী বা বঙ্কিমী ভাষা।
আলালী আর বঙ্কিমী ভাষা যতই ভিন্ন হোক, দুইটিই যে সাধুভাষা তাতে সন্দেহ নেই। ভেদ যা আছে তা প্রকারের নয়, ভঙ্গীর। হুতোম পাচার নক্শা আর রবীন্দ্রনাথের লিপিকার ভাষায় আকাশ-পাতাল ব্যবধান, কিন্তু দুটিই চলিত ভাষায় লেখা; প্রকার এক, ভঙ্গী ভিন্ন। আজকাল সাধু ও চলিত ভাষায় যে সাহিত্য রচনা হচ্ছে তার লক্ষণাবলী তুলনা করলে এইসকল ভেদাভেদ দেখা যায়–
(১) দুই ভাষার প্রকারভেদ প্রধানত সর্বনাম আর ক্রিয়ার রূপের জন্য। তাহারা বলিলেন, তারা বললেন।
(২) সাধুভাষার কয়েকটি সর্বনাম কালক্রমে পশ্চিমবঙ্গীয় মৌখিক রূপের কাছাকাছি এসে পড়েছে। রামমোহন রায় লিখতেন ‘তাহারদিগের’, তাথেকে ক্রমে ‘তাহাদিগের, তাহাদের’ হয়েছে। এখন অনেকে সাধুভাষাতেও ‘তাদের’ লিখছেন। ক্রিয়াপদেও মৌখিকের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। লিখা, শিখা, শুনা, ঘুরা’ স্থানে অনেকে সাধুভাষাতেও ‘লেখা, শেখা, শোনা, ঘোরা’ লিখছেন।
(৩) সর্বনাম আর ক্রিয়াপদ ছাড়াও কতকগুলি অ-সংস্কৃত ও সংস্কৃত শব্দে পার্থক্য দেখা যায়। সাধুতে উঠান, উনান, মিছা, কুয়া, সুতা, চলিতে ‘উঠন, উনন, মিছে, কুয়ো, সুতো’। কিন্তু এইরকম বহু শব্দের চলিত রূপই এখন সাধুভাষায় স্থান পেয়েছে। ‘আজিকালি, চাউল, একচেটিয়া, লতানিয়া’ স্থানে ‘আজকাল, চাল, একচেটে, লতানে’ চলছে।
(৪) সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ উভয় ভাষাতেই অবাধ। কিন্তু সাধারণত চলিতভাষায় কিছু কম দেখা যায়। এই প্রভেদ উভয় ভাষার প্রকারগত নয়, লেখকের ভঙ্গীগত, অথবা বিষয়ের লঘুগুরুত্বগত।
(৫) আরবী ফারসী প্রভৃতি বিদেশাগত শব্দের প্রয়োগ উভয় ভাষাতেই অবাধ, কিন্তু চলিতভাষায় কিছু বেশী দেখা যায়। এই ভেদও ভঙ্গীগত, প্রকারগত নয়।
(৬) অনেক লেখক কতকগুলি সংস্কৃত শব্দের মৌখিকরূপ চলিতভাষায় চালাতে ভালবাসেন, যদিও সেসকল শল্পে মূল রূপ চলিতভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। যথা—সত্য, মিথ্যা, নূতন, অবশ্য’ না লিখে সত্যি, মিথ্যে, নতুন, অবিশি। এও ভঙ্গী মাত্র।
উল্লিখিত লক্ষণগুলি বিচার করলে বোঝা যাবে যে সাধুভাষা অতি ধীরে ধীরে মৌখিক শব্দ গ্রহণ করছে, কিন্তু চলিতভাষা কিঞ্চিৎ ব্যগ্রভাবে তা আত্মসাৎ করতে চায়। সাধুভাষার এই মন্থর পরিবর্তনের কারণ তার বহুদিনের নিরূপিত পদ্ধতি। চলিতভাষার যদৃচ্ছা বিস্তারের কারণ— নিরূপিত পদ্ধতির অভাব। একের শৃঙ্খলার ভার এবং অন্যের বিশৃঙ্খলা উভয়ের মিলনের অন্তরায় হয়ে আছে। যদি লৈখিক ভাষাকে কালোপযোগী লঘু শৃঙ্খলায় নিরূপিত করতে পারা যায় তবে সাধু ও চলিতের প্রকারভেদ দূর হবে, একই লৈখিক ভাষায় দর্শন বিজ্ঞান পুরাণ ইতিহাস থেকে লঘুতম সাহিত্য পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে লেখা যেতে পারবে, বিষয়ের গুরুত্ব বা লঘুত্ব অনুসারে ভাষার ভঙ্গীর অদলবদল হবে মাত্র।