প্রথমে যখন লেখার উদ্ভাবন হল তখন তার উদ্দেশ্য ছিল অতি স্থূল নিজের জিনিস চিহ্নিত করা, সম্পত্তির হিসাব রাখা, দান-বিক্রয়াদির দলিল করা ইত্যাদি। তারপর সংবাদ পাঠাবার জন্য চিঠির এবং রাজাজ্ঞা ঘোষণার জন্য অনুশাসনলিপির প্রচলন হল। ক্রমশ লিপির প্রয়োগ আরও ব্যাপক হল, যে সাহিত্য পূর্বে শ্রুতিবদ্ধ ছিল তা লিপিবদ্ধ এবং অবশেষে মুদ্রিত হওয়ায় প্রচারের আর সীমা রইল না।
মুখের কথার প্রভাব অল্প নয়, কিন্তু বেশী লোকে তা শুনতে পায় না, যারা শোনে তারাও চিরদিন মনে রাখতে পারে না। লিপি আবিষ্কারের পূর্বে সকল বিদ্যাই গুরমুখে শুনে বার বার আবৃত্তি করে স্মৃতিপটে নিবদ্ধ করতে হত। প্রাচীন প্রথায় শিক্ষিত টোলের পণ্ডিতদের মধ্যে এখনও স্মরণশক্তির অসাধারণ উৎকর্ষ দেখা যায়, কিন্তু শুতবিদ্যা কণ্ঠস্থ করা সাধারণ লোকের সাধ্য নয়। লেখা অক্ষয় হয়ে থাকতে পারে, দরকার হলেই পড়া যেতে পারে। রচয়িতার মৃত্যু হয় কিন্তু তাঁর লেখা বহু শত বৎসর পরেও জীবিত থাকে। লেখা যদি ছাপা হয় তবে তার প্রভাব সর্ব মানবসমাজে ব্যাপ্ত হতে পারে।
আমি একটি উত্তম কাব্য বা গল্প বা ভ্রমণবৃত্তান্ত বা তথ্যমূলক গ্রন্থ পড়ছি। পড়তে পড়তে লেখকের ভাব, রসবোধ, ইন্দ্রিয়ানুভূতি, যুক্তি আর জ্ঞান আমাতেও সঞ্চারিত হচ্ছে। লেখক যা অনুভব করেছেন, কল্পনা করেছেন, দেখেছেন, বা জেনেছেন, আমিও তা যথাসাধ্য উপলব্ধি করছি। এই আশ্চর্য ব্যাপারের সাধনযন্ত্র কি? শুধুই কাগজের উপর কালির চিহ্নশ্রেণী। শুতিগ্রাহ্য বাঙ্ময় সাহিত্য দৃষ্টিগ্রাহ্য সংকেতময় হয়েছে। মুখের ভাষাও সংকেত, কিন্তু মাতৃভাষা শেখবার একটা সহজ প্রবণতা আমাদের আছে। শিশুকালে কথা বুঝতে আর বলতে সহজেই শিখেছি, লেশমাত্র আয়াস হয় নি। কিন্তু বাক্যের কৃত্রিম প্রতীক স্বরূপ অক্ষরমালা আয়ত্ত করতে কতই না কষ্ট পেয়েছি। প্রথমে লেখার অর্থ একবারেই অগ্রাহ্য ছিল, একমাত্র লক্ষ্য এক-একটি চিহ্নের পরিচয় এবং তার নাম। তার পর ধীরে ধীরে চিহ্নপরম্পরা আয়ত্ত হল, পাঠের জন্য চেষ্টার প্রয়োজন রইল না, লিখিত বাক্যের উচ্চারণ সহজ হল, অবশেষে ক্রমশ অর্থবোধ এল। শিশু রবীন্দ্রনাথ ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ পাঠ করে সাহিত্যের যে প্রথম আস্বাদ পেয়েছিলেন সকল ভাগ্যবান শিশুই তা একদিন পায়। পাখি যেমন করে তার বাচ্চাকে উড়তে শিখিয়ে আকাশচারী করে, মানুষও সেই রকমে তার সন্তানকে সংকেতের প্রয়োগ শিখিয়ে সাহিত্যচারী অর্থাৎ বিদ্যার্জনের যোগ্য করবার চেষ্টা করে। উপযুক্ত শিক্ষা এবং অভ্যাসের ফলে সংকেতের কৃত্রিমতা আর লক্ষ্য হয় না, পড়া ও লেখার শক্তি ওঠা-হাঁটার মতই স্বভাবে পরিণত হয়।
এদেশে অসংখ্য হতভাগ্য অক্ষর পরিচয়েরও সুযোগ পায় না, অনেকে কোনও রকমে অক্ষর চেনে কিন্তু অর্থ বোঝে না। সামান্য লেখাপড়া শিখেও যে শক্তিলাভ হয় তার মর্ম আমরা সহজে বুঝি না, ছেলেবেলায় অনেকের সঙ্গ থেকে যা পাওয়া যায় তা তুচ্ছ মনে হয়। কয়েক বৎসর পূর্বে একজন উড়িয়া ব্রাহ্মণকে যখন রাঁধবার কাজে বহাল করি তখন সে একটাকা বেশী মাইনে চেয়েছিল, কারণ সে চতুঃশাস্ত্রে পণ্ডিত। জানতে চাইলাম কি কি শাস্ত্র। উত্তর দিলে–পড়তে জানি, লিখতে জানি, যোগ দিতে পারি, এ-বি সি-ডি চিনি। লোকটির শাস্ত্রজ্ঞান যতই অল্প হোক, সে তার নিরক্ষর আত্মীয়স্বজনের তুলনায় শিক্ষিত–এই অসামান্যতার গৌরব সে বুঝেছিল।
স্মরণশক্তি এবং বিচারশক্তির সাহায্যের জন্য মানুষ নানারকম প্রতীক বা সংকেতের উদ্ভাবন করেছে। পদার্থবিজ্ঞানী তার আলোচ্য পদার্থের ধর্ম ও সম্বন্ধের প্রতীকস্বরূপ বিবিধ অক্ষর প্রয়োগ করেন। রসায়নী শাখাপ্রশাখাময় ফরমুলার দ্বারা বস্তুর গঠন নির্দেশ করেন। বিজ্ঞানচর্চার জন্য এই সব সংকেত অপরিহার্য কিন্তু এদের প্রকাশশক্তি অতি সংকীর্ণ। কোনও বস্তু যখন উপর থেকে নীচে পড়ে তখন তার বেগের ক্রমবৃদ্ধির হার বোঝাবার জন্য g অক্ষরটি চলে। কিন্তু এই অক্ষর দেখলে কোনও বস্তুর পতন আমাদের মনে প্রত্যক্ষবৎ অনুভূত হয় না। জলের সংকেত H20 দেখলে তৃষ্ণাহারক পানীয় বা বৃষ্টিধারা বা মহাসাগর কিছুই, মনে আসে না। সংগীতের জন্য স্বরলিপি উদ্ভাবিত হয়েছে। তা দেখে অভিজ্ঞ জন তালমান-লয়ের বিন্যাস বুঝতে পারেন, কিন্তু তাতে গান বাজনা শোনার ফল হয় না। হয়তো খুব অভ্যাস করলে স্বরলিপি পড়েই সংগীতের স্বাদ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সম্ভবত এরকম অভ্যাসের প্রয়োজন কোনও কালে হবে না। সংগীত যতই কাম্য হোক তা এমন আবশ্যক নয় যে শুতিগত সাক্ষাৎ উপলব্ধির অভাবে সংকেতজনিত কল্পনার শরণ নিতে হবে।
সত্যমূলক বা কাল্পনিক কোনও ব্যাপার প্রতিরূপিত করবার যত উপায় আছে তার মধ্যে নাটকাভিনয় শ্রেষ্ঠ গণ্য হয়, কারণ তা দেখাও যায় শোনাও যায়। তার পরেই মুখর চলচ্চিত্রের স্থান। শুনতে পাই এখন আর talkie যথেষ্ট নয়, smellie উদ্ভাবিত হচ্ছে, যাতে চিত্রার্পিত ঘটনার আনুষঙ্গিক গন্ধও পাওয়া যাবে। পরে হয়তো tastie আর touchie-র আবিষ্কারে পঞ্চেন্দ্রিয়ের তর্পণ পূর্ণ হবে, ভোজের দৃশ্যে দর্শককে খাওয়ানো এবং দাঙ্গার দৃশ্যে কিঞ্চিৎ প্রহার দেওয়া হবে। কিন্তু অভিনয় বা সিনেমা কোনটিও সহজলভ্য নয়, বিশেষ বিশেষ বিদ্যার সংকেতও আমাদের কাছে প্রত্যক্ষতুল্য নয়। লিখিত সাহিত্যই একমাত্র উপায় যাতে জ্ঞান বা অনুভূতি সঞ্চারের জন্য কোনও আড়ম্বরের দরকার হয় না, নূতন সংকেতও অভ্যাস করতে হয় না।