আর একদল রসস্রষ্টা তাদের আত্মজের প্রতি অতিমাত্রায় স্নেহশীল। তাঁরা এইসব নিগৃহীত কামনাকে বলেন—কিসের লজ্জা, কিসের ভয়? অত সাজগোজের দরকার কি, যাও, উলঙ্গ হয়ে রং মেখে নেচে এস। জনকতক লোলুপ রসলিষ্প, তাদের সমাদরে বরণ করে বলছেন—এই তো আসল আর্ট, আদিম ও চরম। কিন্তু সংযমী দ্রষ্টার দল বলেন—কখনও আর্ট নয়, আই আবিলতা থাকতে পারে না; আর্ট যদি হবে তবে ওদের দেখে আমাদের এতজনের অন্তরে এমন ঘৃণা জন্মায় কেন? সমাজপতিরা বলেন-আর্ট-ফার্ট বুঝি না; সমাজের আদর্শ ক্ষুন্ন হতে দেব না; আমাদের সব বিধানই যে ভাল এমন বলি না; যদি উৎকৃষ্টতর বিধান কিছু দেখাতে পার তোত দেখাও; কিন্তু তা যদি না পার তবে আত্মস্মৃতি বা self-expression এর দোহাই দিয়ে যে তোমরা সমাজকে উজ্জ্বল করবে, আমাদের ছেলেমেয়ে বিগড়ে দেবে, সেটি হবে না; আমরা আছি, পুলিসও আছে।
উক্ত দুই দল রসস্রষ্টার মাঝে কোনও গণ্ডি নেই, আছে কেবল মাত্রাভেদ বা সংযমের তারতম্য। ক্ষমতার কথা ধরব, কারণ অক্ষম শিল্পীর হাতে স্বর্গের চিত্রও নষ্ট হয়, গুণীর হাতে নরকবর্ণনাও হৃদয়গ্রাহী হয়। কোন্ সীমায় সুরুচির শেষ আর কুরুচির আরম্ভ তারও নির্ধারণ হতে পারে না। এক যুগ এক দল যাকে উত্তম আর্ট বলবে, অপর যুগ অপর দল তার নিন্দা করবে, আর সমাজ চিরকালই আর্ট সম্বন্ধে অনধিকারচর্চা করবে।
বিধাতার রচনা জগৎ, মানুষের রচনা আর্ট। বিধাতা একা, তাই তার সৃষ্টিতে আমরা নিয়মের রাজত্ব দেখি। মানুষ অনেক, তাই তাঁর সৃষ্টি নিয়ে এত বিতণ্ডা। এই সৃষ্টির বীজ মানুষের মনে নিহিত আছে, তাই বোধ হয় প্রতীচ্য মনোবিদের ‘লিবিডো’ আর ঋষিপোক্ত কাম–
কামস্তদগ্ৰে সমবর্তাধি মনসো রেতঃ প্রথমং যদাসীৎ
সতত বংধুমতি নিরবিংদন্ হৃদি প্রতীত্যা কবয়ো মনীষা।
(ঋগবেদ, ১০ম. ১২৯ সূ)
কামনার হ’ল উদয় অগ্রে, যা হ’ল প্রথম মনের বীজ।
মনীষী কবিরা পর্যালোচনা করিয়া করিয়া হৃদয় নিজ
নিরূপিলা সবে মনীষার বলে উভয়ের সংযোগের ভাব,
অসৎ হইতে হইল কেমনে সতের প্রথম আবির্ভাব।
(শ্রীশৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা কৃত অনুবাদ)
ঋষি অবশ্য বিশ্বসৃষ্টির কথাই বলছেন, এবং ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ শব্দের আধ্যাত্মিক অর্থই ধরতে হবে। কিন্তু সৎ-অসৎ-এর বাংলা অর্থ ধরলে এই সূক্তটি আর্ট সম্বন্ধেও প্রয়োজ্য। ফ্রয়েডপন্থীর সিদ্ধান্ত অনুসারে অসদবস্তু কাম থেকে সদবস্তু আর্ট উৎপন্ন হয়েছে। মনীষী কবিরা নিজ নিজ হৃদয় পর্যালোচনা করে হয়তো আপন অন্তরে আর্টের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু জনসাধারণের উপলব্ধি এখনও অস্ফুট। কি আর্ট, আর কি আর্ট নয়—বিজ্ঞান আজও নিরূপিত করতে পারে নি, অতএব সুরুচি কুরুচি সুনীতি দুর্নীতির বিবাদ আপাতত চলবেই। যদি কোনও কালে আর্টের লক্ষণ নিধারিত হয়, তাহলেও সমাজের শঙ্কা দূর হবে কিনা সন্দেহ। রস কি তা আমরা বুঝি কিন্তু বোঝাতে পারি না। আর্টের প্রধান উপাদান রস, কিন্তু তার অন্য অঙ্গও আছে তাই আর্ট আরও জটিল। চিনি বিশুদ্ধ রসব, কিন্তু শুধু তিনি তুচ্ছ আর্ট। চিনির সঙ্গে অন্যান্য সবস্তুর নিপুণ মিলনই আর্ট। কিন্তু যেসব উপাদান আমরা হাতের কাছে পাই তার সবগুলি অখণ্ড বসবস্তু নয়, অল্পবিস্তর অবান্তর খাদ আছে। নির্বাচনের দোৰে মাত্ৰাজ্ঞানের অভাবে অতিরিক্ত বাজে উপাদান এসে পড়ে, অভীষ্ট স্বাদে অবাঞ্ছিত স্বাদ জন্মায়। তার উপর আবার ভোক্তার পূর্ব অভ্যাস আছে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা আছে, ব্যক্তিগত রাগদ্বেষ আছে। এত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে, তোক্তার রুচি গঠিত করে, কল্যাণের অন্তরায় নাহয়ে, যার সৃষ্টি স্থায়ী হবে, তিনিই শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা।
সংকেতময় সাহিত্য
যে আবিষ্কার বা উদ্ভাবন আমাদের সমকালীন তার মূল্য আমরা সহজে ভুলি না। রেলগাড়ি টেলিফোন মোটর সিনেমা রেডিও প্রভৃতির আশ্চর্য এখনও আমাদের মন থেকে লুপ্ত হয় নি। আধুনিক সভ্যতার এইসব ফল ভোগ করছি বলে আমরা ধন্যজ্ঞান করি, যদিও মনের গোপন কোণে একটু দীনতাবোধ থাকে যে উদ্ভাবনের গৌরব আমাদের নয়।
কিন্তু যে আবিষ্কার অত্যন্ত পুরাতন, কিংবা যে বিষয়ের পরিণতি প্রাচীনকালের বহু মানবের চেষ্টায় ধীরে ধীরে হয়েছে, তার সম্বন্ধে এখন আর আমাদের বিস্ময় নেই। দীর্ঘকাল ব্যবহারে আমরা এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে তার উপকারিতা মোটর সিনেমা রেডিওর চেয়ে লক্ষগুণ বেশী হলেও আমরা তা অকৃতজ্ঞচিত্তে আলো বাতাসের মতই সুলভ জ্ঞান করি। আগুন কৃষি আর বয়নবিদ্যার আবিষ্কার কে করেছিল তা জানবার উপায় নেই। এগুলির উপর আমরা একান্ত নির্ভর করি, কিন্তু এদের অভাবে আধুনিক জীবনযাত্রা যে অসম্ভব হত তা খেয়াল হয় না। এইসব বিষয়ের চেয়েও যা আশ্চর্য, যার জন্য মানবসভ্যতা ক্রমশ উন্নতিলাভ করেছে, যার প্রভাবে শুধু ঐশ্বর্যবৃদ্ধি নয়, বুদ্ধি আর চিত্তেরও উৎকর্ষ হয়েছে, যার উপযুক্ত প্রয়োগে হয়তো একদিন সমগ্র মানবজাতি একসত্তায় পরিণত হবে–এমন একটি বিষয়ের উদ্ভাবন পুরাকালে হয়েছিল, এবং তার প্রসার এখনও হচ্ছে। এই অসীম শক্তিশালী পরম সহায়ের নাম ‘সাহিত্য’।
Literature শব্দের মৌলিক অর্থ–লিখিত বিষয়। ‘সাহিত্য’ শব্দের মৌলিক অর্থ–সহিতের ভাব বা সম্মেলন, যার ফলে বহু মানব একক্রিয়ায়ী বা এক ভাবে ভাবিত হয়। এমন সার্থক আর ব্যাপক নাম বোধ হয় অন্য ভাষায় নেই। ভাব প্রকাশের আদিম উপায় অঙ্গভঙ্গী ও শব্দভঙ্গী, তার পর এল বাক্য। সুভাষিত বাক্য যখন বলা হল এবং শুনে মনে রাখা হল তখনই সাহিত্যের উৎপত্তি; শ্রুতি আর স্মৃতিই এদেশের প্রথম সাহিত্য। প্রথম যুগে যখন বাক্যই সম্বল ছিল তখন সাহিত্যের দেবী হলেন বাণী বা বাগদেবী। সংগীত আর লেখার উৎপত্তির পর বাগদেবী বীণাপুস্তকধারিণী হলেন। এখন সাহিত্যের দেবী রাশি রাশি মুদ্রিত পুস্তকে অধিষ্ঠান করে বিশ্বব্যাপিনী হয়েছেন।