সর্বপ্রকার শিল্প এবং ব্যবসায়ের পথই এইরূপ অম্লাধিক দুর্গম। শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করা যাহার ব্যবসায়, সে ঠিক কি প্রণালী অবলম্বন করে এবং কোন উপায়ে ব্যবসায়ের কঠোর প্রতিযোগিতা হইতে আত্মরক্ষা করে তাহা অপরকে জানিতে দেয় না। সুতরাং technical education পাইলেই ব্যবসায়বুদ্ধি জন্মিবে না এবং শিল্পের প্রতিষ্ঠা হইবে না। চাকরি মিলিতে পারে, কিন্তু তাহার ক্ষেত্র সংকীর্ণ, কারণ দেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পের সংখ্যা অল্প। শিক্ষা শেষ হইলেই অধিকাংশ যুবক স্বাধীন কারবার আরম্ভ করিতে পারিবে ইহা দুরাশা মাত্র।
যাহা বলা হইল তাহার ব্যতিক্রমের উদাহরণ অনেক আছে। অনেক দৃঢ়সংকল্প উদ্যোগী ব্যক্তি কেবল পুথিগত বিজ্ঞান চর্চা করিয়া কিংবা বিজ্ঞানের কোনও চর্চা না করিয়া এবং অপরের সাহায্য না পাইয়াও শিল্পপ্রতিষ্ঠার সুযোগ ‘লাভ করিয়াছেন। বিজ্ঞানচর্চা এবং কার্যকরী শিক্ষার বিস্তারের ফলে এই সুযোগ বর্ধিত হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। অর্থাৎ পূর্বে যদি এক লক্ষ শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে একজন শিল্পপ্রতিষ্ঠায় কৃতকার্য হইয়া থাকেন, তবে এখন হয়তো দশজন হইবেন। নুতন শিক্ষাপদ্ধতি হইতে আমরা এইমাত্র আশা করিতে পারি যে কয়েকজনের নূতনপ্রকার চাকরি মিলিবে এবং কয়েকজন অনুকূল অবস্থায় পড়িলে স্বাধীন ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবে। কিন্তু অধিকাংশের ভাগ্যে কোনও প্রকার সুবিধা লাভ হইবে না।
Technical educationকে নিরর্থক প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কেবল ইহাই বলিতে চাই—যদি ছাত্রগণ অত্যধিক সংখ্যায় নির্বিচারে এই পথে জীবিকার সন্ধানে আসেন তবে তাঁহাদের অনেকেই বিফলমনোরথ হইবেন। কারণ, নূতন শিল্পের প্রতিষ্ঠা সহজসাধ্য নয়, এদেশে কারখানাও এত নাই যাহাতে যথেষ্ট চাকরি মিলিতে পারে। বিজ্ঞান সকলের রুচিকরও নয়। অতএব জীবিকালাভের অপেক্ষাকৃত সুগম পন্থা আর কিছু আছে কিনা দেখা উচিত।
বাংলাদেশ পরদেশীতে ভরিয়া গিয়াছে। তাহাদের এক দল এদেশের কুলী মজুর ধোবা নাপিত কামার কুমার মাঝী মিস্ত্রীকে স্থানচ্যুত করিতেছে, আর এক দল দেশী বণিকের হাত হইতে ছোট বড় সকল ব্যবসায় কাড়িয়া লইতেছে এবং নূতন ব্যবসায়ের পত্তন করিতেছে। শিক্ষিত বাঙালী লোলুপ নেত্রে এই শেষোক্ত দলের কীর্তি দেখিতেছে কিন্তু তাহাদের পদ্ধতিতে দন্তস্ফুট করিতে পারিতেছে না। এইসকল পরদেশী ইংরেজী বিদ্যা জানে না, economics বোঝে না, ইহাদের হিসাবের প্রণালীও আধুনিক book-keeping হইতে অনেক নিকৃষ্ট, অথচ বাণিজ্যলক্ষ্মী ইহাদের ঘরেই বাসা লইয়াছেন। ইহারা বিজ্ঞানের খবর রাখে না, নূতন শিল্প প্রতিষ্ঠা করিতেও খুব ব্যস্ত নয়, কারণ ইহারা মনে করে পণ্য উৎপাদন অপেক্ষা পণ্য লইয়া কেনাবেচা করাই বেশী সহজ এবং তাহাতে লাভের নিশ্চয়তাও অধিক। ইহারা নির্বিচারে দেশী বিলাতী প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় উপকারী অপকারী সকল পণ্যের উপরেই ব্যবসায়ের জাল ফেলিয়াছে। উৎপাদকের ভাণ্ডার হইতে ভোক্তার গৃহ পর্যন্ত বিস্তৃত ঋজুকুটিল নানা পথের প্রত্যেক ঘাটিতে দাঁড়াইয়া ইহারা পণ্য হইতে লাভ আদায় করিয়া লইতেছে।
শিক্ষিত বাঙালী কতক ঈর্ষার বশে কত অজ্ঞতার জন্য এইসকল পরদেশীর কার্যপ্রণালী হেয় প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করেন। ইহারা বর্বর অশিক্ষিত দুর্নীতিপরায়ণ, টাকার জন্য দেশের সর্বনাশ করিতেছে। ইহারা লোটাকম্বল সম্বল করিয়া এদেশে আসে; যা-তা খাইয়া যেখানে সেখানে বাস করিয়া অশেষ কষ্ট স্বীকার করিয়া কৃপণের তুল্য অর্থসঞ্চয় করে। ধনী হইলেও ইহারা মানসিক সম্পদে নিঃস্ব। ভদ্র বাঙালী অত হীনভাবে জীবিকানির্বাহ আরম্ভ করিতে পারে না, তাহার ভব্যতার একটা সীমা আছে যাহার কমে তাহার চলে না। অতএব দখোদরের জন্য সে খোট্টার শিষ্য হইবে না।
অনেক বৎসর পূর্বে ইংরেজের মহিমায় মুগ্ধ হইয়া বাঙালী ভাবিয়াছিল-ইংরেজের চালচলন অনুকরণ না করিলে উন্নতির আশা নাই। সে ভ্রম এখন গিয়াছে, বাঙালী বুঝিয়াছে মোটা। চালচলনের সঙ্গে বিদ্যা বুদ্ধি উদ্যমের কোনও বিবোধ নাই। এখন আবার অনেকে ভ্রমে পড়িয়া ভাবিতেছেন—খোট্টার অধিকৃত ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠালাভ করিতে হইলে জীবনযাত্রার প্রণালী অবনত করিতে হইবে এবং মানসিক উন্নতির আশা বিসর্জন দিতে হইবে।
ভদ্র জীবিকা যাহারা বাঙালীর মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইতেছে তাহাদের অনেক দোষ থাকিতে পারে, কিন্তু এমন মনে করার কোনও হেতু নাই যে ঐসকল দোষের জন্যই তাহারা প্রতিযোগে জয়ী হইয়াছে। নিরপেক্ষ বিচারে ইহাই প্রতিপন্ন হইবে যে বাঙালীর পরাভব তাহার নিজের ত্রুটির জন্যই হইয়াছে।
এইসকল পরদেশী বণিকের শিক্ষা ও পরিবেষ্টন সযত্ন অনুসন্ধানের যোগ্য। ইহারা জন্মাবধি বণিবৃত্তির আবহাওয়ায় লালিত হইয়াছে এবং আত্মীয়স্বজনের নিকটেই দীক্ষা লাভ করিয়াছে। বাঙালী কেরানী মার্চেন্ট অফিসে গিয়া নির্লিপ্ত face invoice voucher day-book ledger Farfaranny দিনগত পাপক্ষয় করিয়া আসে, মনিবের সহিত তাহার কেবল বেতনের সম্পর্ক। সে নিজের নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করে মাত্র, মনিবের সমগ্র ব্যবসায় বুঝিবার তাহার সুযোগও নাই স্বার্থও নাই। ভারতীয় বণিকের অনেক কাজ গৃহেই নিষ্পন্ন হয়। তাহার সহায়তা করিয়া বশিকপুত্র অল্প বয়সেই পৈতৃক ব্যবসায়ের রস গ্রহণ করিতে শেখে, এবং কেনা বেচা আদায় উসুল জাবেদা নোকড় খতিয়ান হাতচিঠা হুণ্ডি মোকাম বাজারের গুঢ় তত্ত্বে অভিজ্ঞতা লাভ করে।