‘কারুর’ শব্দটি আজকাল খুব দেখা যাচ্ছে। এটিকে slang মনে করি। সাধু ‘কাহারও’ থেকে চলিত ‘কারও’, কথার টানে তা ‘কারু’ হতে পারে। কিন্তু আবার একটা ‘র যোগ হবে কেন?
য় অক্ষরটির দু-রকম প্রয়োগ হয়। হয়, দয়া প্রভৃতি শব্দের y-তুল্য আদিম উচ্চারণ বজায় আছে, কিন্তু হালুয়া, খাওয়া প্রভৃতি শব্দে য় স্বরচিহ্নের বাহনমাত্র, তার নিজের উচ্চারণ নেই, আমরা বলি ‘হালুআ, খাওআ’। ‘খাওয়া, যাওয়া, ওয়ালা’ প্রভৃতি সুপ্রচলিত শব্দের বর্তমান বানান আমাদের এতই অভ্যস্ত যে বদলাবার সম্ভাবনা দেখি না, যদিও যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি আ দিয়ে লেখেন, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ও অনেক ক্ষেত্রে লিখতেন, এবং প্রাচীন বাংলা লেখাতেও য়া স্থানে আ চলত। কিন্তু নবাগত বিদেশী শব্দের বানান এখনও স্থিরতা পায় নি, সেজন্য সতর্ক হবার সময় আছে। Wavell, Boer, swan, drawer প্রভৃতি শব্দ বাংলায় ‘ওআভেল, বোআর, সোজন, ড্রআর’ লিখলে য়-এর অপপ্রয়োগ হয় না। War এবং ware দুই-এরই বানান ‘ওয়ার’ করা অনুচিত, প্রথমটি ‘ওঅর’, দ্বিতীয়টি ‘ওয়ার’। ‘মেয়র, চেয়ার, সোয়েটার’ লিখলে দোষ হয় না কারণ য় য়া য়ে স্থানে অ আ এ লিখলেও উচ্চারণ প্রায় সমান থাকে।
‘ভাই-এর, বউ-এর, বোম্বাই-এ’ প্রভৃতিতে য়ে স্থানে এ লিখলে উচ্চারণ বদলায় না, কিন্তু লেখা আর বানান সহজ হয়, ব্যাকরণেও নিষেধ নেই। কেউ কেউ বলেন, দুটো স্বরবর্ণ পর পর উচ্চারণ করতে glide দরকার সে জন্য য় চাই। এ যুক্তি মানি না। ‘অতএব’ উচ্চারণ করতে তো বাধে না, য় না থাকলেও glide হয়।
সংস্কৃত শব্দে অনুস্বার অথবা অনুনাসিক বর্ণযুক্ত ব্যঞ্জন থাকলে তজ্জাত বাংলা শব্দে প্রায় চন্দ্রবিন্দু আসে, যেমন ‘হংস পঙ্ক পঞ্চ কণ্টক চন্দ্র চম্পা’ থেকে ‘হাঁস পাঁক পাঁচ কাঁটা চাঁদ চাঁপা’। কয়েকটি শব্দে অকারণে চন্দ্রবিন্দু হয়, যেমন ‘পেচক, চোচ’ থেকে ‘পেঁচা, চোঁচ’। তা ছাড়া অনেক অজ্ঞাতমূল শব্দেও চন্দ্রবিন্দু আছে, যেমন ‘কাঁচা গোঁজা বাঁটা’। পশ্চিমবঙ্গে চন্দ্রবিন্দুর বাহুল্য দেখা যায়। অনেকে ‘একঘেঁয়ে, পায়ে ফোঁড়া, থান ইট’ লেখেন, যদিও চন্দ্রবিন্দুহীন বানানই বেশী চলে। ‘কাঁচ, হাঁসি, হাঁসপাতাল’ অনেকে বলেন, কিন্তু লেখবার সময় প্রায় চন্দ্রবিন্দু দেন না। পূর্ববঙ্গী অনুনাসিক উচ্চারণে অভ্যস্ত নন, সেজন্য বানানের সময় মুশকিলে পড়েন, যথাস্থানে চন্দ্রবিন্দু দেন না, আবার অস্থানে দিয়ে ফেলেন। সন্দেহ হলে অভিধান দেখে মীমাংসা হতে পারে কিন্তু যদি পূর্বসংস্কার দৃঢ় থাকে তবে সন্দেহই হবে না, ফলে বানান ভুল হবে। আর এক বাধা–পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত লোকও সকল ক্ষেত্রে একমত নন। যদি বিভিন্ন জেলার কয়েক জন বিদ্বান ব্যক্তি একত্র হয়ে চন্দ্রবিন্দুর প্রয়োগ সম্বন্ধে একটা রফা করেন এবং সংশয়জনক সমস্ত শব্দের বানান দিয়ে একটি তালিকা তৈরী করেন তবে তার বশে সহজেই বানান নিরূপিত হবে।
চন্দ্রবিন্দু সম্বন্ধে যা বলা হল, ড সম্বন্ধেও তা খাটে। পূর্ববঙ্গে ড় আর র প্রায় অভিন্ন, সেজন্য লেখার বিপর্যয় ঘটে। পশ্চিমবঙ্গেও অনেক শব্দে মতভেদ আছে। এক্ষেত্রেও তালিকার প্রয়োজন।
.
মোট কথা–(১) অসংস্কৃত শব্দের বানান সাধারণত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত-জনের উচ্চারণের বশে করতে হবে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মীমাংসার প্রয়োজন আছে। অন্ধভাবে জনকতকের বানানকেই প্রামাণিক গণ্য করলে অন্যায় হবে। (২) বানানে অতিরিক্ত অক্ষরযোগ অনর্থকর, তাতে জটিলতা আর বিশৃঙ্খলা বাড়ে। (৩) সর্বত্র উচ্চারণের নকল করবার দরকার নেই, পাঠক প্রকরণ (context) থেকেই উচ্চারণ বুঝবে। (৪) সাধুভাষার বানান আপনিই কালক্রমে অনেকটা সংযত হয়েছে, কিন্তু মৌখিকের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় চলতি ভাষায় সহজে তা হবে না–যদি না লেখকেরা উদ্যোগী হয়ে সমবেত ভাবে চেষ্টা করেন।
ভদ্র জীবিকা
বাংলার ভদ্রলোকের দুরবস্থা হইয়াছে তাহাতে দ্বিমত নাই। দেশের অনেক মনীষী প্রতিকারের উপায় ভাবিতেছেন এবং জীবিকানির্বাহের নূতন পন্থা নির্দেশ করিতেছেন। কিন্তু বর্তমান সমস্যার সমাধান যে উপায়েই হউক, তাহা শীঘ্ন ঘটিয়া উঠিবে না। রোগের বীজ ধীরে ধীরে সমাজে ব্যাপ্ত হইয়াছে, ঔষধনির্বাচন মাত্রই রোগমুক্তি হইবে না। সতর্কতা চাই, ধৈর্য চাই, উপায়ের প্রতি শ্রদ্ধা চাই। রোগের নিদান একটি নয়, নিবারণের উপায়ও একটি হইতে পারে না। যে যে উপায়ে প্রতিকার সম্ভবপর বোধ হয় তাহার প্রত্যেকটি সাবধানে নির্বাচন করা উচিত, নতুবা ভুল পথে গিয়া দুর্দশার কালবৃদ্ধি হইবে।
দুর্দশা কেবল ভদ্রসমাজেই বর্তমান এমন নয়। কিন্তু সমগ্র বাঙালীসমাজের অবস্থার বিচার আমার উদ্দেশ্য নয়, সেজন্য কেবল তথাকথিত ভদ্ৰশ্রেণীর কথাই বলিব। ভদ্র’ বলিলে যে শ্রেণী বুঝায় তাহাতে হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান সকলেই আছেন। অন্যধর্মীর ভদ্রসমাজে ঠিক কি ভাবে পরিবর্তন ঘটিয়াছে তাহা আমার জানা নাই, সেজন্য হিন্দু ভদ্রের কথাই বিশেষ করিয়া বলিব। প্রতিকারের পন্থা যে সকলের পক্ষেই সমান তাহা বলা বাহুল্য।
ভদ্র জীবিকা শতাধিক বৎসর পূবে ‘ভদ্র’ বলিলে কেবল ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ এবং অপর কয়েকটি সম্প্রদায় মাত্র বুঝাইত। ভদ্রের উৎপত্তি প্রধানত জন্মগত হইলেও একটা গুণকর্মবিভাগজ বিশিষ্টতা সেকালেও ছিল। ভদ্রের প্রধান বৃত্তি ছিল জমিদারি জমির উপসত্ত্ব ভোগ, জমিদারের অধীনে চাকরি, অথবা তেজারতি। বহু ব্রাহ্মণ যাজন ও অধ্যাপনা দ্বারা জীবিকানির্বাহ করিতেন, অধিকাংশ বৈদ্য চিকিৎসা করিতেন। ভদ্ৰশ্রেণীর অল্প কয়েকজন রাজকার্য করিতেন, এবং কদাচিৎ কেহ কেহ নবাগত ইংরেজ বণিকের অধীনে চাকরি লইতেন। বাণিজ্যবৃত্তি নিম্নতর সমাজেই আবদ্ধ ছিল। ভদ্র গৃহস্থ প্রতিবেশী ধনী বণিককে অবজ্ঞার চক্ষুতেই দেখিতেন। উভয় গৃহস্থের মধ্যে সামাজিক সদ্ভাব থাকিলেও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। উচ্চবর্ণের লোকেরা জমিদারি এবং মামলা পরিচালনের দক্ষতাকেই বৈষয়িক বিদ্যার পরাকাষ্ঠা মনে করিতেন, প্রতিবেশী বণিক কোন্ বিদ্যার সাহায্যে অর্থ উপার্জন করিতেছেন তাহার সন্ধান লইতেন না। বণিকের জাতিগত নিকৃষ্টতা এবং অমার্জিত আচারব্যবহারের সঙ্গে তাহার অর্থকরী বিদ্যাও ভদ্র সমাজে উপেক্ষিত হইত। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এখনও বর্তমান, কেবল প্রভেদ এই বাঙালী বণিকও তাঁহাদের বংশ পরম্পরালব্ধ বিদ্যা হারাইতে বসিয়াছেন। আর, যাঁহারা ভদ্র বলিয়া গণ্য তাহারা এতদিন তাহাদের অতি নিকট প্রতিবেশীর কার্যকলাপ সম্বন্ধে অন্ধ থাকিয়া আজ হঠাৎ আবিষ্কার করিয়াছেন যে ব্যবসায় না শিখিলে তাহাদের আর চলিবে না।