.
সাধুভাষায় বানানের অসাম্য খুব বেশী দেখা যায় না। বহু বৎসর পূর্বে এই ভাষা যে অল্প কয়েক জনের হাতে পরিণতি পেয়েছিল তারা তখনকার শিক্ষিত সমাজের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। বাংলা দেশের সব জেলার সাহিত্যসেবী তাদের অনুকরণ করে চলতেন, সেজন্য সাধু ভাষার বানান মোটের উপর সুনির্দিষ্ট হতে পেরেছে। চলিত ভাষার প্রচলন যখন আরম্ভ হল তখন এদেশে সাহিত্যচর্চা এবং লেখকদের আত্মনির্ভরতা বেড়ে গেছে। বহু লেখক চলিতভাষার প্রকাশশক্তি দেখে আকৃষ্ট হলেন, কিন্তু লেখার উৎসাহে তারা নূতন পদ্ধতি আয়ত্ত করবার জন্য যত্ন নিলেন না, মনে করলেন–এ আর এমন কি শক্ত। এই ভাষায় ক্রিয়াপদ আর সর্বনাম ভিন্ন প্রকার, অন্য কতকগুলি শব্দেও কিছু প্রভেদ আছে, এবং এই সমস্ত শব্দের বানান পূর্বনির্ধারিত নয়। পাঠ্যপুস্তকেও চলিতভাষা শেখাবার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। এই কারণে চলিতভাষায় বানানের অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা দেখা যায়।
চলিতভাষা এবং কলকাতা বা পশ্চিমবাংলার মৌখিক ভাষা সমান নয়, যদিও দু-এর মধ্যে কতকটা মিল আছে। লোকে লেখবার সময় যত সতর্ক হয় কথা বলবার সময় তত হয় না। একমাত্র রবীন্দ্রনাথকেই দেখেছি যাঁর কথা আর লেখার ভাষা সমান। লেখার ভাষা, বিশেষত সাহিত্যের ভাষা, কোনও জেলার মধ্যে আবদ্ধ হলে চলে না, তার উদ্দেশ্য সকলের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান। এজন্য চলিতভাষাকে সাধুভাষার তুল্যই নিরূপিত বা standardized হতে হবে। মুখের ভাষা যে অঞ্চলেরই হোক, মুখের ধ্বনি মাত্র, তা শুনে বুঝতে হয়। লেখার বা সাহিত্যের ভাষা পড়ে বুঝতে হয়। মৌখিক ভাষার উচ্চারণই সর্বস্ব এবং তার প্রয়োগের ক্ষেত্র অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। সাহিত্যের ভাষা সর্বজনীন, তার চেহারাটাই আসল, উচ্চারণ সকলের সমান না হলেও ক্ষতি হয় না। চলিতভাষা সাহিত্যের ভাষা, সুতরাং তার বানান অবহেলার বিষয় নয়।
অনেকে বলেন, উচ্চারণের অনুযায়ী বানান হওয়া উচিত। হলে ভাল হয় সন্দেহ নেই, কিন্তু কার্যত তা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। কার উচ্চারণের বশে বানান হবে? জেলায় জেলায় প্রভেদ, অনেক শিক্ষিত পশ্চিমবঙ্গী মিচে কতা’ (মিছে কথা) বলেন, অনেক পূর্ববঙ্গী তারাতারি’ (তাড়াতাড়ি) বলেন, কিন্তু লেখবার সময় সকলেই প্রামাণিক বানান অনুসরণের চেষ্টা করেন। দৈবক্রমে কলকাতা বাংলা দেশের রাজধানী এবং বহু সাহিত্যিকের মিলনক্ষেত্র। এই কারণে কলকাতার মৌখিক ভাষা একটা মর্যাদা পেয়েছে এবং তার উপাদান ব্যক্তি বা দলবিশেষ থেকে আসে নি, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের গড় (average) উচ্চারণ থেকেই এসেছে। যে অল্পসংখ্যক লেখকদের চেষ্টায় চলিতভাষার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যেমন রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ইত্যাদি, তাঁদের প্রভাব অবশ্য কিছু বেশী। আদি লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রভাবও নগণ্য নয়। তা ছাড়া সাধুভাষার অসংখ্য শব্দ তাদের পূর্বনিরূপিত বানান সমেত এসেছে। চলিতভাষা একটা synthetic ভাষা এবং কতকটা কৃত্রিম। এই কারণে তার বানান সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার, কিন্তু উচ্চারণ পাঠকদের অভ্যাস এবং রুচির উপর ছেড়ে দিলে বিশেষ ক্ষতি হবে না।
সাধুভাষায় লেখা হয় করিতেছে, বসিবে, পড়া হয় ‘কোরিতেছে, বোসিবে’। চলিতভাষায় অতিরিক্ত ও-কার, যুক্তাক্ষর এবং হস্-চিহ্ন দিয়ে ‘কোর্চ্ছে, বোস্বে’ ইত্যাদি লেখবার কোনও দরকার দেখি না, ‘করছে, বসবে’ লিখলেই কাজ চলে। সুপ্রচলিত শব্দের বানানে অনর্থক অক্ষরবৃদ্ধি করলে জুটিলতা বাড়ে, সুবিধা কিছুই হয় না। শিক্ষার্থীকে অন্যের মুখে শুনেই উচ্চারণ শিখতে হবে। অবশ্য নবাগত বিদেশী শব্দের বানান যথাসম্ভব উচ্চারণসূচক হওয়া উচিত।
বাংলায় শব্দের শেষে যদি অযুক্তাক্ষর থাকে এবং তাতে স্বরচিহ্ন না থাকে, তবে সাধারণত হসন্তবৎ উচ্চারণ হয়। শব্দের দ্বিতীয় অক্ষরেও প্রায় এই রকম হয়। আমরা লিখি চটকল, আমদানি, খোশমেজাজ’, হচিহ্নের অভাবে উচ্চারণ আটকায় না। ব্যতিক্রম অবশ্য আছে, খুব বেশী নয়। উচ্চারণের এই সাধারণ রীতি অনুসারে অধিকাংশ শব্দে হচিহ্ন না দিলেও কিছুমাত্র বাধা হয় না। অনেকের লেখায় দেখা যায়–কুঙ্কাওয়াজ, টি-পট, সুটকেস্। এই রকম হচিহ্নের বাহুল্যে লেখা আর ছাপা কণ্টকিত করায় কোনও লাভ নেই। যদি ভবিষ্যতে বাংলা অক্ষর সরল করবার জন্য যুক্তব্যঞ্জন তুলে দেওয়া হয়, তখন অবশ্য হচিহ্নের বহুপ্রয়োগ দরকার হবে।
.
আজকাল ও-কারের বাহুল্য দেখা যাচ্ছে। অনেকে সাধুভাষাতেও ‘কোরিলো’ লিখছেন। এতে বিদেশী পাঠকের কিছু সাহায্য হতে পারে, কিন্তু বাঙালীর জন্য এরকম বানান একেবারে অনাবশ্যক। আমরা ছেলেবেলায় যে রকমে শিখি-বর্গীয় জ-এ ইঁও গ-গঁ, শীত’-এর উচ্চারণ হসন্ত কিন্তু ‘ভীত’ অকারান্ত, ‘অভিধেয়’ আর ‘অবিধেয়’ শব্দের প্রথমটির অ ও-তুল্য কিন্তু দ্বিতীয়টির নয়, সেই রকমেই শিখব—’করিল’ আর ‘কপিল’-এর বানান একজাতীয় হলেও উচ্চারণ আলাদা। যাঁরা পদ্যে অক্ষর সংখ্যা সমান রাখতে চান, তাঁদের ‘আজো, আরো’ প্রভৃতি বানান দরকার হতে পারে, কিন্তু সাধারণ প্রয়োগে আজও, আরও’ হবে না কেন? ও-কারের চিহ্ন লিখতে যে সময় আর জায়গা লাগে, আস্ত ও লিখতে তার চেয়ে বেশী লাগে না। আমরা লিখি–’সেদিনও বেঁচে ছিল, ভূতপ্রেতও মানে না, অতও ভাল নয়, দুধও খায় তামাকও খায়। ও প্রত্যয় নয়, একটি অব্যয়শব্দ, মানে–অপি, অধিকন্তু, also, even। অব্যয় শব্দের নিজের রূপ নষ্ট করা অনুচিত। ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা নেই, আমরা ‘তামা-কও’ পড়ি না, ‘তামাক্-ও’ পড়ি; সেই রকম লিখব ‘আজই, আজও’, পড়ব আজ-ই, আজও। সর্বত্র সংগতিরক্ষা আবশ্যক।