২১ ১২১ ১২১১২২।
১১ ১১২২ ১১১ ১২২
২১১২ ১১২২২২
২২ ২১ ১২১১ ২২
সংস্কৃত পদ্যে চরণের শেষে মিল কম দেখা যায়। যা আছে তা প্রায় মাত্রাচ্ছন্দে, যেমন পজঝটিকায়, গীতগোবিন্দে, কজ্জলপূরিতলোচনভারে প্রভৃতি স্তোত্রে। কারণ বোধ হয় এই–অক্ষরচ্ছন্দে অক্ষরবিন্যাস ভেদে নিয়মিত, পর্যায়ক্রমে তার আবর্তন হয়। এমন ছন্দের মাধুর্য মিলের উপর নির্ভর করে না। মাত্রাচ্ছন্দে এই আবর্তনের অভাবে কিঞ্চিৎ আকাঙ্ক্ষা রয়ে যায়, তার পূরণের জন্যই মিলের চেষ্টা। অথবা এও হতে পারে যে চরণের মিল করতে গেলে অক্ষরচ্ছন্দের কড়া নিয়ম মানা শক্ত হয়, তাই পদ্যকার অপেক্ষাকৃত স্বাধীন মাত্রাচ্ছন্দের শরণ নেন।
বাংলা ছন্দ
বাংলা ছন্দের প্রচলিত শ্রেণী তিনটি। সাধারণত তাদের নাম দেওয়া হয়–অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। তা ছাড়া সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণও কিছু চলে। বাংলায় স্বতেদীর্ঘ স্বর নেই, কিন্তু ছন্দের শ্রেণীবিশেষে ঐ ঔ দীর্ঘ হয় এবং পরতোদীর্ঘ ও কৃত্রিমদীর্ঘ স্বরও চলে।
বাংলা ছন্দের সাধারণ লক্ষণ–চরণের নিয়ত মাত্ৰাসংখ্যা, যেমন অধিকাংশ সংস্কৃত ছন্দে। অনেক আধুনিক ছন্দের চরণ অত্যন্ত অসমান, তথাপি তার জন্য সুশ্রাব্যতার হানি হয় না, বরং বৈচিত্র্য হয়। কিন্তু এইসব ছন্দের সূত্র-নিরূপণ অসম্ভব। শুধু বলা যেতে পারে যে অমুক পদ্যের শব্দগুলির মাত্রা অমুক শ্রেণীর রীতিতে ধরা হয়েছে। কিন্তু তাও আবার সর্বত্র স্থির করা যায় না।
অক্ষরবৃত্ত
অক্ষরবৃত্তের উদাহরণ সাধারণ পয়ার ত্রিপদী ইত্যাদি। এই শ্রেণীর ছন্দের প্রধান লক্ষণ–চরণের নিয়ত হরফ-সংখ্যা, যেমন পয়ারের প্রতি চরণে ১৪ হরফ। স্বরান্ত ব্যঞ্জন, হচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন, যুক্তব্যঞ্জন, অনেক স্থলে অনুস্বার পর্যন্ত নির্দিষ্ট সংখ্যার মধ্যে ধরা হয়, কেবল বিসর্গ ধরা হয় না। ঐ এক হরফ, কিন্তু ওই দু হরফ। সর্দার ৩ হরফ, কিন্তু দরকার হলে সরদার লিখে ৪ হরফ করা যায়। বান্দেবী আর বাগদেবী একই শব্দ, অথচ প্রথমটির ৩ হরফ দ্বিতীয়টির ৪ হরফ ধরা হয়। আসল কথা–হরফের হিসাব একটা কৃত্রিম চাক্ষুষ উপায়। ছন্দের ব্যঞ্জন মুখে, ধারণা কানে। মুখ আর কানের সাক্ষ্য নিয়েই সূত্রনির্ণয় করতে হবে।
পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল,
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল!
যদি প্রত্যেক হরফ স্বরান্ত করে পড়া হয় তবে বলা যেতে পারে–প্রতি চরণে ১৪ হরফ, ১৪ অক্ষর, ১৪ মাত্রা। কিন্তু যদি সহজ রীতিতে পড়া হয় তবে হসন্ত উচ্চারণের উপর নজর রেখে এইরকমে অক্ষর ভাগ করা যেতে পারে
পা-খি সব ক-রে রব রা-তি পো-হা-ই-ল,
কা-ন-নে কু-সুম-ক-লি স-ক-লি ফু-টি-ল।
প্রথম চরণে ১২ অক্ষর, দ্বিতীয়তে ১৩। হসন্ত উচ্চারণের জন্য সব, রব,–সুম এই ৩ অক্ষর পরতোগুরু হয়েছে, অন্য অক্ষরগুলি লঘু। দুই চরণেই ১৪ মাত্রা। কিন্তু অক্ষরবৃত্তের সূত্র এত সহজে পাওয়া যাবে না। সকল পদ্যই যুক্তাক্ষরবর্জিত শিশুপাঠ্য নয়।
বহু পরিচর্যা করি পে-য়ে-ছি-নু তো-রে,
জন্মেছিস ভর্তৃহী-না জ-রালার ক্রোড়ে।
এখানে জন্মেছিস আর জবালার এই দুই শব্দের উচ্চারণ হসন্ত, সেজন্য–ছিস ও লার এই দুই অক্ষর পরতোগুরু। কিন্তু যুক্তব্যঞ্জনের প্রভাবে পরিচর্যা, জন্মেছিস, ভর্তৃহীনা শব্দে পরতোগুরু অক্ষর উৎপন্ন হয় নি। প রি-চর্যা ৪টিই লঘু অক্ষর। চ-এর অ-কারকে চেপে হ্রস্ব করে রাখা হয়েছে, তার ফলে পরিচর্যার উচ্চারণকাল পেয়েছিনুর সমান। জন্মেছিস, ভর্তৃহীনাও এইরকম। উপরের উদাহরণে যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৪, ১৪, অক্ষরসংখ্যা ১৪, ১২, মাত্ৰাসংখ্যা ১৪, ১৪।
অক্ষরবৃত্তের রীতি–হসৃচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন বা পূর্বোক্ত দ্বিস্বর থাকলে অক্ষর পরতোগুরু হয়, কিন্তু যুক্তব্যঞ্জন বা ঐ ঔ থাকলে হয় না। বিসর্গের জন্যও হয় না, দুঃখএর দুই অক্ষরই লঘু। শব্দের মধ্যে অনুস্বার থাকলে প্রায় হয় না, কিন্তু শেষে থাকলে হয়। সংখ্যার দুই অক্ষরই লঘু, কিন্তু সুতরাংএর প্রথম দুই অক্ষর লঘু, শেষ অক্ষর গুরু।
উক্ত রীতির বশে অক্ষরবৃত্তের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা নিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত এবং সাধারণত হরফসংখ্যার সমান। অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত।
যুক্তব্যঞ্জনের জন্য অক্ষরের গুরুতা হয় না বটে, কিন্তু তার ঘাত বা ধাক্কা নিপুণ কবিরা উপেক্ষা করেন না, উপযুক্ত স্থলে প্রয়োগ করে বৈচিত্র্যসাধন করেন। পাঠকও বিশেষ বিশেষ স্বরে জোর দিয়ে ঘাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেন।
মাত্রাবৃত্ত
এই শ্রেণীর ছন্দে যুক্তব্যঞ্জন অবজ্ঞাত নয়, সেজন্য পরতোগুরু অক্ষর প্রচুর দেখা যায়। অনুস্বার, বিসর্গ, হচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন এবং যুক্তব্যঞ্জনের প্রভাবে অক্ষর পরতোগুরু হয়। যে অক্ষরে ঐ ঔ বা দ্বিস্বর আছে তাও গুরু। কিন্তু শব্দের আদিতে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে তার প্রভাব পূর্ববর্তী শব্দের অন্ত্য স্বরে প্রায় হয় না।
মাত্রাবৃত্তের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। যথা
পল্ল বঘন আম্র–কা-ন-ন রা-খা-লের খে-লা-গে-হ,
স্তব্ধ অতল দিঘি-কা-লো-জল নিশীথ-শীতল স্নেহ।