মাত্রা, স্বরের হ্রস্বদীর্ঘ ভেদ, অক্ষরের লঘুগরু ভেদ
মাত্রার অর্থ–স্বরবর্ণের উচ্চারণকাল। ব্যঞ্জনবর্ণের মাত্রা নেই, ব্যঞ্জন যে স্বরকে আশ্রয় করে তারই মাত্রা আছে। ব্যঞ্জনের মাত্রা আছে মনে করলে অনর্থক বিভ্রাট হয়। সংস্কৃতে স্বরবর্ণের হ্রস্বদীর্ঘভেদ আছে, হ্রস্বস্বরের এক মাত্রা দীর্ঘস্বরের দুই মাত্রা। ছন্দে অক্ষরেরও ভেদ ধরা হয়। যে অক্ষরের অন্তর্গত স্বর হ্রস্ব তা লঘু, যার স্বর দীর্ঘ তা গুরু। সংস্কৃত ছন্দের নিয়মে হ্রস্ব স্বরও দীর্ঘতা পায়–যদি তার পরে অনুস্বর বা বিসর্গ থাকে অথবা হচিহ্নিত ব্যঞ্জন বা যুক্তব্যঞ্জন থাকে। তা ছাড়া দরকার হলে চরণের শেষের স্বরও দীর্ঘতা পায়–
সানুস্বারশ্চ দীর্ঘশ্চ বিসর্গী চ গুরুর্ভবেৎ।
বর্ণঃ সংযোগপূর্বশ্চ তথা পাদান্তগোপি বা৷
প্রথম ও তৃতীয় চরণের আদিতে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে পূর্ববর্তী স্বরের উপর তার প্রভাব হয় না। বাংলায় হ্রস্বদীর্ঘ স্বরের স্বাভাবিক ভেদ নেই, কেবল স্থান বিশেষে ঐ ঔ দীর্ঘ হয়।
উক্ত সংস্কৃত নিয়ম অনুসারে এইসকল অক্ষরের অন্তর্গত স্বর হ্রস্ব, সেজন্য অক্ষরগুলি লঘু–অ চ কি তু নৃ প্র দ্বি ক্ষু। এইগুলি গুরু, কারণ অন্তর্গত স্বর দীর্ঘ–আ কা কী ভূ সে নৌ কিং নিঃ কিম্ পূর ন্যস্ ক্ষি। শিল্প শব্দের ই-কার দীর্ঘ, কারণ পরে যুক্তব্যঞ্জন আছে। . সংস্কৃত নিয়মে সূত আর সুপ্ত দুই এরই আদ্য স্বর দীর্ঘ–এবং অন্ত্য স্বর হ্রস্ব, সেজন্য আদ্য অক্ষর সূ, সু- গুরু এবং অন্ত্য অক্ষর–ত লঘু। কারু, দীন, শৌরি এবং সত্ত্ব, দুষ্ট, দীপ্তি, সৈন্য সবগুলিই ঐপ্রকার, একটির বদলে অন্য একটি বসালে দোষ হয় না। সূ- আর সু- অক্ষরের যে উ উ আছে তাদের উচ্চারণকাল বা মাত্রা সমান। কিন্তু সূ- আর সু- অক্ষরের ধ্বনির ওজনও কি সমান? সূ-এর উচ্চারণে টান আছে, সু-এ ঘাত বা ধাক্কা বা সহসা ধ্বনিরোধ আছে, দুটিই সমান হতে পারে না। উক্ত দুরকম অক্ষরের অনুষঙ্গী দুরকম দীর্ঘস্বরের পার্থক্যসূচক পরিভাষা আছে কিনা জানি না। কাজ চালাবার জন্য নাম দিচ্ছি–স্বতেদীর্ঘ, অর্থাৎ যে স্বর সংস্কৃতে স্বভাবত দীর্ঘ, যেমন সূতএর ঊ; পরতোদীর্ঘ, অর্থাৎ যে স্বর হ্রস্ব হলেও পরবর্তী যুক্তব্যঞ্জনাদির প্রভাবে দীর্ঘ হয়, যেমন সুপ্তএর উ। অক্ষরের ঐরকম ভেদসূচক নাম-স্বলতাগুরু, পরতোগুরু। সংস্কৃত ছন্দে এই ভেদ গ্রাহ্য হয় না–
রাগেণ বালারুণকোমলেন।
চুতপ্রবালোষ্ঠমলঞ্চকার।
প্রথম পঙক্তিতে যুক্তব্যঞ্জন নেই, দ্বিতীয়তে আছে, অথচ ছন্দ একই। বাংলা ছন্দের শ্রেণীভেদে পরতোগুরু অক্ষর মানা হয় কিন্তু ঐ ঔ ছাড়া স্বতোগুরু মানা হয় না, আবার কৃত্রিমগুরুও মানা হয়–সে কথা পরে বলব।
সংস্কৃত ছন্দে উক্ত ভেদের নিয়ম না থাকলেও নিপুণ কবি ধ্বনিবৈচিত্র্যের জুন্য স্বলতাগুরু বা পরতোগুরু অক্ষর নির্বাচন করে প্রয়োগ করেন। এই নির্বাচনের সূত্র কবির মাথাতেই থাকে, ছন্দঃশাস্ত্রে তা নেই।
অক্ষর ও মাত্রা সম্বন্ধে আর একটু বলবার আছে। কোনও শব্দের অক্ষরগুলি দুই রীতিতে পৃথক করে দেখানো যেতে পারে। প্রথম রীতি–শব্দের যুক্তব্যঞ্জন না ভাঙা, যেমন সু-প্ত, শ্রদ্ধা-বান্। কিন্তু এতে পরতোদীর্ঘতা প্রকাশ পায় না। সু- আর শ্র- এর স্বর পরতোদীর্ঘ, কিন্তু অক্ষরে তার লক্ষণ নেই। দ্বিতীয় রীতি–যথাসম্ভব যুক্তব্যঞ্জন বিশ্লেষ করা, যাতে স্বরের পরতোদীর্ঘতা (বা অক্ষরের পরতোগুরুতা) অক্ষর দেখলেই বোঝা যায়, যেমন সু-ত, শ্রদ্ধা-বান্। এই প্রবন্ধের উদাহরণে দ্বিতীয় রীতিই অনুসৃত হয়েছে। কিন্তু যে বাংলা ছন্দে যুক্তব্যঞ্জনের জন্য পূর্বস্বর দীর্ঘ হয় না সেখানে প্রথম রীতিতে অক্ষর ভাগ হয়েছে, যেমন জন্মেছিস।
সংস্কৃত ছন্দ
বাংলা ছন্দের আলোচনার আগে সংস্কৃত ছন্দের কিঞ্চিৎ পরিচয় আবশ্যক মনে করি, তাতে বাংলা ছন্দের সূত্রগঠন সহজ হবে। সংস্কৃত নিয়ম খুব বাঁধাধরা, পদ্যকারের স্বাধীনতা অল্প, সেজন্য নিয়মের সূত্র সরল। সংস্কৃতে দুই শ্রেণীর ছন্দ বেশী চলে–অক্ষরছন্দ বা বৃত্ত, এবং মাত্রাছন্দ বা জাতি।
অক্ষরছন্দের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা নিয়ত; মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাসও নিয়ত, অর্থাৎ ভেদে অক্ষর সাজাবার বাঁধা নিয়ম আছে। মিশ্র ছন্দও চলে, যেমন ইন্দ্ৰবজ্রা ও উপেন্দ্ৰবজ্রার মিশ্রণে উপজাতি ছন্দ। মন্দাক্রান্তা অমিশ্র ছন্দ, সব চরণ সমান। অক্ষর ভাগ করে তার উদাহরণ দিচ্ছি–
– ক-চিৎ কান্তা–বি-র-হ-গুরু-না স্বা-ধি-কা-র-র-মৎ-তঃ
শা-পে-না-তং-গ-মি-ত-ম-হি-মা বর্ষ-ভোগৃ-য়ে-ণ ভর-তুঃ।
প্রত্যেক চরণে অক্ষরসংখ্যা ১৭, মাত্ৰাসংখ্যা ২৭। উদাহরণের শব্দগুলির যথাক্ৰম অক্ষরবিন্যাস নীচে দেওয়া হল, লঘু অক্ষরের চিহ্ন ১, গুরু অক্ষরের ২–
২২ ২২১১১১১২ ২১২২১২২
২২২২১১১১১২ ২১২২১ ২২
মাত্রাচ্ছন্দের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা প্রায় অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। যথা পজঝটিকা ছন্দে–
মূঢ় জহীহি ধনাগমতৃষ্ণাং ।
কুরু তনুবুদ্ধে মনসি বিতৃষ্ণা।
যল্লভসে নিজকর্মোপাত্তং
বিত্তং তেন বিনোদয় চিত্ত
যথাক্রমে চার চরণের অক্ষরসংখ্যা ১১, ১২, ১০, ১০। মাত্ৰাসংখ্যা প্রতি চরণে ১৬। অক্ষরবিন্যাস এইরকম–