অক্ষর সংস্কারের শেষ পর্যায় কি? আশা করি তত দিনে আমাদের স্বরাজ্যলাভ এবং আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা হবে, উদ্যম বাড়বে, বুদ্ধি মোহমুক্ত হবে। তখন নানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অক্ষরেরও চূড়ান্ত সংস্কার করতে দ্বিধাবোধ করব না। নূতন অক্ষর উদ্ভাবনের প্রয়োজন কি? রোমান লিপি আমাদের সুপরিচিত, বাংলা বর্ণমালার লিখিত রূপ হিসাবে এই রোমান অক্ষর চালানোই সুসাধ্য। বুদ্ধিমানের দৃষ্টিতে ক-অক্ষর বা k-অক্ষর কোনওটি গোমাংস নয়। যদি আমরা ক নাম দিয়েই k অক্ষর চালাই তাতে ক্ষতি কি? ইওরোপ যেমন সুবিধাজ্ঞানে ভারতীয় মঞ্চ এবং দশমিক গণনাপদ্ধতি নিয়েছে আমরাও সেইরকম রোমান লিপি আত্মসাৎ করতে পারি, তার জন্য দীনতার গ্লানি আমাদের স্পর্শ করবে না।
[হাতের লেখা আর ছাপার টাইপ সমান হতে পারে না। লেখার টানে অক্ষর অম্লাধিক জড়িয়ে যায়। কিন্তু ছাপায় অক্ষরের স্বাতন্ত্র্য অত্যাবশ্যক। শতাধিক বৎসর পূর্বে হাতে লেখা পুঁথির গোটা গোটা অক্ষরের নকলে টাইপের যে ছাঁদ হয়েছিল এখনও তাই চলছে। আধুনিক হাতের লেখার সঙ্গে তার অনেক প্রভেদ। যদি টাইপের ছাঁদ কিছু বদলানো হয় তবে এই প্রভেদ বাড়বে না।
এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, আজকাল বইএর মলাটে এবং পণ্য বস্তুর বিজ্ঞাপনে অনেক রকম বিকৃত অক্ষর দেখা যাচ্ছে। অক্ষরকার বোধ হয় মনে করেন যে দুপাঠ্যতাই আধুনিকতার লক্ষণ। কিছুকাল পূর্বে আমার কয়েকজন বন্ধু একটি পত্রিকার মলাটে ছাপা নামটি অনেক চেষ্টা করে পড়েছিলেন–তাড়ী। কিন্তু নামটি প্রাচী। এইরকম বিকৃত অক্ষরে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য পণ্ড হয়। ইংরেজী বিজ্ঞাপনে উৎকট অক্ষর দেখা যায় না।]
বাংলা ছন্দের মাত্রা
আমি ছন্দোবিশারদ নই, কিন্তু আমার একটা চলনসই কর্ণেন্দ্রিয় আছে। যার দ্বারা বোধ হয় যে অমুক পদ্যের ছন্দটা ঠিক, অমুকটার বেঠিক। হয়তো কানের বা পাঠের বা অভিজ্ঞতার দোষে মাঝে মাঝে ঠিক ছন্দেও ত্রুটি ধরি, বেঠিক ছন্দেরও পতন বুঝতে পারি না। তথাপি নিজের কানের উপর নির্ভর করে যথাবুদ্ধি বাংলা ছন্দ বিশ্লেষের চেষ্টা করছি। অনেকে ছন্দের রহস্য না জেনেও ভাল পদ্য লিখতে পারেন, অনেক সাধারণ পাঠকও ছন্দ বজায় রেখে পড়তে পারেন। আমি সেই সহজ সংস্কারবশেই ছন্দোজিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হয়েছি।
চিত্রশাস্ত্রকার বিধান দিতে পারেন যে মানুষের মাথার যে মাপ হবে তার সঙ্গে চোখ নাক ধড় হাত পা প্রভৃতির এই এই অনুপাত থাকবে। আরও অনেক নিয়ম তিনি বিজ্ঞানীর মতন সূত্রাকারে বেঁধে দিতে পারেন। ঐসমস্ত নিয়ম অনুসারে কেউ যদি ছবি আঁকে তবে তা শাস্ত্রসম্মত হবে, কিন্তু ভাল নাও হতে পারে। যে যে লক্ষণ থাকলে চিত্র উত্তম হয় তার সম্পূর্ণ নির্দেশ দেওয়া শাস্ত্রের সাধ্য নয়। শাস্ত্রকার কেবল স্থূল নিয়ম দিতে পারেন। ছন্দঃশাস্ত্রেও এই কথা খাটে। ছন্দের স্থূল নিয়মের আলোচনাই সুসাধ্য।
ছন্দ শব্দের ব্যাপক অর্থ করা যেতে পারে–পর্বে পর্বে বিভক্ত সুপাঠ্য সুশ্রাব্য শব্দধারা। ধারার বিভাগ অর্থাৎ মাঝে মাঝে বিরাম বা একান্বয়ভঙ্গ (break of monotony) চাই, আবার বিভাগগুলির সংগতি বা সামঞ্জস্য (harmony)ও চাই। কেন সুশ্রাব্য হয়, কিসে সংগতি হয়, তা বলা আমার সাধ্য নয়। যে সকল ছন্দ সুপ্রচলিত তাদের স্পষ্ট ও সাধারণ লক্ষণগুলিই বিচার করে দেখতে পারি। ছন্দের চরণসংখ্যা, পর্ববিভাগ, যতি এবং স্থানবিশেষে স্বরাঘাত বা জোর(stress)ও আমার আলোচ্য নয়। বিভিন্ন ছন্দঃশ্রেণীর যা কঙ্কালস্বরূপ, অর্থাৎ মাত্ৰাসংস্থান বা মাত্রাগণনার রীতি, কেবল তার সম্বন্ধেই লিখছি। মাঝে মাঝে সংস্কৃত রীতির উল্লেখ করতে হয়েছে, কারণ বাংলা ছন্দের প্রকৃতি আলাদা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে সংস্কৃতের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে।
প্রথমেই কয়েকটি শব্দের অর্থ নির্দিষ্ট করা দরকার, নয়তো বোঝবার ভুল হতে পারে।
হরফ ও অক্ষর
অক্ষর শব্দ সাধারণত দুই অর্থে চলে। প্রথম অর্থ হরফ, যেমন অ ক্ ক কু কে ঐ ৎ ং :। দ্বিতীয় অর্থsyllable। এই প্রবন্ধে প্রথম অর্থে অক্ষর লিখব না, হরফ লিখব। দ্বিতীয় অর্থেই অক্ষর লিখব। এক শ্রেণীর বাংলা ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত বলা হয়, সেখানে অক্ষর মানে হরফ। অক্ষরবৃত্ত নামটি ভ্রান্তিজনক, কিন্তু বহুপ্রচলিত, সেজন্য বজায় রেখেছি।
অক্ষর বা syllable শব্দে বোঝায়–শব্দের নূন্যতম অংশ যার পৃথক্ উচ্চারণ হতে পারে। আগে বা পরে স্বরবর্ণ না থাকলে ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণ করা যায় না, সেজন্য কেবল ব্যঞ্জনবর্ণে অক্ষর হতে পারে না। র ল শ ষ স স্বরযুক্ত না করেও উচ্চারণ করা যায় বটে, কিন্তু সাধারণ ভাষায় সেরকম প্রয়োগ নেই। প্রতি অক্ষরে থাকে–শুধুই একটি স্বর, অথবা একটিমাত্র স্বরের সঙ্গে এক বা একাধিক ব্যঞ্জন। অনুস্বার বিসর্গও ব্যঞ্জনস্থানীয়। অক্ষরের উদাহরণ–অ তু উৎ কন্ দ্বী প্রাং ন্তঃ। জল সংস্কৃতে ২ অক্ষরজ-ল, কিন্তু বাংলা উচ্চারণে জল হসন্ত সেজন্য ১ অক্ষর। জলছবি ৩ অক্ষরজল-ছ-বি, জলযোগ ৩ অক্ষরজ-ল-যোগ, জলকেলি ৪ অক্ষর–জ-ল-কে-লি। অন্তঃপাতী–অন্তঃ–পা-তী কিংবা অন্তঃ-পাতী। অধিষ্ঠাত্রী–অ-ধি-ঠাৎ-রী কিংবা অধিষ্ঠাত্রী।
একটিমাত্র স্বর থাকাই অক্ষরের সাধারণ লক্ষণ। শব্দে যতগুলি স্বর ততগুলি অক্ষর। কিন্তু বাংলায় কতকগুলি দ্বিস্বর অক্ষর চলে, যেমন এই, বউ, খাও। এইরকম জোড়াস্বর বা dipthong ঐ ঔ বর্ণের তুল্য এবং অক্ষরে এক স্বর রূপে গণনীয়। অথবা ধরা যেতে পারে যে দ্বিতীয় স্বরটি ব্যঞ্জনধর্মী, কারণ তার টান নেই।