রোমান অক্ষর জটিলতাহীন, বহুপ্রচলিত, তাদের বিন্যাসরীতিও সরল, পর পর সাজালেই শব্দচনা হয়, বাংলা বা নাগরীর মতন একটা অক্ষরের সঙ্গে আর একটা জড়াতে হয় না। রোমান লিপির সুবিধা এবং কি উপায়ে তা বাংলা বর্ণমালার উপযোগী করা যায় তার বিশদ আলোচনা অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একাধিক প্রবন্ধে করেছেন। কিন্তু আমাদের অভ্যাস মজ্জাগত, আত্মাভিমানও প্রবল, সেজন্য অত্যন্ত উপযোগিতা সত্ত্বেও রোমান লিপি এখনই প্রচলিত হবার সম্ভাবনা নেই। এখন আমাদের যা আছে তারই যথাসম্ভব সংস্কারচেষ্টা কর্তব্য। এই সংস্কার ক্রমে ক্রমে করতে হবে যাতে অভ্যাস পীড়িত না হয় এবং বর্তমান রীতির সঙ্গে যোগসূত্র সহসা ছিন্ন না হয়।
অনেকে প্রস্তাব করেছেন যুক্তাক্ষরের পরিবর্তে হাইফেন-যোগে অক্ষর সংযুক্ত করা হক। এই পদ্ধতিতে লিখলে বা ছাপলে যোজিত অক্ষরগুলির মধ্যে যে ফঁক থাকবে তা দৃষ্টিকটু হবে এবং লোকে হাইফেনটিকে সংযোগচিহ্ন না ভেবে বিচ্ছেদচিহ্নই মনে করবে। বরং হচিহ্ন ভাল। অনেক শব্দে যুক্তাক্ষরের বদলে হচিহ্ন চলে, তার প্রয়োগ বাড়ালে অভ্যাসে তত বাধবে না। এই চিহ্ন যদি নীচে না দিয়ে অক্ষরগুলির প্রায় মাঝামাঝি বসানো হয় এবং কম হেলানো হয় তবে ফাঁক বেশী হবে না। কিন্তু সংস্কারের আরম্ভেই সমস্ত যুক্তাক্ষর তুলে দিয়ে হচিহ্ন চালানো কঠিন হবে।
কেউ কেউ বলেন, বাংলায় ঈ ঊ ঋ এবং তিন রকম শ ষ স রাখবার দরকার নেই। এই প্রস্তাব গ্রহণীয় মনে করি না। বাংলায় অসংখ্য সংস্কৃত শব্দ আছে, তাদের উচ্চারণ যতই বিকৃত হক ভারতীয় অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বানানের সাম্য রাখা একান্ত বাঞ্ছনীয়। এদেশে সংস্কৃত ভাষার চর্চা লোপ পাবে না, সে কারণেও পূর্ণ অক্ষরমালা আবশ্যক। বিদেশী শব্দের sh এবং s-এর পৃথক উচ্চারণ বোঝাবার জন্য। শ এবং স-এর প্রয়োজন আছে।
আমার প্রস্তাব সংক্ষেপে নিবেদন করছি। অক্ষরসংস্কারের প্রথম ক্ৰম হিসাবে নিম্নলিখিত পদ্ধতি এখনই নেওয়া যেতে পারে।
(১) অনেক শব্দে যুক্তব্যঞ্জন স্থানে হচিহ্ন সহজেই চালানো যেতে পারে, তাতে চক্ষুপীড়া বা উচ্চারণের বাধা হবে না; যেমন ধিককার, বাগদেবী, খড়গ, তগত, সদ্ভাব, উদ্যোগ, প্রগম্ভ, বগা, সদ্ব্যয়। কিন্তু উদ্যান, বিদ্বান্ প্রভৃতি যথাবৎ লিখতে হবে। খণ্ড ত অনাবশ্যক। রেফের পর দ্বিত্ববর্জন করলে যুক্তব্যঞ্জন কমবে। বহু অসংস্কৃত শব্দে যুক্তব্যঞ্জন বাদ দেওয়া যেতে পারে, অনেক স্থলে হচিহ্নও না দিলে চলে যেমন নকশা, আড্ডা, সরদার, পরদা, উলটা। এর ফলে যুক্তব্যঞ্জন খুব না কমলেও হচিহ্ন প্রয়োগের অভ্যাস বাড়বে এবং ক্রমশ আরও বাড়ানো সম্ভবপর হবে।
(২) যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গীভূত অক্ষরগুলির মূল রূপ যথাসম্ভব অবিকৃত রাখতে হবে। এ বিষয়ে আচার্য যোগেশচন্দ্রের রীতি গ্রহণীয়। লাইনোটাইপে অনেকটা তা করা হয়েছে। জ্ঞ এবং ক্ষ এই দুই অক্ষরের বাংলা উচ্চারণ অত্যন্ত বিকৃত, সেজন্য এখন বর্তমান আকৃতিই রাখা ভাল।
(৩) হিন্দী মারাঠী প্রভৃতি ভাষায় বগীয় বর্ণের পূর্বে সেই বর্গের পঞ্চম বর্ণ যোগ হলে সাধারণত পঞ্চম বর্ণের প্রতীকস্বরূপ অনুস্বার দেওয়া হয়, যেমন রংগমংচ, পংডিত, নংদ, কংপ। অবশ্য উচ্চারণ পঞ্চম বর্ণ অনুসারেই হয়। আজকাল কয়েকজন সাহসী বাঙালী লেখক কবর্গের পূর্বে প্রায় সর্বত্র ঙ স্থানে অনুস্বার দিচ্ছেন, যেমন অংক, সংগে। এই রীতি সকল বর্গেই প্রচলনযোগ্য, কিন্তু উচ্চারণে বাধতে পারে। যদি অনুম্বারের পুচ্ছ বাদ দেওয়া যায় তবে গোল চিহ্নটি সকল পঞ্চম বর্ণের প্রতীকরূপে গণ্য হতে পারে, অনুস্বার বলে ভ্রম হবে না। এর ফলে ২০টি যুক্তব্যঞ্জন কমবে এবং নূতন পদ্ধতি অভ্যাস করতেও অসুবিধা হবে না।
(৪) তুচ্ছ কারণে ছাপাখানায় টাইপের বাহুল্য করা হয়েছে। শব্দের আদিতে মধ্যে ও শেষে দেবার জন্য দুরকম এ-কার আ-কার এবং ণ অনাবশ্যক। লাইনোটাইপে একই রকম অক্ষরে কাজ চলছে, সাধারণ টাইপেও চলবে। অনেক টাইপে ব্যঞ্জনের সঙ্গে ই-কার ঈ-কার উ-কার ঊ-কার ঋ-কার য-ফলা রেফ এবং চন্দ্রবিন্দু জোড়া আছে। এই বাহুল্য অনাবশ্যক। সর্বত্র ই-কার উ-কার য-ফলা প্রভৃতি পাশে বসিয়ে দিলেই কাজ চলে, যেমন লাইনোটাইপে।
(৫) লাইনোটাইপে এক নূতন উপায়ে অনেকগুলি যুক্তব্যঞ্জনের টাইপ কমানো হয়েছে। গ ণ দ ন প ম ল শ ষ স অক্ষরের ডান দিকের রেখাঁটি বাদ দিয়ে কতকগুলি অর্ধ-টাইপ করা হয়েছে। এইগুলির পাশে অন্য ব্যঞ্জনের পূর্ণ-টাইপ বসিয়ে দিলেই যুক্তাক্ষর তৈরি হয়, যেমন গ্ল ন্ট দগ দ ল্ক শ্চ স্ন ষ্ট। এই উপায়ে প্রায় ৭৬ টাইপ কমেছে। সাধারণ টাইপেও এই পদ্ধতি গ্রহণীয়।
অক্ষর সংস্কারের দ্বিতীয় ক্রমে অধিকাংশ যুক্তব্যঞ্জনের জায়গায় হচিহ্ন চালাতে হবে। য-ফলা, র-ফলা, রেফ, এবং যেসব যুক্তব্যঞ্জন শব্দের গোড়ায় বসে, যেমন ক্ল ক্ষ গ্ল জ্ঞ প্ল ব্ল ম্ল প্রভৃতি, তখনও হয়তো ছাড়া চলবে না। প্রায় এগার বৎসর পূর্বে শ্রীযুক্ত অজয়চন্দ্র সরকার এই রকম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সমস্ত যুক্তব্যঞ্জন বাদ দিয়েও আমরা আদর্শ লিপিতে পৌঁছতে পারব না। যদি মূল বর্ণগুলির আকৃতি সরল করা হয় এবং আ-কার ই-কার প্রভৃতির যোজ্য চিহ্ন তুলে দেওয়া হয়, অর্থাৎ অক্ষরমালার আমূল পরিবর্তন হয় এবং স্বরব্যঞ্জননির্বিশেষে সকল অক্ষর পাশাপাশি বসিয়ে শব্দরচনা হয়, তবেই সকল বাধা দূর হবে।