আমাদের আলোচ্য কোন্ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য বাংলা অক্ষরের সংস্কার আবশ্যক এবং কি উপায়ে তা সুসাধ্য হবে। কামাল আতাতুর্ক অল্পায়াসে তার রাষ্ট্রে আরবী লিপির বদলে রোমান লিপি চালাতে পেরেছিলেন তার কারণ শুধু জবরদস্তি নয়। দেশের সুশিক্ষিত জনমতের তিনি সমর্থন পেয়েছিলেন, অশিক্ষিত প্রজাবর্গও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। আমির আমানুল্লা নিজের ক্ষমতা আর লোকপ্রিয়তা না বুঝেই হঠাৎ সমাজসংস্কার করতে গিয়ে বিতাড়িত হলেন। আমাদের দেশে এমন কোনও সর্বমান্য শক্তিমান্ নেতা নেই যাঁর হুকুমে অক্ষরের আমূল সংস্কার হতে পারে। সংস্কারের পরিকল্পনা যতই সরল ও যুক্তিসম্মত হক, লোকমত অগ্রাহ্য করে হঠাৎ তা চালানো যাবে না, সুতরাং শুধু কাগজে কলমে একটা সর্বগুণসম্পন্ন আদর্শলিপির খসড়া খাড়া করে লাভ নেই। এ কথাও মানতে হবে যে সকলকে বা অধিকাংশ লোককে খুশী করা অসম্ভব। অতএব ক্রমে ক্রমে সইয়ে সইয়ে পরিবর্তন করা ভিন্ন উপায় নেই। যদি জনকতক প্রতিষ্ঠাবান লেখক একমত হয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে নূতন পদ্ধতি মেনে নেন এবং ছাপাখানার কর্তারা তাদের সাহায্য করেন তবে সংস্কার ক্রমশ অগ্রসর হবে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়, সাহিত্যপরিষৎ এবং বিশ্বভারতীর সমর্থন পাওয়া যায় তবে সংস্কার দ্রুততর হবে।
আদর্শ অক্ষরমালা কিরকম হবে সে সম্বন্ধে বোধ হয় বেশী মতভেদ নেই। এমন অক্ষর চাই যা চেনা পড়া ও লেখা সহজ, যাতে জটিলতা নেই, যার গঠনে রেখার বাহুল্য নেই, যার মোট সংখ্যা অল্প, যার যোজনপদ্ধতি সরল; যাতে শুধু বাংলা ভাষার সাধারণ শব্দাবলী নয়, ইংরেজী প্রভৃতি বিদেশী শব্দও মোটামুটি উচ্চারণ অনুসারে লেখা যায়; যা ছাপবার জন্য বিস্তর টাইপ দরকার হয় না, যার গড়ন এমন যে ছাপবার সময় সহজে টাইপ ভাঙে না; এবং যা টাইপরাইটারের উপযুক্ত।
আমাদের বাংলা লিপি সুশ্রী তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উল্লিখিত গুণাবলীর বড়ই অভাব। অক্ষরের জটিল গঠন ও যোতন পদ্ধতির জন্য শিক্ষার্থীকে বিশেষত শিশুকে অনেক কষ্টভোগ করতে হয়। একখানা বর্ণপরিচয় যথেষ্ট নয়, প্রথমভাগ ও দ্বিতীয়ভাগ চাই। ব্যঞ্জনের সঙ্গে যোগ করতে গেলেই স্বরবর্ণের রূপ বদলে যায়। অ-কার অন্তর্হিত হয়, আ-কার এবং ঈ-কার ব্যঞ্জনের পরে বসে, অথচ ই-কার এ-কার ঐ-কার আগে বসে। ও-কার এবং ঔ-কারের আধখানা আগে আধখানা পরে বসে। উ-কার ঊ-কার ঋ-কার সাধারণত নীচে বসে, কিন্তু স্থলবিশেষে ব্যঞ্জনের ডাইনে জোড়া হয়। কতকগুলি যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একবারে বদলে গেছে। শিক্ষার্থীকে ৪৮টি মূল বর্ণ, ১৩/১৪ রকম স্বরচিহ্ন, য-ফলা রেফ র-ফলা প্রভৃতি ৭/৮টি ব্যঞ্জনচিহ্ন, এবং প্রায় ১৬০টি যুক্তব্যঞ্জন শিখতে হয়। তা ছাড়া অঙ্ক যতিচিহ্ন প্রভৃতি আছে। ছেলেবেলায় এই সমস্ত আয়ত্ত করতে কিরকম কষ্ট পেতে হয়েছিল তা হয়তো এখন আমাদের মনে নেই।
ছাপাখানার অক্ষরসমষ্টি আরও বেশী। ইংরেজী ছাপতে ক্যাপিটাল, স্মল, অঙ্ক এবং যতিচিহ্নাদি সমেত প্রায় ৭০টি টাইপে কাজ চলে, কিন্তু বাংলায় প্রায় ৫০০ টাইপ চাই। এত টাইপ কেন লাগে তা সংক্ষেপে বোঝানো অসম্ভব, সেজন্য তার আলোচনা করব না। আমাদের দেশে যারা টাইপের ছাঁদ উদ্ভাবন করেছে তারা সূক্ষ্মবুদ্ধি শিল্পী নয়, সাধারণ মিস্ত্রী মাত্র, কোনও দূরদর্শী অভিজ্ঞ লোক তাদের উপদেশ দেয় নি। তারা যথাসম্ভব হাতের লেখার নকল করেছে, নিজের রুচি অনুসারে একটু আধটু পরিবর্তন ও অলংকরণ করেছে, কিসে টাইপ সরল হয় তা মোটেই ভাবে নি, অনর্থক সংখ্যা বাড়িয়েছে। কতকগুলি অক্ষর এত জটিল যে ছাপায় প্রায় জুবড়ে যায়। সীসা-অ্যান্টিমনি-ঘটিত যে ভঙ্গুর ধাতুতে টাইপ গড়া হয় তার শক্তির উপর জুলুম করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একটি টাইপ থেকে শাখা বেরিয়ে পাশের টাইপের মাথায় বা নীচে প্রসারিত হয়। এই শাখাগুলি ছাপাবার সময় প্রায় ভাঙে। ইংরেজীতে এইরকম kern টাইপের প্রয়োগ খুব কম।
বাংলা লিপির বদলে নাগরী লিপি চালালে একলিপিবিস্তারের সাহায্য হবে বটে, কিন্তু অন্য কোনও লাভ হবে না, কারণ নাগরী অক্ষর বাংলার তুল্যই দোষগ্রস্ত। আমরা যদি নিজের প্রয়োজনে নাগরী অক্ষর অল্পাধিক পরিবর্তিত করি তা হলে সে পরিবর্তন হিন্দী প্রভৃতি ভাষীর রুচিসম্মত না হতে পারে। সুতরাং নাগরীর মোহ ত্যাগ করাই কর্তব্য।
পণ্ডিতরা বলেন, প্রাচীন ফিনিশীয় লিপি থেকেই হিব্রু আরবী গ্রীক রোমান এবং ভারতীয় লিপিগুলি উদ্ভূত হয়েছে। ভারতীয় লিপির মূল যাই হক, আমাদের পরম সৌভাগ্য যে পশ্চিম দেশীয় বর্বর বর্ণমালা (alphabet) এদেশে আমল পায় নি। প্রাচীন ভারতের ব্যাকরণকার আলফা বিটা গামা, এ বি সি, আলিফ বে পে প্রভৃতি উদ্ধৃঙ্খল বর্ণক্রম পরিহার করে বিজ্ঞানসম্মত অ আ ক খ প্রভৃতি ক্রমে বর্ণমালা সাজিয়েছেন। আমাদের বর্ণসংখ্যা পশ্চিমদেশের চেয়ে বেশী, সেজন্য আমাদের অক্ষর অর্থাৎ বর্ণের লিখিত রূপও বেশী হয়েছে। পাশ্চাত্ত্য বা ভারতীয় কোনও অক্ষরমালা মুদ্রাযন্ত্র বা টাইপরাইটারের অপেক্ষায় সৃষ্ট হয় নি, লেখার জন্যই হয়েছে। দৈবক্রমে পাশ্চাত্ত্য অক্ষরের অল্পতা মুদ্রণের অনুকূল হয়েছে এবং ভারতীয় অক্ষরের বাহুল্য বাধাস্বরূপ হয়েছে। এতে পাশ্চাত্ত্য দেশের বাহাদুরি নেই, আমাদেরও লজ্জার কারণ নেই। বর্ণমালা এবং তার লিখিত রূপ বা লিপি এক জিনিস নয়, প্রথমটি অবিকৃত রেখেও দ্বিতীয়টি বদলানো যেতে পারে। এদেশে তা ঘটেছে। পাণিনির সময় বা তার পূর্ব থেকেই বর্ণমালা প্রায় অবিকৃত আছে, কিন্তু লিপি বা অক্ষরমালার আকৃতি কালে কালে বদলেছে। প্রাচীন সরল ব্রাহ্মী অক্ষরগুলি ক্রমে ক্রমে জটিল হয়ে বাংলা নাগরী প্রভৃতির বর্তমান রূপ পেয়েছে।