যাঁদের উদ্যোগে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তারা কোনও প্রদেশের সংকীর্ণ নীতি বাঞ্ছনীয় মনে করেন না। প্রদেশ ভাগের প্রধান লক্ষ্য প্রশাসনের সৌকর্য, শিল্পের প্রতিষ্ঠা, কৃষির বিস্তার ইত্যাদি সর্বহিতকর কর্ম, ভাষার ঐক্য অপেক্ষাকৃত গৌণ। ভারতীয় প্রজা অবাধে সকল রাজ্যে প্রবেশ করবে, বসতি করবে, সর্বত্র সমান অধিকার পাবে, সেই সঙ্গে তার নিজের ভাষা আর সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য বজায় রাখবে–এই হচ্ছে সংযুক্ত ভারত রাষ্ট্রের নীতি। ভাষার ঐক্য অনুসারে প্রত্যেক প্রদেশ ভাগ করা অসাধ্য, একভাষী প্রদেশও কালক্রমে বহুভাষী হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। অতএব, বিভিন্ন ভাষা ধর্ম সংস্কৃতি ও আচারের একত্র অবস্থান উদারভাবে মেনে নেওয়াই সকল প্রদেশবাসীর কর্তব্য।
সংযুক্ত বঙ্গ-বিহার সম্বন্ধে শঙ্কার মূলে আছে–(১) জীবিকার নানা ক্ষেত্রে বাঙালীর উদ্যম আর পটুতার অভাব, (২) বিহারবাসীর সংখ্যাধিক্য জনিত প্রাধান্য। প্রথম কারণটি দূর হলে দ্বিতীয়টিরও গুরুত্ব থাকবে না। বাঙালী যদি অধিকাংশ ব্যবসায় আর শ্রমসাধ্য কাজ বিদেশীকে ছেড়ে দিয়ে চাকরি ওকালতি ডাক্তারি শিক্ষকতা গ্রন্থরচনা প্রভৃতি কয়েকটি বাছা বাছা বৃত্তি অবলম্বন করে, এবং অতিমাত্র ভাবালু হয়ে নাচ গান সিনেমা আর গুরু গুবী নিয়ে মেতে থাকে, তবে কেবল ভাষার গণ্ডি টেনে আত্মরক্ষা করতে পারবে না, নিজের দেশেও তাকে দুর্বল পরাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। অতএব আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই বাঙালীকে উদ্যমী আর পরিশ্রমী হতে হবে। একভাষী বা বহুভাষী কোনও প্রদেশেই শক্তিশালী স্বাবলম্বী বাঙালীর ভয় থাকবে না।
আমার মনে হয়, বঙ্গ-বিহার একীকরণের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়, আবার হঠাৎ একীকরণও বাঞ্ছনীয় নয়। একীকরণ আমাদের আদর্শ ও সাধনার বিষয় হয়ে থাকুক। দুই প্রদেশের সংযোগের ফলে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং উভয়েরই কল্যাণ হবে। যদি ভবিষ্যতে আসাম উড়িষ্যা আর ত্রিপুরাও বঙ্গ-বিহারের সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে আরও ভাল। কিন্তু সংযোগ এখনই সাধ্য নয়, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় নি। আদর্শ মনে রেখে বাঙালী আর বিহারী ভবিষ্যৎ মিলনের জন্য সচেষ্ট হক। বিহারনিবাসী বাঙালীর ক্ষোভের যেসব কারণ আছে, বিহার সরকার তা দূর করুন। পশ্চিমবঙ্গনিবাসী বিহারীর যদি কিছু অভিযোগ থাকে, তারও প্রতিকার এদেশের সরকার করুন। হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করবার সঙ্কল্প অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবী রাখা হক, তাতে বাঙালীর হিন্দীপ্রভুত্বের ভয় কমবে। অন্তত পাঁচ বৎসর বিহার আর পশ্চিম বাংলার কোর্টশিপ ও আত্মশুদ্ধি চলুক। এই পরীক্ষা-কালের মধ্যে যদি মনোমালিন্য দূর হয়, তবেই দুই প্রদেশের সংযোগ সাধ্য হবে। কতকগুলি সংলগ্ন রাজ্য নিয়ে যে মণ্ডল বা Zone গঠনের প্রস্তাব নেহরুজী করেছেন, তার দ্বারা ভবিষ্যৎ মিলনের পথ সুগম হবে।
মার্কিন যুক্তরাজ্যে যেসব ইওরোপীয় জাতি বসতি করেছে তারা দুই পুরুষের মধ্যেই মাতৃভাষা ভুলে গিয়ে ইংরেজী ভাষা আত্মসাৎ করেছে এবং অন্যান্য প্রজার সঙ্গে মিশে গেছে। ওলন্দাজ রুজভেল্ট এবং জার্মান আইজেনহাওয়ার অসম্পূর্ণভাবে মার্কিন হয়ে গেছেন। ভারতবাসী অত সহজে ভাষা আর সামাজিক প্রথা বদলাতে পারে না, সেকারণে সম্পূর্ণ একীভবন এখন অসম্ভব। কিন্তু চেষ্টা থাকলে কালক্রমে তাও ঘটতে পারে। ততদিন বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলনই ভারতীয় প্রজার সাধনীয় হক, কিন্তু বৈচিত্র্যে যেন ভেদবুদ্ধি আর বিদ্বেষ না আসে। মার্কিন রাষ্ট্রের মতন সর্বাঙ্গীণ মিলন অসম্ভব হলেও দ্বিভাষী কানাডা আর ত্ৰিভাষী সুইৎসারল্যান্ডের মতন মিলন অসাধ্য হবে কেন?
[প্রবন্ধটি বঙ্গ-বিহার সংযুক্তীকরণের প্রস্তাব প্রসঙ্গে লিখিত। ১৯৫৬ সালে ভাষাসমস্যা ও রাজ্য পুনর্গঠন নিয়ে সারা ভারতে অশান্তি দেখা দেয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা: বিধানচন্দ্র রায় এই অশান্তি দূরীকরণের জন্য বঙ্গ বিহার সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব দেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই নিয়ে বহু মতানৈক্য দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত খেজুরী। উপনির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হলে এই প্রস্তাব প্রত্যাহূত হয়। –স:।]
বাংলা অক্ষরের সংস্কার
বাংলা অক্ষর সংস্কারের প্রস্তাব অনেক কাল থেকে হয়ে আসছে। এ বিষয়ে সম্ভবত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় অগ্রণী। তার পদ্ধতি মোটামুটি এই।–স্বরান্ত ব্যঞ্জন একই রকমে লেখা হবে, যেমন কু শু পু হু, কূ শূ, কৃ; এবং যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গীভূত অক্ষরগুলি যথাসম্ভব অবিকৃত থাকবে, যেমন ক্ত ক খ। কিন্তু যে যুক্তব্যঞ্জনের বিকৃত উচ্চারণ হয় তার আকৃতি তিনি বদলান নি, যেমন ক্ষ। এছাড়া তিনি অনাবশ্যক বোধে এবং ব্যাকরণের সমর্থনে রেফের পর দ্বিত্ব বর্জন করেছেন। বিদ্যানিধি মহাশয়ের উদ্দেশ্য বর্ণের মূল রূপ যথাসম্ভব বজায় রাখা, ছাপার সুবিধা অসুবিধার উপর তিনি দৃষ্টি দেন নি। বহু বৎসর পূর্বে যে একলিপি বিস্তার-সমিতি স্থাপিত হয় তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা উড়িয়া গুজরাটী প্রভৃতি ভাষায় নাগরী অক্ষর চালানো। নাগরী-প্রচারিণী সভারও উদ্দেশ্য অনুরূপ। এই দুই সমিতি এখন প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। গত দশ বৎসরের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালীর অনেকে অক্ষর-সংস্কারে উৎসাহী হয়েছেন, তার ফলে নানারকম পরিকল্পনা প্রচারিত হয়েছে। প্রস্তাবকগণের লক্ষ্য সমান নয়, কেউ এক বিষয়ে কেউ অন্য বিষয়ে বেশী ঝোঁক দিয়েছেন।