এই সময় গঞ্জিকাসেবীর বাজখাই গলার আওয়াজ শোনা গেল–ভায়া, আমরাও আছি। আমাদের তরফেও কিছু বল।
তামাক-খোর ধমক দিয়ে বলেন–দূর হ লক্ষ্মীছাড়া গেঁজেল! তোদের সঙ্গে আমাদের তুলনা?
গাঁজা-খোর ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিলেন–সে কি দাদা? তোমাতে আমাতে তো কেবল মাত্রার তফাত। তুমি খাও তামাক, আমি খাই বড়-তামাক। তোমরা শৌখিন বড়লোক, তাই বিস্তর আড়ম্বর,-রুপোর ফরসি, জমিদারি সটকা, সোনার সিগারেট-কেস, কলের চকমকি। আমরা গরীব, তাই তুচ্ছ সরঞ্জামের বড়বড় নাম রাখিয়াই শখ মিটাই। গাঁজা কাটিবার ছুরিকে বলি রতন-কাটারি, কাঠের পিঁড়িকে বলি প্রেম-তক্তি, ধোঁয়া ছাঁকিবার ভিজা ন্যাতাকে বলি জামিয়ার, গাঁজা ডলিবার সময় মন্ত্র বলিবোম্ শঙ্কর কঙ্কড় কি ভোলা! আমাদের নেশার আয়োজনেই কত কাব্য-রস–তোমরা তো পরের প্রস্তুত জিনিস টানিয়াই খালাস। আর, আনন্দের কথা যদি ধর, তবে তোমরা বহু পশ্চাতে। ত্বরিতানন্দ জান? আমরা তাই উপভোগ করি। স্বাস্থ্য? তার জবাব তো তোমরা নিজেরাই দিয়াছ। আমরা স্বাস্থ্যের উপর একটু বেশী অত্যাচার করি বটে, কিন্তু আনন্দটি কেমন? না হয় গলাটা একটু কর্কশ হইল, চোখ একটু লাল হইল, চেহারাটা একটু চোয়াড়ে হইল, কিন্তু মোটের উপর শরীর মন ঠিকই আছে।
হিসাবী সমাজহিতৈষী দুই তরফের কথা শুনিয়া বলিলেন–তোমাদের বচসা মিটানো বড়ই শক্ত কাজ। আমি বলি কি–তোমরা দু দলই বদ অভ্যাস ত্যাগ কর। শরবত খাও, ভাল ভাল জিনিস খাও, যাতে গায়ে গত্তি লাগে, যথা লুচি-মণ্ডা। প্রকৃত আনন্দ তাতেই আছে।
তামাক-খোর বলিলেন–শরবত খুব স্নিগ্ধ, লুচি-মণ্ডাও খুব পুষ্টিকর, সুবিধা পাইলেই আমরা তা খাই। কিন্তু এ সব জিনিসে আত্মা তৃপ্ত হয় না, আড্ডা জমে না। কিঞ্চিৎ নেশার চর্চা না করিলে মানুষে মানুষে ভাবের বিনিময় অসম্ভব। তামাক অবশ্য চাই, এইটিই নিরীহ প্রকাশ্য নেশা, আর সব নেশা অপ্রকাশ্য।
গাঁজা-খোর বলিলেন–ঠিক কথা। নেশা চাই বইকি, কিন্তু গাঁজাই পরাকাষ্ঠা। তোমাদের পাঁচ জনের উৎসাহ পাইলেই আমরা ভদ্র-সমাজে চালাইয়া দিতে পারি।
সমাজহিতৈষী চিন্তিত হইয়া বলিলেন–তাই তো, বড় মুশকিলের কথা। দেখিতেছি তোমরা কেউ-ই ধোঁয়া না টানিলে বাঁচিবে না। আচ্ছা, অক্সিজেন খুঁকিলে চলে না?
তামাক-খোর গাঁজা-খোর অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া সমস্বরে কহিলেন– আজ্ঞে, ওটা অন্তিম কালে, হরিনামের সঙ্গে সঙ্গে। আপাতত কিছু সাকার সুগন্ধি সুস্বাদ মনোহারী ধোঁয়ার ফরমাশ করুন।
হিতৈষী নাচার হইয়া বলিলেন–তবে ঐ তামাক অবধি বরাদ্দ রহিল। তার উপর আর উঠিও না, ঐখানেই গণ্ডি টানিলাম।
গাঁজা-খোর অট্টহাস্যে বলিলেন–খুব বুদ্ধি আপনার! নেশার তত্ত্ব আপনি কিছুই বোঝেন না। ঐ তামাকই তো একটু একটু করিয়া বেমালুম ভাবে গাঁজায় পরিণত হইয়াছে–তামাক-তামা-তাজা-গাঁজা। মৌচাকএর শিশু পাঠকরাও এই তত্ত্ব জানে। কোথায় গণ্ডি টানিবেন?
সমাজহিতৈষী মহাশয় হতাশ হইয়া বলিলেন–তবে মর তোমরা পীত্বা পীত্বা পুনঃ পীত্ব। দিন কতক যাক, তারপর বুঝিব কার পরমায়ু কত কাল।
বঙ্গ-বিহার
মানুষ সব চেয়ে ভালবাসে আত্মীয়-স্বজনকে, তার পর যথাক্রমে নিজের সমাজ জাতি আর দেশের লোককে। বসুধার সকলকেই যাঁরা কুটুম্ব জ্ঞান করেন তারা সংখ্যায় নগণ্য। সাধারণ মানুষের প্রীতির ক্ষেত্র সংকীর্ণ, কিন্তু তা অপরাধ নয়। বিহারের যেসব জেলা প্রধানত বাংলাভাষী তা পশ্চিম বাংলার অন্তর্গত হক–এই কামনা বাঙালীর পক্ষে অতি স্বাভাবিক।
কিন্তু আজ যদি বিহার সরকার হঠাৎ উদার হয়ে বাঙালীর আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন তা হলেই কি আমাদের অভাব মিটবে, দেশে সমৃদ্ধি আসবে? নানা উপলক্ষ্যে পশ্চিম বাংলায় হিন্দীভাষীর প্রবেশ বহুকাল থেকে অব্যাহত আছে। শ্রমসাধ্য জীবিকায় এবং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বাঙালী পরাভূত হয়েছে, বিহারী ওড়িয়া পঞ্জাবী মারোয়াড়ী মাদ্রাজী গুজরাটী প্রভৃতির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, এবং এই সব বিদেশীর অনেকে স্থায়ী অধিবাসী হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম বাংলার প্রধান প্রধান নগরে যেসব অবাঙালী স্থায়ী ভাবে বাস করেন তাদের মধ্যে প্রবল প্রতিপত্তিশালী লোক অনেক আছেন। সম্প্রতি উদ্বাস্তুর আগমনে বাংলাভাষীর সংখ্যা কিছু বেড়েছে কিন্তু বাঙালীর প্রভাব বাড়ে নি। এমন সম্ভাবনা অমূলক নয় যে অদূর ভবিষ্যতে এদেশে অবাঙালীর সংখ্যা ও প্রভাব আরও বাড়বে। উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিংহল প্রভৃতি রাষ্ট্র আইন করে বিজাতির অনুপ্রবেশ দমন করেছে, কিন্তু ভারতের কোনও প্রদেশের এমন অধিকার নেই যে অন্য প্রদেশবাসীর আগমন রোধ করে। অতএব পশ্চিম বাংলা উত্তরোত্তর বহুভাষী বহুজাতির দেশে পরিণত হবে। বিহার প্রভৃতি প্রদেশেও অনেক বাঙালী আছেন, কিন্তু এককালে তাদের যে প্রভাব ছিল এখন তা নেই।
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে শ্রমসাধ্য কর্মে বিমুখতা, ব্যবসায়ে অপটুতা, এবং অন্য বহু ক্ষেত্রে উদ্যমের অভাবে প্রবাসে আর স্বদেশে বাঙালী ক্রমশ ক্ষীণবল হচ্ছে। অধিকাংশ বাঙালীর মনে এই ভয় আছে যে বঙ্গ-বিহার একরাজ্য হলে আমাদের আত্মরক্ষার যেটুকু রাজনীতিক শক্তি আছে তাও খর্ব হবে, এবং স্বাধীনতালাভের পূর্বে লীগ সরকারের আমলে হিন্দু বাঙালীর যে দুর্দশা হয়েছিল তাই ফিরে আসবে। লক্ষ্য করবার বিষয় সংযোগের প্রস্তাবে অধিকাংশ বাঙালী ভয় পেয়েছেন, কিন্তু অধিকাংশ বিহারী খুশী হয়েছেন।