প্রতাপ রায় মরে নাই। ঘা সারিবামাত্র সে চন্দ্রশেখরের বাড়ি আসিয়া হাঁকিল ভটচায, ও ভটচার্য।
চন্দ্রশেখর নামাবলী গায়ে খড়ম পায়ে আসিয়া বলিলেন,-কে ও, প্রতাপ যে। বেশ সেরেচ বাবা?
প্রতাপ একটি তাড়ি-রঙের ধুতির উপর তাড়ির ভাঁড়ের রঙের মেরজাই পরিয়া আসিয়াছে। তার চোখ লাল, দৃষ্টি উদভ্রান্ত। টলিতে টলিতে বলিল– শৈবলিনীকে ডেকে দিন।
চন্দ্রশেখর মাথা নীচু করিয়া একটু ভাবিয়া বলিলেন–নাই বা দেখা করলে।
–দেখা করতে আমি আসি নি, একেবারে নিয়ে যেতে এসেছি। ডাকুন শীগগির।
–সে কি প্রতাপ? তিনি যে কুল-বধূ।
-হলেনই বা, এক কুল ছেড়ে অন্য কুলে যাবেন, আমি তো আর লরেন্স ফস্টর নই। সব ঠিক করেছি, তোকি খ প্রস্তুত, তাজই শৈবলিনীকে মোছলমান বানিয়ে দেবে, তার পর আপনাকে তাল্লাক, আমার সঙ্গে নিকে। আমার নাম এখন আফতাব খাঁ। ভয় নেই ঠাকুর, জাত যাবে না, কালই আবার রামানন্দ স্বামীকে ধরে দুজনে শুদ্ধি নিয়ে নেব।
চন্দ্রশেখর বসিয়া পড়িয়া বলিলেন–তুমি কি জাল-প্রতাপ?
প্রতাপ বজ্রনিনাদে বলিল–আমি জাল! মূর্খ ব্রাহ্মণ, কাহার সম্পত্তি তুমি ভোগ করিতে চাও? একই বৃন্তে দুটি ফুল কে ছিঁড়িয়াছিল? (মূল গ্রন্থ দেখ) ভণ্ড জ্যোতিষী, শৈবলিনীর অন্তরের কথা বিবাহের পূর্বে গণিয়া দেখ নাই?
চন্দ্রশেখর কাতর কণ্ঠে কহিলেন–খুবই অন্যায় হয়ে গেছে বাবা। স্ত্রী চরিত্র তো জ্যোতিষে গণা যায় না। এই কলিকালে যে বিবাহের পূর্বে প্রেম হতে পারে তা জানতুমই না। যেতে দাও বাবা, যেতে দাও–যা হবার হয়ে গেছে। বেচারী এখন শান্তিতে আছে, সংসারধর্ম করচে, পুরনো কথা সব ভুলেচে। আহা, আর তাকে উদ্ব্যস্ত করো না।
প্রতাপ উন্মত্তের ন্যায় হাসিয়া বলিল–এই বিদ্যে নিয়ে তুমি পণ্ডিতি কর? যে অন্তরে অন্তরে আমারই, তাকে তুমি কোন্ অধিকারে আটকে রাখবে? বল ব্রাহ্মণ, বল বল। যে আমার শৈশব-সঙ্গিনী, সে আজু কঁহা মেরী হৃদয়কী-ঈ-ঈ-(স্টার থিয়েটার দেখ)।
চন্দ্রশেখর ভীত হইয়া বলিলেন–একটু ঠাণ্ডা হও বাবা। আমি বুঝিয়ে দিচ্চি।–পাপের স্পর্শ হতে কেউ রক্ষা পায় না, শৈবলিনীও ছেলেবেলায় পাপে পড়েছিলেন।
–অ্যাঁ! পূর্বরাগ পাপ?
–সর্বত্র পাপ নয় বাবা। কিন্তু যেখানে স্বাধীন বিবাহ চলিত নেই, সেখানে পূর্বরাগের ফলে পরে শান্তিভঙ্গ হতে পারে, সেজন্যই পাপ।
–তবে পাপীয়সীকে ছেড়ে দাও না ঠাকুর।
–খাপ্পা হয়ো না বাবা। পাপ হলই বা–ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথিনি,–অমন একটু-আধটু পাপ আমরা সবাই করে থাকি। কিন্তু সেটা নির্মূল করাও যায়। শৈবলিনী মন্ত্রলাভ করেছেন, যে মন্ত্রবলে চিরপ্রবাহিত নদী অন্য খাতে চালানো যায়। (মূল গ্রন্থ দেখ)
-বুঝেচি বুঝেচি, বুজরুকি করে তাকে আটকে রাখতে চাও! ও চলবে না ঠাকুর, তুমি তাকে আটকাবার কে? আমার শৈবলিনীকে চাই, এক্ষুনি এক্ষুনি। উচাটন মন যারে ধরিবারে ধায়, তারে কেন-ক্যানও-কেন নাহি পায়! (স্টার থিয়েটার দেখ)
চন্দ্রশেখর খাড়া হইয়া উঠিয়া বলিলেন–ক্যানও নাহি পায় তা আমি বুঝিয়ে দিচ্চি। রামচরণ, অ রামচরণ–
রামচরণ এখন ভটচা-বাড়িতেই কাজ করে। সাড়া দিল–আজ্ঞে।
–ওরে নিয়ে আয় তো আমার ছড়িটা, সেই বেতের লিলিকে ছড়ি। বাঁশের লাঠিটা নয়, বুঝেচিস্?
প্রতাপ বলিল–ছড়ি কি হবে, ভটচায?
–তোমায় লাগাব। দু-এক ঘা খেলেই বুদ্ধি সাফ হয়ে যাবে। রামচরণ, জদি
প্রতাপ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল–আঁ, মারবে? প্রতাপ রায়ের গায়ে হাত? তবে রে পাজী, শুয়ার–
–অ রামচরণ, বেতের ছড়িতে হবে না রে, বাঁশের লাঠিটাই আ—
প্রতাপ সদর্পে পলায়ন করিল। আর্ট ও সমাজধর্ম দুই বজায় রহিল, অথচ লাঠি ভাঙিল না।
[চিরকুমার সভা সম্বন্ধে দুটো আপত্তি জানিয়েছিলেন। এমন মজার একটা ঘটনায় কবি কেন এক বালবিধবা চরিত্র রাখলেন–শৈলবালা-অবলাকান্তবাবু। দ্বিতীয় ব্যাপারটি ভয়ানক–কবি ভাবলেন না ফেণী পূর্ণকে বিয়ে করে চলে গেলে একা বৃদ্ধ চন্দ্রবাবুকে কে দেখবে; উচিত ছিল ওঁরও একটা বিয়ে দেওয়া। জগত্তারিণী হলেও চলত। এটি বলেছিলেন ওঁর দৌহিত্রী, আমার মাকে। –স:।]