৬। কবি আমাকে বলেছিলেন বাংলা প্রয়োগে শব্দের শেষের বিসর্গ অনাবশ্যক (সংস্কৃতে মনঃ, দুর্বাসা, স্বতঃ, বাংলায় মন, দুর্বাসা, স্বত)।
৭। হস্-চিহ্ন সম্বন্ধে কবির মত জানি না। বোধ হয় সংস্কৃত শব্দে অধিকাংশ স্থলে হচিহ্ন বজায় রাখা ভাল (ব্যতিক্রম–ভগবান, বলবান, (বুদ্ধিমান, বিপদ, দিক ইত্যাদি বহু শব্দ)। অসংস্কৃত শব্দে নিতান্ত দরকার না হলে হচিহ্ন বর্জনীয় (পটকা, বালতি, আচমকা, চটকানো)। খণ্ড-ত আমার পছন্দ নয়, বাংলা ছাড়া কোনও ভাষায় নেই। কিন্তু জগৎ স্থানে জগত লিখলে লোকে খেপে উঠবে। চলন্তিকা ৪র্থ সংস্করণে অনেক অসংস্কৃত শব্দে ৎ স্থানে ত দিয়েছি (ওত, তফাত, মেরামত, শরবত)। বুদবুদ, প্রগম্ভ–হচিহ্ন আবশ্যক। সংস্কৃতে ষড়দর্শন, ষড়যন্ত্র; বাংলায় সাধারণে হচিহ্ন দেয় না।
৮। কার্তিক, বর্তিকা শুদ্ধ, পাণিনিসম্মত। বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ঢাকার গোবর্ধন শাস্ত্রী প্রমাণ দিয়েছেন। পাশ্চাত্য অনেকে লেখেন। সামান্য একটু পরিবর্তনে যদি শব্দটিকে শুদ্ধ করা যায় তবে ত্ত্য লিখতে দোষ কি? (বাংলায় ও হরফ আছে বলেই ত্ত লিখতে হবে কেন?)
৯। যদি দৃষ্টিকটু না হয় তবে যুক্তাক্ষর কিছু কমানো ভাল (উদ্গত, উদ্ঘাটন, ধিক্কার)। তন্ময় দৃষ্টিকটু। বাংলায় দ-এর পর ব-ফলা বা য-ফলার দুরকম উচ্চারণ। যেখানে স্পষ্ট উচ্চারণ (চ বা তুল্য) সেখানে হস্ চিহ্ন দিতে চাই, অন্যত্র যুক্তাক্ষর রাখতে চাই (উন্ধন, উদাহু, তবিধ, উদ্যোগ, উদ্যাপন, বিদ্বান, অদ্বৈত, উদ্যত, উদ্যান)। রচনাবলীতে অবশ্য এরকম করা হয় নি।
কবি আমাকে বলেছিলেন–বাংলায় ঐ ঔ তুলে দেওয়া উচিত (পইতা, বউ, মউমাছি)। আমি বলেছিলাম–সর্বত্র তা হবে কি? উত্তরকেন হবে না। পৌষ সংস্কৃত শব্দ, বাংলাতে উচ্চারণ বদলায় নি, সুতরাং পউষ বর্জনীয়। ঔষধ ঔউষধ হয় নি।
আমার মতে ঐ (that) স্থানে সর্বত্র ওই লিখলে দৃষ্টিকটু হবে।
১০। বানানসমিতি কেবল কয়েকটি শব্দে য-এর বদলে জ-এর ব্যবস্থা করেছেন (কাজ, জাউ, জাঁতা, জাতি, জুই, জো, জোড়, জোড়া, জোত, জোয়াল)। অন্য শব্দে জ কিংবা য আপনারা স্থির করবেন। খৃষ্ট স্থানে খ্রীষ্ট বা খ্রীস্ট লেখা ভাল। নবাগত অসংস্কৃত শব্দে রি বা রী স্থানে ঋ লেখা অনুচিত, কারণ ঋকারের মূল উচ্চারণ তা নয়। আমরা যা ভুল করে আসছি তা আর বাড়াবার দরকার কি। বাংলা উচ্চারণে শ ষ স সমান, কিন্তু নবাগত notice লিখতে নোটিশ বানান করা ঠিক নয়। নোটিস, বার্নিশ ঠিক।
১১। মর্ত, মর্ত; অর্ঘ, অর্ঘ্য–সবই শুদ্ধ। বাংলায় মর্ত্য বেশী চলে। অর্ঘ, অর্ঘ্য–কিছু অর্থভেদ আছে।
১২। ১নং উত্তর দ্রষ্টব্য।
১৩। ইলেক দেওয়া না দেওয়া ইচ্ছাধীন।
১৪। অর্থবোধে বাধা হলে হাইফেন দেওয়া ভাল। উদাহরণগুলিতে হাইফেন না দিলেও চলে।
১৫। বাংলায় যেসকল শব্দে অ্যা উচ্চারণ আছে অথচ বানানে এ-কার বহুপ্রচলিত, সেখানে কবির রীতি অনুসারে দেওয়া উচিত।
১৬। কবির লেখায় আগে? এবং! চিহ্ন খুব থাকত, শেষে প্রায় বাদ দিয়েছিলেন। বোধ হয় সর্বত্র বাদ দিলে মানে বোঝা শক্ত হবে। কমা-চিহ্ন সম্বন্ধেও ঐ কথা। বাক্যের প্রথমে এমন কি, অর্থাৎ, আর, কিন্তু থাকলে হলবিশেষে কমা দিলে ভাল হয়।
—-রাজশেখর বসু
৩০/৪/৪৩
লোকহিতৈষী প্রফুল্লচন্দ্র
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে আপনারা যত জানতেন, অন্য অল্প লোকেই তাঁকে। ততটা জানত, এজন্য তার সম্বন্ধে নূতন বেশী কিছু বলার নেই। কোনও লোক যখন নানা কারণে বিখ্যাত হন তখন অনেক ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় গুণটি অন্যান্য গুণের আড়ালে পড়ে যায়। আমার মনে হয়, প্রফুল্লচন্দ্রের বেলা তাই হয়েছে। তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী, বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠাতা–এই কথাই লোকে বেশী বলে। এদেশে অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী আর শিল্পকর্তা আছেন, সুতরাং এই দুই দলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে ফেললে তার গৌরব বাড়ে না। তার মহত্ত্বের সবচেয়ে বড় পরিচয়–তিনি নিঃস্বার্থ লোকহিতৈষী। এই গুণে তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর বৈজ্ঞানিক আর সাহিত্যিক বিদ্যা, শিল্পপ্রসারের জন্য তার আগ্রহ–এসব তিনি শিক্ষা বা চর্চার দ্বারা পেয়েছিলেন। কিন্তু লোকহিতের প্রবৃত্তি তার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। তিনি বেশী রোজগার করেননি, সেজন্য তার দানের পরিমাণ ধনকুবেরদের তুল্য নয়। তথাপি তিনি দাতাদের অগ্রগণ্য, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয় তাকে দধীচির সঙ্গে সার্থক তুলনা করেছেন। সংসারচিন্তা এবং সব রকম বিলাসিতা ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজের সমস্ত ক্ষমতা ভাবনা আর অর্থ জনহিতে লাগিয়েছিলেন। দেশে দুর্ভিক্ষ বা বন্যা হয়েছে, আচার্য তৎক্ষণাৎ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কোনও হাসপাতাল বা অনাথ আশ্রম বা স্কুল বা কলেজে টাকার অভাব, আচার্য তার নিজের পুঁজি নিঃশেষ করে দান করলেন। কোনও ছোকরা এসে বললে, আমার মাথায় একটা ভাল মতলব এসেছে, ময়রার দোকান খুলব কিংবা ট্যানারি করব কিংবা কাপড়ের ব্যবসা করব, কিন্তু হাতে টাকা নেই। আচার্য তখনই মুক্তহস্ত হলেন। নূতন শিল্প স্থাপনের জন্য, তিনি অনেক লিমিটেড কম্পানিতে টাকা দিয়েছিলেন ডিরেক্টারও হয়েছিলেন। অনেক কোম্পানী ফেল হওয়ায় বিস্তর টাকা খুইয়েছেন, সময়ে সময়ে বদনামও পেয়েছেন, কিন্তু ভূক্ষেপ করেননি। কোনও কম্পানি টাকা ধার করবে, উনি অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে জামিন হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর কম্পানি ফেল হলে অম্লানবদনে দণ্ড দিলেন। অনেকক্ষেত্রে আইন অনুসারে তিনি টাকা দিতে বাধ্য ছিলেন না, তার হিতার্থীরাও তাকে বারণ করেছিলেন, তবু তিনি টাকা দিয়েছিলেন–পাছে তার সাধুতায় কলঙ্ক হয়। মহাভারতে আছে–সকল শৌচের মধ্যে অর্থশৌচ শ্রেষ্ঠ। একথা তার চেয়ে কেউ বেশী বুঝত না, টাকাকড়ির দায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু তার কাছে টাকা ধার নিয়ে গাপ করবার লোকের অভাব হয়নি।