দোকানদার আর জনসাধারণ যাতে সাগুদানা আর এরারুট নামের অপপ্রয়োগ না করে তার ব্যবস্থা হওয়া উচিত। টাপিওকার দানা আর ভুট্টা প্রভৃতি থেকে তৈরি স্টার্চ নিষিদ্ধ করার দরকার নেই, কারণ কোনওটি অখাদ্য নয়। কিন্তু এমন আইন হওয়া উচিত যাতে খাদ্যবস্তু মাত্রই যথার্থ নামে বাজারে চলে। টাপিওকা-দানা, কাসাভা-দানা, শিমুল-দানা বা পালো দানা নাম চলতে পারে। সবরকম স্টার্চের সাধারণ নাম শ্বেতসার বা পালো দিলে দোষ হবে না।
ভারত সরকার সিন্থেটিক রাইস নাম দিয়ে চালের অনুকল্প তৈরির চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি বিলাতী নেচার পত্রে তার গবেষণার বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। এর প্রধান উপাদান টাপিওকার পালো আর চীনাবাদামের খোেল। এই নকল চালের রূপ আর পুষ্টিগুণ নাকি চালের মতই হবে। তথাপি এ জিনিসকে সিন্থেটিক রাইস নাম দেওয়া অন্যায়। আজকাল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যে নীল (ইন্ডিগো), কর্পূর, মেন্থল প্রভৃতি প্রস্তুত হচ্ছে তার আণবিক গঠন আর গুণ স্বভাবজাত বস্তুর সমান বা প্রায় সমান, সেজন্য সিন্থেটিক (সংশ্লেষিত) বিশেষণ সার্থক। কিন্তু সিন্থেটিক চাল ডাল মাছ মাংস ডিম প্রস্তুত করা মানুষের অসাধ্য। নকল চাল যতই সুখাদ্য হক, তা সিন্থেটিক হতে পারে না, তাকে ইমিটেশন রাইস বা নকল চালই বলা উচিত।
রবীন্দ্ররচনার বানান
বাংলা ভাষার এক বিশেষ সমস্যা অগণিত শব্দের ব্যাকরণ সম্মত একাধিক বিকল্প বানান–যা এই ভাষা শিক্ষা, রচনার শুদ্ধি রক্ষা ও মুদ্রণ পদ্ধতিকে জটিল ও বিশৃঙ্খল করে তুলছিল। এর সমাধান ও নিয়মাবলী সুনির্দিষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে বানান-সংস্কার সমিতি গঠন করেন, যার যোগ্যতম সভাপতিরূপে নির্বাচিত হন রাজশেখর বসু। সাধারণের প্রবল বিরোধ বিতর্ক ও মতানৈক্য পার হয়ে সমিতি-নির্দিষ্ট নিয়মাবলী প্রকাশিত হয়–এর বিশদ বিবরণ বানানের নিয়ম প্রবন্ধে আছে।
রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশের সময় বিশ্বভারতী এই বানানের সমতা ও সরলতা সম্বন্ধে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন অনুভব করেন, কারণ বহু বৎসরব্যাপী রচিত এই বিপুল সম্ভারে অবশ্যম্ভাবীরূপে বিস্তর বানান-পার্থক্য দেখা দিয়েছে কবি স্বয়ং তা স্বীকার করে কারণস্বরূপ ভাবনা ও অভ্যাসএর মধ্যে বৈষম্য নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছেন। এই সমস্যা অতিক্রম করে সমতা ও সরলতা আনার প্রায় শেষকথা রাজশেখরকে তাই চিঠি দিয়ে মতামত চেয়েছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে শ্রীকানাই সামন্ত। চিঠিটা পাই নি, তাই প্রশ্ন অনুপস্থিত। কিন্তু প্রায় সব উত্তরই স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং প্রায় এই নির্দেশ মেনেই আজও মুদ্রিত হয়ে চলেছে রবীন্দ্র রচনাবলী।
এই উত্তরমালাও এক সুরচিত প্রবন্ধ। –স:।
শ্ৰীযুক্ত কানাই সামন্তর প্রশ্নের উত্তর
১। কবির সকল বই-এর বানান ইত্যাদি সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তিনি নিজে একই পদ্ধতিতে চলেন নি, সর্বমান্য কোনও পদ্ধতি নেই। ভাষায় খুঁটিনাটি এত বেশী যে কবির গ্রন্থাবলীর জন্য একটা সম্পূর্ণ পদ্ধতি খাড়া করাও বৃহৎ ব্যাপার। সুতরাং যথাসম্ভব সংগতিরক্ষার চেষ্টা করা ভিন্ন উপায়ান্তর দেখি না।
কবি ইলেক পছন্দ করতেন না। ৫/৬ বৎসর আগে আমি একবার তাকে বলি-ও-কার লেখার চেয়ে ইলেক দেওয়া ঢের সোজা, আর তাতে শুধু দরকার মতন উচ্চারণ বোঝানো যায়, শব্দের পূর্বরূপ বিকৃত হয় না। কবি এই যুক্তি মেনেছিলেন। কিন্তু তখন হক হন ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা হয় নি। আমার ধারণা–ক্রিয়াপদের একটি বড় ফর্দ কবির সামনে ধরলে তিনি সংগতিরক্ষার উপায়স্বরূপ এই বানান মেনে নিতেন।
করি না, করি নে। গরু গোরু দুইই ঠিক মনে করি।
২। কি, কী।–কবির অভিপ্রায় মোটামুটি এই বুঝেছি।–অব্যয় কি (তাই কি? তাই নাকি, হাঁ কি না)। সর্বনাম কী (কী চাই, বল কী!)। বিশেষ ক্রিয়াবিশেষণ কী (কী জিনিস, কী করিয়া, কী বুদ্ধি!)। বোধ হয় সর্বত্র এই নিয়ম মানেন নি।
৩। দুই শব্দের মাঝে হাইফেন থাকবে, কি ফাঁক হবে, কিংবা জুড়ে দেওয়া হবে তার নিয়ম বাঁধা বোধ হয় অসম্ভব। ইংরেজীতেও সংগতি নেই। কবির কোনও নির্দিষ্ট মত ছিল বোধ হয় না। সংগতির আশা ত্যাগ করে আপনাদের পছন্দমত ছাপবেন। আমার পছন্দ-পরে বহুবচনবাচক শব্দ থাকলে জোড়া হবে (লোকগুলো, যেসকল)। দ্বিরুক্ত শব্দে ফাঁক (বার বার, ধীরে ধীরে)। কিন্তু দ্বিতীয় শব্দটি অর্থহীন বা ইত্যাদিসূচক হলে জোড়া (কাপড়চোপড়, গাছপালা)। অনুকার শব্দে জোড়া (চকচক, ঝনঝন)। ক্রিয়াবিশেষণ বা বিশেষণ বাচক হলে অনেক স্থলে জুড়লে ভাল হয়। (এজন্য, যেহেতু, যেরকম, সবচেয়ে, সবসুদ্ধ, হয়তো)। জোড়া বা না জোড়া অনেকটা উচ্চারণের উপর নির্ভর করে–যেকেউ, যে মানুষ (বা যে-মানুষ)। হাইফেন যথাসম্ভব কম হলে ভাল।
৪। কবি অসংস্কৃত শব্দে ঈ-কারের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তার আগেকার লেখায় ব্যতিক্রম আছে (চয়নিকা ৩০ সং।)–কাঙালিনী, বিজুলী, বিজুলি, পাখী, পশ্চিমী, বাঙালী, চখা চখীরে, চাহনী, ময়ূরকণ্ঠী, মাসী, বাঁশরী, হিন্দুস্থানী, গয়লানী)।
৫। কবির পুরনো বইএ ইংরাজি ইংরেজি দুইই। কিম্বা প্রভৃতি শব্দে করির যেখানে ং স্থানে ম লিখেছেন সেখানে বদলাবার দরকার নেই।