উক্ত সংজ্ঞার্থ অনুসারে রূপকথা পুরাণকথা কিংবদন্তী নকশা বা স্কেচ, নভেল প্রভৃতি ছোট বড় সব রকম আখ্যান স্টোরির অন্তর্গত, কিন্তু নভেলে বাস্তবতুল্য মানব-জীবনের একটানা বর্ণনা থাকা চাই। বাংলার উপন্যাস বললে মোটামুটি বোঝায় কয়েকজন পাত্রপাত্রীর জীবন ও চরিত্রের আনুপূর্বিক বিবরণ। উপন্যাসে মধ্য ঘটনাবলীই প্রধান, কিন্তু আদি ও অন্ত্য ঘটনারও অল্পাধিক বিবরণ আবশ্যক। পক্ষান্তরে গল্পে আদি মধ্য অন্ত্য যেখান থেকে হক এক খণ্ড ঘটনা দেখালেও চলে।
ইংরেজী স্টোরি শব্দ আজকাল অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে চলছে। অনেক ম্যাগাজিনে স্টোরি নামে এমনি রচনা ছাপা হয় যা সাধারণ বাঙালী পাঠকের বিচারে গল্প নয়। কৌতূহলজনক চিত্তাকর্ষক বা চিন্তার উদ্দীপক ক্ষুদ্র ঘটনার বিবরণও স্টোরি। বিষয়টি অসম্ভব হলেও ক্ষতি নেই। রবীন্দ্রনাথের কর্তার ভূত আর আপনার (বনফুলের) জ্যামিতিক গল্প ক খ গ নিঃসন্দেহে স্টোরি।
অতএব গল্প বা স্টোরির অর্থ উপন্যাস বা নভেলের চাইতে ব্যাপক। উপন্যাস গল্পের অন্তর্গত, কিন্তু গল্প মাত্রই উপন্যাস নয়। গল্পের আকার যাই হক, তার বিষয় অসংখ্য। অধিকাংশ উপন্যাসের উপজীব্য বিরহ-মিলন কথা। যাতে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পূর্ণ ও সবিস্তার বিবরণ থাকে তাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। বহুকাল পূর্বে একটি ইংরেজী ছড়া শুনেছিলাম, কার তৈরি জানি না। এই ছড়াটিকে যাবতীয় মিলনান্ত প্রেমোপন্যাসের ঘনীভূত নির্যাস বলা যেতে পারে–
Mister Miss
Meet, kiss
More kisses
Mr. & Mrs.
প্রেম (মামুলী ও বিকৃত) বহুকাল কথাসাহিত্যের প্রধান অবলম্বন ছিল, কিন্তু এখন তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়েছে খুন চুরি প্রভৃতি অপরাধ এবং রোমাঞ্চকর রহস্য। ডিটেকটিভ কাহিনীর পাঠক সব দেশেই বেশী, কিন্তু বাঙালী রচয়িতা এখনও কোনান ডয়েল এডগার ওআলেস প্রভৃতির তুল্য মর্যাদা পান নি। ইংরেজী গল্পের বিষয়ের সীমা নেই, Erewhon, Perguin Island, Animal Farm প্রভৃতি রূপক গল্প খুব জনপ্রিয়। বাঙালী পাঠকের রুচির বৈচিত্র্যও পূর্বের তুলনায় বেড়ে গেছে।
সংস্কৃতে কবি বললে কথাকারও বোঝায়। যিনি রসের উপলব্ধি করেন এবং নিজ রচনার দ্বারা সেই রস অন্যের মনে সঞ্চারিত করেন তিনিই কবি। (ভাগ্যক্রমে রসের ইংরেজী নেই)। কাব্যকার আর কথাকার দুজনেই রসের ভাবক ও সঞ্চারক, যদিও তাদের কলাবিধি পৃথক। যে লেখক শুধু পাঠকের রুচির বশে চলেন তিনি পেশাদার মাত্র। যিনি নিজের নব নব রসানুভূতি ব্যক্ত করে পাঠকের রুচি প্রভাবিত করতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।
বিষয়ের বৈচিত্র্যে আপনি আমাদের কথাকারদের মধ্যে অদ্বিতীয়। বাস্তব, কাল্পনিক, অসম্ভব, রূপক, প্রতীকময়, সব রকম রচনাই আপনার আয়ত্ত। আপনি যা লেখেন তা ছোট গল্প কি বড় গল্প কি উপন্যাস তার বিচার নিরর্থক। গদ্যপদ্যময় চম্পুকাব্য মৃগয়া, অলৌকিক রূপক বৈতরণী তীরে, বিচিত্র চরিত্রচিত্র যেমন নাথুনীর মা, ছোট লোক, বিজ্ঞান, দেশী ও বিলাতী, সবই আপনার সার্থক সৃষ্টি। অতিকায় প্রাণীর মতন কালবশে মহাকাব্য লোপ পেয়েছে। আমার বিশ্বাস, মহোপন্যাসও ক্রমশ লোপ পাবে, ছোট রচনাতেই সুধীজনের আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হবে। ভূরিভোজী পাঠক-পাঠিকার জন্য আপনি জঙ্গম লিখে প্রচুর ক্যালরি সরবরাহ করুন। কিন্তু মিতাহারীও অনেক আছে, তাদের জন্য নানাবিধ জীবনীর রসও লঘুমাত্রায় পরিবেশন করতে থাকুন।
তামাক ও বড় তামাক
মানুষ ও জন্তুর মধ্যে প্রধান প্রভেদ এই যে, মানুষ নেশা করিতে শিখিয়াছে, জন্তু শেখে নাই। বিড়াল দুধ মাছ খায়, অভাবে পড়িলে হাঁড়ি খায়, ঔষধার্থে ঘাস খায়, কিন্তু তাকে তামাকের পাতা বা গাঁজার জটা চিবাইতে কেউ দেখে নাই। মানুষ অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করে, ঘর-সংসার পাতে, জীবন ধারণের জন্য যা-কিছু আবশ্যক সমস্তই সাধ্যমত সংগ্রহ করে, কিন্তু এতেই তার তৃপ্তি হয় না–সে একটু নেশাও চায়। অবশ্য গম্ভীর-প্রকৃতি হিসাবী লোকের কথা আলাদা। তাঁদের কাছে নেশা মাত্রই অনাবশ্যক; কারণ তাতে দেহের পুষ্টি হয় না, জ্ঞানেরও বৃদ্ধি হয় না, বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে অপকারই হয়। তথাপি বহু লোক কোনও অজ্ঞাত অভাব মিটাইবার জন্য নেশার শরণাপন্ন হয়।
নেশা বহু প্রকার, যথা তামাক গাঁজা মদ সঙ্গীত কাব্য উপন্যাস প্রভৃতি। সকলগুলির চর্চার স্থান এই ক্ষুদ্র পত্রিকায় নাই, সুতরাং তামাক ও গাঁজা সম্বন্ধেই কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাক।
তামাক আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই তার নিন্দক জুটিয়াছে। তামাক খাইলে ক্ষুধা নষ্ট হয়, বুদ্ধি জড় হয়, হৃৎপিণ্ড দূষিত হয়, ইত্যাদি। কিন্তু কে গ্রাহ্য করে? জগতের আবাল-বৃদ্ধ তামাকের সেবক, বনিতারাও হইয়া উঠিতেছেন। তামাকের বিরুদ্ধে যেসব ভীষণ অভিযোগ শোনা যায়, তামাক-খোর তার খণ্ডনের কোন প্রয়াসই করে না, শুধু একটু হাসে ও নির্বিকারচিত্তে টানে। • কিন্তু তাদের অন্তরে যে জবাব অস্ফুট হইয়া আছে, আমরা তার কতকটা আন্দাজ করিতে পারি। মশায়, তামাক জিনিসটা স্বাস্থ্যের অনুকূল না হইতে পারে, কিন্তু স্বাস্থ্যই কি সব চেয়ে বড়? একটু না হয় ক্ষুধা কমিল, চেহারায় পাক ধরিল, হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করিল, কিন্তু আনন্দটা কি কিছুই নয়? মোটের উপর লাভটাই আমাদের বেশী। লোকসানের মাত্রা যদি বেশী হইত, তবে আপনিই আমরা ছাড়িয়া দিতাম, উপদেশের অপেক্ষা রাখিতাম না। আমাদের শরীর মন বেশ ভালই আছে, ভদ্র-সমাজে কেউ আমাদের অবজ্ঞা করে না। হাঁ, কোন কোন অর্বাচীনের তামাক খাইলে মাথা ঘোরে তা মানি; কিন্তু দু-এক জনের দুর্বলতার জন্য আমরা এত লোক কেন এই আনন্দ হইতে বঞ্চিত হইব?