শয়নকালে দুর্গা বলে আজ্ঞা দেহ স্বামী।
ইচ্ছা হয় যে বাপের বাড়ি কাল যাইব আমি॥
শুন গৌরী কৈলাসপুরী তুচ্ছ তোমার ঠাঁই।
দেখছি তোমার কাঙাল পিতার ঘর-দরজা নাই॥
শেষ দুইটি ছত্র বুঝিতে একটু গোল হয়; ইহার অর্থ এই যে তোমার বাসের পক্ষে কৈলাসপুরীই তুচ্ছ, এমন স্থলে তোমার কাঙাল পিতা তোমাকে স্থান দিতে পারেন এমন সাধ্য তাঁহার কী আছে।
পতিকে লইয়া পিতার সহিত বিরোধ করিতে হয়, আবার পিতাকে লইয়া পতির সহিত বিবাদ বাধিয়া উঠে, উমার এমনি অবস্থা।
গৌরী কন, আমি কইলে মিছে দন্দেজ হবে।
সেই-যে আমার কাঙাল পিতা ভিক্ষা মাংছেন কবে॥
তারা রাজার বেটা, দালান-কোঠা অট্টালিকাময়।
যাগযজ্ঞ করছে কত শ্মশানবাসী নয়॥
তারা নানা দানপুণ্যবান দেবকার্য করে।
এক দফাতে কাঙাল বটে, ভাঙ নাই তার ঘরে॥
কিন্তু কড়া জবাব দিয়া কার্যোদ্ধার হয় নাই। বরং তর্কে পরাস্ত হইলে গায়ের জোর আরো বাড়িয়া উঠে। সেই বুঝিয়া দুর্গা তখন–
গুটি পাঁচ-ছয় সিদ্ধির লাড়ু যত্ন ক’রে দিলেন।
দাম্পত্যযুদ্ধে এই ছয়টি সিদ্ধির লাড়ু কামানের ছয়টা গোলার মতো কাজ করিল; ভোলানাথ এক-দমে পরাভূত হইয়া গেলেন। সহসা পিতা কন্যা জামাতার ঘনিষ্ঠ মিলন হইয়া গেল। বাক্যহীন নন্দী সকৌতুক ভক্তিভরে দ্বারপার্শ্বে দাঁড়াইয়া মনে মনে হাসিতে লাগিল।
সম্ভ্রমে সম্ভাষণ করি বসলেন তিন জন।
দুগা, মর্তে যেয়ে কী আনিবে আমার কারণ॥
প্রতিবারে কেবলমাত্র বিল্বপত্র পাই।
দেবী বললেন, প্রভু ছাড়া কোন্ দ্রব্য খাই॥
সিঁদুর-ফোঁটা অলকছটা মুক্তা গাঁথা কেশে।
সোনার ঝাঁপা কনকচাঁপা, শিব ভুলেছেন যে বেশে॥
রত্নহার গলে তার দুলছে সোনার পাটা।
চাঁদনি রাত্রিতে যেন বিদ্যুৎ দিচ্ছে ছটা॥
তাড় কঙ্কণ সোন্ পৈঁছি শঙ্খ বাহুমূলে।
বাঁক-পরা মল সোনার নূপুর, আঁচল হেলে দোলে॥
সিংহাসন, পট্টবসন পরছে ভগবতী।
কার্তিক গণেশ চললেন লক্ষ্মী সরস্বতী॥
জয়া বিজয়া দাসী চললেন দুইজন।
গুপ্তভাবে চললেন শেষে দেব পঞ্চানন॥
গিরিসঙ্গে পরম রঙ্গে চললেন পরম সুখে।
ষষ্ঠী তিথিতে উপনীত হলেন মর্তলোকে॥
সারি সারি ঘটবারি আর গঙ্গাজল।
সাবধানে নিজমনে গাচ্ছেন মঙ্গল॥
তখন–
গিরিরানী কন বাণী চুমো দিয়ে মুখে
কও তারিণী জামাই-ঘরে ছিলে কেমন সুখে॥
এ ছড়াটি এইখানে শেষ হইল, ইহার বেশি আর বলিবার কথা নাই। এ দিকে বিদায়ের কাল সমাগত। কন্যাকে লইয়া শ্বশুরঘরের সহিত বাপের ঘরের একটু ঈর্ষার ভাব থাকে। বেশিদিন বধূকে বাপের বাড়িতে রাখা শ্বশুরপক্ষের মনঃপূত নহে। বহুকাল পরে মাতায় কন্যায় যথেষ্ট পরিতৃপ্তিপূর্বক মিলন হইতে না হইতেই শ্বশুরবাড়ি হইতে তাগিদ আসে, ধন্না বসিয়া যায়। স্ত্রীবিচ্ছেদবিধুর স্বামীর অধৈর্য তাহার কারণ নহে। হাজার হউক, বধূ পরের ঘর হইতে আসে; শ্বশুরঘরের সহিত তাহার সম্পূর্ণ জোড় লাগা বিশেষ চেষ্টার কাজ। সেখানকার নূতন কর্তব্য অভ্যাস ও পরিচয়বন্ধন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার বাল্যকালের স্বাভাবিক আশ্রয়স্থলে ঘন ঘন যাতায়াত বা দীর্ঘকাল অবস্থিতি করিতে দিলে জোড় লাগিবার ব্যাঘাত করে। বিশেষত বাপের বাড়িতে বিবাহিতা কন্যার কেবলই কর্তব্যহীন আদর, শ্বশুরবাড়িতে তাহার কর্তব্যের শাসন, এমন অবস্থায় দীর্ঘকাল বাপের বাড়ির আবহাওয়া শ্বশুরবর্গ বধূর পক্ষে প্রার্থনীয় জ্ঞান করেন না। এই-সকল নানা কারণে পিতৃগৃহে কন্যার গতিবিধিসম্বন্ধে শ্বশুরপক্ষীয়ের বিধান কিছু কঠোর হইয়াই থাকে। কন্যাপিতৃত্বের সেই একটা কষ্ট। বিজয়ার দিন বাংলাদেশের শ্বশুরবাড়ির সেই কড়া তাগিদ লইয়া শিব মেনকার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত। মাতৃস্নেহের স্বাভাবিক অধিকার সমাজ-শাসনের বিরুদ্ধে বৃথা আছাড় খাইয়া মরিতে লাগিল।
নাহি কাজ গিরিরাজ, শিবকে বলো যেয়ে
অমনি ভাবে ফিরে যাক সে, থাকবে আমার মেয়ে॥
তখন, শ্বশুরবাড়িতে দুর্গার যত কিছু দুঃখ আছে সমস্ত মাতার মনে পড়িতে লাগিল। শিবের ভাণ্ডারে যত অভাব, আচরণে যত ত্রুটি, চরিত্রে যত দোষ, সমস্ত তাঁহার নিকট জাজ্বল্যমান হইয়া উঠিল। অপাত্রে কন্যাদান করিয়াছেন, এখন সেটা যতটা পারেন সংশোধন করিবার ইচ্ছা, যতটা সম্ভব গৌরীকে মাতৃক্রোড়ে ফিরাইয়া লইবার চেষ্টা। শ্বশুরগৃহের আচারবিচার অনেক সময় দূর হইতে পিতৃগৃহের নিকট অযথা বলিয়া মনে হয় এবং পিতৃপক্ষীয়েরা স্নেহের আক্ষেপে কন্যার সমক্ষেই তাহার কঠোর সমালোচনা করিয়া থাকেন। মেনকা তাই শুরু করিলেন, এবং শিব সেই অন্যায় আচরণে ক্ষিপ্ত হইয়া শ্বশুরবাড়ির অনুশাসন সতেজে প্রচার করিয়া দিলেন।
মর্তে আসি পূর্বকথা ভুলছ দেখি মনে।
বারে বারে নিষেধ তোমায় করছি এ কারণে।
মায়ের কোলে মত্ত হয়ে ভুলছ দেখি স্বামী।
তোমার পিতা কেমন রাজা তাই দেখব আমি॥
শুনে কথা গিরিরাজা উষ্মাযুক্ত হল।
জয়-জোগাড়ে অভয়ারে যাত্রা করে দিল॥
যে নিবে সে ক’তে পারে, নইলে এমন শক্তি কার।
যাও তারিণী হরের ঘরে, এসো পুনর্বার॥
অনুগ্রহের সংকীর্ণ মেয়াদ উত্তীর্ণ হইল, কন্যা পতিগৃহে ফিরিয়া গেল।
এক্ষণে যে ছড়ার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি তাহাতে দেবদেবীর একটি গোপন ঘরের কথা বর্ণিত আছে।
শিব সঙ্গে রসরঙ্গে বসিয়ে ভবানী।
কুতূহলে উমা বলেন ত্রিশূল শূলপাণি॥
তুমি প্রভু, তুমি প্রভু ত্রৈলোক্যের সার।
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের বরুণ তোমারি কিংকর॥
তোমার নারী হয়ে আমার সাধ নাহি পোরে।
যেন বেন্যা পতির কপালে প’ড়ে রমণী ঝোরে॥
দিব্য সোনার অলংকার না পরিলাম গায়।
শামের বরন দুই শঙ্খ পরতে সাধ যায়॥
দেবের কাছে মরি লাজে হাত বাড়াতে নারি।
বারেক মোরে দাও শঙ্খ, তোমার ঘরে পরি॥
ভোলানাথ ভাবিলেন, একটা কৌতুক করা যাক, প্রথমেই একটু কোন্দল বাধাইয়া তুলিলেন।