- বইয়ের নামঃ লোকসাহিত্য
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ আপন প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
কবি-সংগীত
বাংলার প্রাচীন কাব্যসাহিত্য এবং আধুনিক কাব্যসাহিত্যের মাঝখানে কবি-ওয়ালাদের গান। ইহা এক নূতন সামগ্রী এবং অধিকাংশ নূতন পদার্থের ন্যায় ইহার পরমায়ু অতিশয় স্বল্প। একদিন হঠাৎ গোধূলির সময়ে যেমন পতঙ্গে আাকাশ ছাইয়া যায়| মধ্যাহ্নের আলোকেও তাহাদিগকে দেখা যায় না এবং অন্ধকার ঘনীভূত হইবার পূর্বেই তাহারা অদৃশ্য হইয়া যায়, এই কবির গানও সেইরূপ এক সময়ে বঙ্গসাহিত্যের স্বল্পক্ষণস্থায়ী গোধূলি-আকাশে অকস্মাৎ দেখা দিয়াছিল–তৎপূর্বেও তাহাদের কোনো পরিচয় ছিল না, এখনো তাহাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।
গীতিকবিতা বাংলাদেশে বহুকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে এবং গীতিকবিতাই বঙ্গসাহিত্যের প্রধান গৌরবস্থল। বৈষ্ণব কবিদের পদাবলী বসন্তকালের অপর্যাপ্ত পুষ্পমঞ্জরীর মতো; যেমন তাহার ভাবের সৌরভ তেমনি তাহার গঠনের সৌন্দর্য। রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য। আমাদের বর্তমান সমালোচ্য এই “কবির গান’গুলিও গান, কিন্তু ইহাদের মধ্যে সেই ভাবের গাঢ়তা এবং গঠনের পারিপাট্য নাই।
না থাকিবার কিছু কারণও আছে। পূর্বকালের গানগুলি, হয় দেবতার সম্মুখে নয় রাজার সম্মুখে গীত হইত–সুতরাং স্বতই কবির আদর্শ অত্যন্ত দুরূহ ছিল। সেইজন্য রচনার কোনো অংশেই অবহেলার লক্ষণ ছিল না, ভাব ভাষা ছন্দ রাগিণী সকলেরই মধ্যে সৌন্দর্য এবং নৈপুণ্য ছিল। তখন কবির রচনা করিবার এবং শ্রোতৃগণের শ্রবণ করিবার অব্যাহত অবসর ছিল; তখন গুণীসভায় গুণাকর কবির গুণপনা-প্রকাশ সার্থক হইত।
কিন্তু ইংরাজের নূতনসৃষ্ট রাজধানীতে পুরাতন রাজসভা ছিল না, পুরাতন আদর্শ ছিল না। তখন কবির আশ্রয়দাতা রাজা হইল সর্বসাধারণ-নামক এক অপরিণত স্থূলায়তন ব্যক্তি, এবং সেই হঠাৎ-রাজার সভার উপযুক্ত গান হইল কবির দলের গান। তখন যথার্থ সাহিত্যরস-আলোচনার অবসর যোগ্যতা এবং ইচ্ছা কয়জনের ছিল? তখন নূতন রাজধানীর নূতন-সমৃদ্ধি-শালী কর্মশ্রান্ত বণিক্সম্প্রদায় সন্ধ্যাবেলায় বৈঠকে বসিয়া দুই দণ্ড আমোদের উত্তেজনা চাহিত, তাহারা সাহিত্যরস চাহিত না।
কবির দল তাহাদের সেই অভাব পূর্ণ করিতে আসরে অবতীর্ণ হইল। তাহারা পূববর্তী গুণীদের গানে অনেক পরিমাণে জল এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণে চটক মিশাইয়া, তাহাদের ছন্দোবন্ধ সৌন্দর্য সমস্ত ভাঙিয়া নিতান্ত সুলভ করিয়া দিয়া, অত্যন্ত লঘু সুরে উচ্চৈঃস্বরে চারিজোড়া ঢোল ও চারিখানি কাঁসি-সহযোগে সদলে সবলে চীৎকার করিয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে লাগিল। কেবল গান শুনিবার এবং ভাবরস সম্ভোগ করিবার যে সুখ তাহাতেই তখনকার সভ্যগণ সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাহার মধ্যে লড়াই এবং হার-জিতের উত্তেজনা থাকা আবশ্যক ছিল। সরস্বতীর বীণার তারেও ঝন্ ঝন্ শব্দে ঝংকার দিতে হইবে, আবার বীণার কাষ্ঠদণ্ড লইয়াও ঠক্ ঠক্ শব্দে লাঠি খেলিতে হইবে। নূতন হঠাৎ-রাজার মনোরঞ্জনার্থে এই এক অপূর্ব নূতন ব্যাপারের সৃষ্টি হইল। প্রথমে নিয়ম ছিল, দুই প্রতিপক্ষদল পূর্ব হইতে পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর-প্রত্যুত্তর লিখিয়া আনিতেন; অবশেষে তাহাতেও তৃপ্তি হইল না, আসরে বসিয়া মুখে মুখেই বাগযুদ্ধ চলিতে লাগিল। এরূপ অবস্থায় যে কেবল প্রতিপক্ষকে আহত করা হয়| তাহা নহে, ভাষা ভাব ছন্দ সমস্তই ছারখার হইতে থাকে। শ্রোতারাও বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না–কথার কৌশল, আনুপ্রাসের ছটা এবং উপস্থিতমত জবাবেই সভা জমিয়া উঠে এবং বাহবা উচ্ছ্বসিত হইতে থাকে। তাহার উপরে আবার চারজোড়া ঢোল, চারখানা কাঁসি এবং সম্মিলিত কণ্ঠের প্রাণপণ চীৎকার–বিজনবিলাসিনী সরস্বতী এমন সভায় অধিকক্ষণ টিঁকিতে পারেন না।
সৌন্দর্যের সরলতা যাহাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না, ভাবের গভীরতায় যাহাদের নিমগ্ন হইবার অবসর নাই, ঘন ঘন অনুপ্রাসে অতি শীঘ্রই তাহাদের মনকে উত্তেজিত করিয়া দেয়। সংগীত যখন বর্বর অবস্থায় থাকে তখন তাহাকে রাগরাগিণীর যতই অভাব থাক্, তালপ্রয়োগের খচমচ কোলাহল যথেষ্ট থাকে। সুরের অপেক্ষা সেই ঘন ঘন সশব্দ আঘাতে অশিক্ষিত চিত্ত সহজে মাতিয়া উঠে। এক শ্রেণীর কবিতায় অনুপ্রাস সেইরূপ ক্ষণিক ত্বরিত সহজ উত্তেজনার উদ্রেক করে। সাধারণ লোকের কর্ণ অতি শ্রীঘ্র আকর্ষণ করিবার সুলভ উপায় অল্পই আছে। অনুপ্রাস যখন ভাব ভাষা ও ছন্দের অনুগামী হয় তখন তাহাতে কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, কিন্তু সে সকলকে ছাড়াইয়া ছাপাইয়া উঠিয়া যখন মূঢ় লোকের বাহবা লইবার জন্য অগ্রসর হয় তখন তদ্দ্বারা সমস্ত কবিতা ইতরতা প্রাপ্ত হয়।
কবিদলের গানে অনেক স্থলে অনুপ্রাস, ভাব ভাষা এমন-কি, ব্যাকরণকে ঠেলিয়া ফেলিয়া শ্রোতাদের নিকট প্রগলভতা প্রকাশ করিতে অগ্রসর হয়। অথচ তাহার যথার্থ কোনো নৈপুণ্য নাই; কারণ, তাহাকে ছন্দোবদ্ধ অথবা কোনো নিয়ম রক্ষা করিয়াই চলিতে হয় না। কিন্তু যে শ্রোতা কেবল ক্ষণিক আমোদে মাতিয়া উঠিতে চাহে, সে এত বিচার করে না এবং যাহাতে বিচার আবশ্যক এমন জিনিসও চাহে না।
গেল গেল কুল কুল, যাক কুল–
তাহে নই আকুল।
লয়েছি যাহার কুল সে আমারে প্রতিকূল॥
যদি কুলকুণ্ডলিনী অনুকূলা হন আমায়
অকূলের তরী কূল পাব পুনরায়॥
এখন ব্যাকুল হয়ে কি দুকূল হারাব সই।
তাহে বিপক্ষ হাসিবে যত রিপুচয়॥
পাঠকেরা দেখিতেছেন, উপরি উদ্ধৃত গীতাংশে এক কুল শব্দের কূল পাওয়া দুষ্কর হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে কোনো গুণপনা নাই; কারণ, উহার অধিকাংশই একই শব্দের পুনরাবৃত্তিমাত্র। কিন্তু শ্রোতৃগণের কোনো বিচার নাই, তাঁহারা অত্যন্ত সুলভ চাতুরীতে মুগ্ধ হইতে প্রস্তুত আছেন। এমন-কি,যদি অনুপ্রাসছটার খাতিরে কবি ব্যাকরণ এবং শব্দশাস্ত্র সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করেন তাহাতেও কাহারো আপত্তি নাই। দৃষ্টান্ত–
একে নবীন বয়স তাতে সুসভ্য,
কাব্যরসে রসিকে।
মাধুর্য গাম্ভীর্য, তাতে “দাম্ভীর্য’ নাই,
আর আর বউ যেমন ধারা ব্যাপিকে॥
অধৈর্য হেরে তোরে স্বজনী, ধৈর্য ধরা নাহি যায়।
যদি সিদ্ধ হয় সেই কার্য করব সাহায্য,
বলি, তাই বলে যা আমায়॥
একে বাংলা শব্দের কোনো ভার নাই, ইংরাজি প্রথামত তাহাতে অ্যাক্সেণ্ট্ নাই, সংস্কৃত প্রথামত তাহাতে হ্রস্ব-দীর্ঘ রক্ষা হয় না, তাহাতে আবার সমালোচ্য কবির গানে সুনিয়মিত ছন্দের বন্ধন না থাকাতে এই-সমস্ত অযত্নকৃত রচনাগুলিকে শ্রোতার মনে মুদ্রিত করিয়া দিবার জন্য ঘন ঘন অনুপ্রাসের বিশেষ আবশ্যক হয়। সোজা দেয়ালের উপর লতা উঠাইতে গেলে যেমন মাঝে মাঝে পেরেক মারিয়া তাহার অবলম্বন সৃষ্টি করিয়া যাইতে হয়, এই অনুপ্রাসগুলিও সেইরূপ ঘন ঘন শ্রোতাদের মনে পেরেক মারিয়া যাওয়া; অনেক নির্জীব রচনাও এই কৃত্রিম উপায়ে অতি দ্রুতবেগে মনোযোগ আচ্ছন্ন করিয়া বসে। বাংলা পাঁচালিতেও এই কারণেই এত অনুপ্রাসের ঘটা।
উপস্থিতমত সাধারণের মনোরঞ্জন করিবার ভার লইয়া কবিদলের গান–ছন্দ এবং ভাষার বিশুদ্ধি ও নৈপুণ্য বিসর্জন দিয়া কেবল সুলভ অনুপ্রাস ও ঝুঁটা অলংকার লইয়া কাজ সারিয়া দিয়াছে; ভাবের কবিত্ব সম্বন্ধেও তাহার মধ্যে বিশেষ উৎকর্ষ দেখা যায় না। পূর্ববর্তী শাক্ত এবং বৈষ্ণব মহাজনদিগের ভাবগুলিকে অত্যন্ত তরল এবং ফিকা করিয়া কবিগণ শহরের শ্রোতাদিগকে সুলভ মূল্যে যোগাইয়াছেন। তাঁহাদের যাহা সংযত ছিল এখানে তাহা শিথিল এবং বিকীর্ণ। তাঁহাদের কুঞ্জবনে যাহা পুষ্প-আকারে প্রফুল্ল এখানে তাহা বাসি ব্যঞ্জন-আকারে সম্মিশ্রিত।
অনেক জিনিস আছে যাহাকে স্বস্থান হইতে বিচ্যুত করিলে তাহা বিকৃত এবং দূষণীয় হইয় উঠে। কবির গানেও সেইরূপ অনেক ভাব তাহার যথাস্থান হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া কলুষিত হইয়া উঠিয়াছে। এ কথা স্বীকার করিতে হইবে যে, বৈষ্ণব কবিদের পদাবলীর মধ্যে এমন অংশ আছে যাহা নির্মল নহে, কিন্তু সমগ্রের মধ্যে তাহা শোভা পাইয়া গিয়াছে। কবিওয়ালা সেইটিকে তাহার সজীব আশ্রয় হইতে তাহার সৌন্দর্যপরিবেষ্টন হইতে, বিচ্ছিন্ন করিয়া ইতর ভাষা এবং শিথিল ছন্দ-সহযোগে স্বতন্ত্রভাবে আমাদের সম্মুখে ধরিলে তাহা গলিত পদার্থের ন্যায় কদর্য মূর্তি ধারণ করে।
বৈষ্ণব কাব্যে প্রেমের নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে রাধার খণ্ডিতা অবস্থার বর্ণনা আছে। আধ্যাত্মিক অর্থে ইহার কোনো বিশেষ গৌরব থাকিতে পারে, কিন্তু সাহিত্য হিসাবে শ্রীকৃষ্ণের এই কামূক ছলনার দ্বারা কৃষ্ণরাধার প্রেমকাব্যের সৌন্দর্যও খণ্ডিত হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। রাধিকার এই অবমাননায় কাব্যশ্রীও অবমানিত হইয়াছে।
কিন্তু প্রচুর স্যেন্দর্যরাশির মধ্যে এ-সকল বিকৃতি আমরা চোখ মেলিয়া দেখি না–সমগ্রের সৌন্দর্যপ্রভাবে তাহার দূষণীয়তা অনেকটা দূর হইয়া যায়। লৌকিক অর্থে ধরিতে গেলে বৈষ্ণব কাব্যে প্রেমের আদর্শ অনেক স্থলে স্খলিত হইয়াছে, তথাপি সমগ্র পাঠের পর যাহার মনে একটা সুন্দর এবং উন্নত ভাবের সৃষ্টি না হয়, সে হয় সমস্তটা ভালো করিয়া পড়ে নাই নয় সে যথার্থ কাব্যরসের রসিক নহে।
কিন্তু আমাদের কবিওয়ালারা বৈষ্ণব কাব্যের সৌন্দর্য এবং গভীরতা নিজেদের এবং শ্রোতাদের আয়ত্তের অতীত জানিয়া প্রধানত যে অংশ নির্বাচিত করিয়া লইয়াছেন তাহা অতি অযোগ্য। কলঙ্ক এবং ছলনা ইহাই কবিওয়ালাদের গানের প্রধান বিষয়। বারংবার রাধিকা এবং রাধিকার সখীগণ কুব্জাকে অথবা অপরাকে লক্ষ করিয়া তীব্র সরস পরিহাসে শ্যামকে গঞ্জনা করিতেছেন। তাঁহাদের আরো একটি রচনার বিষয় আছে, স্ত্রী-পক্ষ এবং পুরুষ-পক্ষের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস-প্রকাশ-পূর্বক দোষারোপ করা; সেই শখের কলহ শুনিতে শুনিতে ধিক্কার জন্মে।
যাহাদের প্রকৃত আত্মসম্মানজ্ঞান দৃঢ় তাহারা সর্বদা অভিমান প্রকাশ করিতে অবজ্ঞা করিয়া থাকে। তাহাদের মানে আঘাত লাগিলে, হয় তাহারা স্পষ্টরূপে তাহার প্রতিকার করে নয় তাহা নিঃশব্দে উপেক্ষা করিয়া যায়। প্রিয়জনের নিকট হইতে প্রেমে আঘাত লাগিলে, হয় তাহা গোপনে বহন করে নয় সাক্ষাৎভাবে সম্পূর্ণরূপে তাহার মীমাংসা করিয়া লয়। আমাদের দেশে ইহা সর্বদাই দেখিতে পাওয়া যায়, পরাধীনতা যাহার অবলম্বন সেই অভিমানী, যে এক দিকে ভিক্ষুক তাহার অপর দিকে অভিমানের অন্ত নাই, যে সর্ববিষয়ে অক্ষম সে কথায় কথায় অভিমান প্রকাশ করিয়া থাকে। এই অভিমান জিনিসটি বাঙালি প্রকৃতির মজ্জাগত নির্লজ্জ দুর্বলতার পরিচায়ক।
দুর্বলতা স্থলবিশেষে এবং পরিমাণবিশেষে সুন্দর লাগে। স্বল্প উপলক্ষে অভিমান কখনো কখনো স্ত্রীলোকদিগকে শোভা পায়। যতক্ষণ নায়কের প্রেমের প্রতি নায়িকার যথার্থ দাবি থাকে ততক্ষণ মাঝে মাঝে ক্রীড়াচ্ছলে অথবা স্বল্প অপরাধের দণ্ডচ্ছলে পুরুষের প্রেমাবেগকে কিয়ৎকালের জন্য প্রতিহত করিলে সে অভিমানের একটা মাধুর্য দেখা যায়। কিন্তু গুরুতর অপরাধ অথবা বিশ্বাসঘাতের দ্বারা নায়ক যখন সেই প্রেমের মূলেই কুঠারাঘাত করে তখন যথারীতি অভিমান প্রকাশ করিতে বসিলে নিজের প্রতি একান্ত অবমাননা প্রকাশ করা হয় মাত্র, এইজন্য তাহাতে কোনো সৌন্দর্য নাই এবং তাহা কাব্যে স্থান পাইবার যোগ্য নহে।
দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে স্বামীকৃত সকল-প্রকার অসম্মাননা এবং অন্যায় স্ত্রীকে অগত্যা সহ্য এবং মার্জনা করিতেই হয়–কিঞ্চিৎ অশ্রুজলসিক্ত বক্রবাক্যবাণ অথবা কিয়ৎকাল অবগুণ্ঠনাকৃত বিমুখ মৌনাবস্থা ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নাই। অতএব আমাদের সমাজে স্ত্রীলোকের সর্বদা অভিমান জিনিসটা সত্য সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহা সর্বত্র সুন্দর নহে ইহাও নিশ্চয়; কারণ, যাহাতে কাহারো অবিমিশ্র স্থায়ী হীনতা প্রকাশ করে তাহা কখনোই সুন্দর হইতে পারে না।
কবিদলের গানে রাধিকার যে অভিমান প্রকাশ হইয়াছে তাহা প্রায়শই এইরূপ অযোগ্য অভিমান।
সাধ ক’রে করেছিলেম দুর্জয় মান,
শ্যামের তায় হল অপমান।
শ্যামকে সাধলেম না, ফিরে চাইলেম না,
কথা কইলেম না রেখে মান॥
কৃষ্ণ সেই রাগের অনুরাগে, রাগে রাগে গো,
পড়ে পাছে চন্দ্রাবলীর নবরাগে।
ছিল পূর্বের যে পূর্বরাগ, আবার একি অপূর্ব রাগ,
পাছে রাগে শ্যাম রাধার আদর ভুলে যায়॥
যার মানের মানে আমায় মানে, সে না মানে
তবে কি করবে এ মানে।
মাধবের কত মান না হয় তার পরিমাণ,
মানিনী হয়েছি যার মানে॥
যে পক্ষে যখন বাড়ে অভিমান,
সেই পক্ষে রাখতে হয় সম্মান।
রাখতে শ্যামের মান, গেল গেল মান,
আমার কিসের মান-অপমান॥
এই কয়েক ছত্রের মধ্যে প্রেমের যেটুকু ইতিহাস যে ভাবে লিপিবদ্ধ হইয়াছে তাহাতে কৃষ্ণের উপরেও শ্রদ্ধা হয় না, রাধিকার উপরেও শ্রদ্ধা হয় না, এবং চন্দ্রাবলীর উপরেও অবজ্ঞার উদয় হয়।
কেবল নায়ক-নায়িকার অভিমান নহে, পিতা-মাতার প্রতি কন্যার অভিমানও কবিদলের গানে সর্বদাই দেখিতে পাওয়া যায়। গিরিরাজমহিষীর প্রতি উমার যে অভিমানকলহ তাহাতে পাঠকের বিরক্তি উদ্রেক করে না–তাহা সর্বত্রই সুমিষ্ট বোধ হয়। তাহার কারণ, মাতৃস্নেহে উমার যথার্থ অধিকার সন্দেহ নাই; কন্যা ও মাতার মধ্যে এই-যে আঘাত ও প্রতিঘাত তাহাতে স্নেহসমুদ্র কেবল সুন্দরভাবে তরঙ্গিত হইয়া উঠে।
মাতা-কন্যা এবং নায়ক-নায়িকার মান-অভিমান যে কবিদলের গানের প্রধান বিষয় তাহার একটা কারণ, বাঙালির প্রকৃতিতে অভিমানটা কিছু বেশি; অর্থাৎ অন্যের প্রেমের প্রতি স্বভাবতই তাহার দাবি অত্যন্ত অধিক; এমন-কি, সে প্রেম অপ্রমাণ হইয়া গেলেও ইনিয়া-বিনিয়া কাঁদিয়া রাগিয়া আপনার দাবি সে কিছুতেই ছাড়ে না। আর-একটা কারণ, এই মান-অভিমানে উত্তর-প্রত্যুত্তরের তীব্রতা এবং জয়পরাজয়ের উত্তেজনা রক্ষিত হয়। কবিওয়ালাদের গানে সাহিত্যরসের সৃষ্টি অপেক্ষা ক্ষণিক উত্তেজনা-উদ্রেকই প্রধান লক্ষ্য।
ধর্মভাবের উদ্দীপনাতেও নহে, রাজার সন্তোষের জন্যও নহে, কেবল সাধারণের অবসর-রঞ্জনের জন্য গান-রচনা বর্তমান বাংলায় কবিওয়লারাই প্রথম প্রবর্তন করেন। এখনো সাহিত্যের উপর সেই সাধারণেরই আধিপত্য, কিন্তু ইতিমধ্যে সাধারণের প্রকৃতি-পরিবর্তন হইয়াছে। এবং সেই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য গভীরতা লাভ করিয়াছে। তাহার সম্যক্ আলোচনা করিতে গেলে স্বতন্ত্র প্রবন্ধের অবতারণা করিতে হয়, অতএব এক্ষণে তাহার প্রয়োজন নাই।
কিন্তু সাধারণের যতই রুচির উৎকর্ষ ও শিক্ষার বিস্তার হউক-না কেন, তাহাদের আনন্দবিধানের জন্য স্থায়ী সাহিত্য, এবং আবশ্যকসাধন ও অবসররঞ্জনের জন্য ক্ষণিক সাহিত্যের প্রয়োজন চিরকালই থাকিবে। এখনকার দিনে খবরের কাগজ এবং নাট্য-শালাগুলি শেষোক্ত প্রয়োজন সাধন করিতেছে। কবিদলের গানে যে-প্রকার উচ্চ আদর্শের শৈথিল্য এবং সুলভ অলংকারের বাহুল্য দেখা গিয়াছে, আধুনিক সংবাদপত্রে এবং অভিনয়ার্থে রচিত নাটকগুলিতেও কথঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে তাহাই দেখা যায়। এই-সকল ক্ষণকালজাত ক্ষণস্থায়ী সাহিত্যে ভাষা ও ভাবের ইতরতা, সত্য এবং সাহিত্যনীতির ব্যভিচার, এবং সর্ববিষয়েই রূঢ়তা ও অসংযম দেখিতে পাওয়া যায়। অচিরকালেই সাধারণের এমন উন্নতি হইবে যে, তাহার অবসর-বিনোদনের মধ্যেও ভদ্রোচিত সংযম, গভীরতর সত্য এবং দুরূহতর আদর্শের প্রতিষ্ঠা দেখিতে পাইব। তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।
আমরা সাধারণ এবং সমগ্র ভাবে কবির দলের গানের সমালোচনা করিয়াছি। স্থানে স্থানে সে-সকল গানের মধ্যে সৌন্দর্য এবং ভাবের উচ্চতাও আছে–কিন্তু মোটের উপর এই গানগুলির মধ্যে ক্ষণস্থায়িত্ব, রসের জলীয়তা এবং কাব্যকলার প্রতি অবহেলাই লক্ষিত হয়; এবং সেরূপ হইবার প্রধান কারণ, এই গানগুলি ক্ষণিক উত্তেজনার জন্য উপস্থিতমত রচিত।
তথাপি এই নষ্টপরমায়ু “কবি’র দলের গান আমাদের সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের একটি অঙ্গ, এবং ইংরাজ-রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক।
জ্যৈষ্ঠ ১৩০২
গ্রাম্যসাহিত্য
একদিন শ্রাবণের শেষে নৌকা করিয়া পাবনা রাজসাহির মধ্যে ভ্রমণ করিতে-ছিলাম। মাঠ ঘাট সমস্ত জলে ডুবিয়াছে। ছোটো ছোটো গ্রামগুলি জলচর জীবের ভাসমান কুলায়পুঞ্জের মতো মাঝে মাঝে জাগিয়া আছে। কূলের রেখা দেখা যায় না, শুধু জল ছলছল করিতেছে। ইহার মধ্যে যখন সূর্য অস্ত যাইবে এমন সময়ে দেখা গেল প্রায় দশ-বারো জন লোক একখানি ডিঙি বাহিয়া আসিতেছে। তাহারা সকলে মিলিয়া উচ্চকণ্ঠে এক গান ধরিয়াছে এবং দাঁড়ের পরিবর্তে এক-একখানি বাঁখারি দুই হাতে ধরিয়া গানের তালে তালে ঝোঁকে ঝোঁকে ঝপ্ ঝপ্ শব্দে জল ঠেলিয়া দ্রুতবেগে চলিয়াছে। গানের কথাগুলি শুনিবার জন্য কান পাতিলাম, অবশেষে বারংবার আবৃত্তি শুনিয়া যে ধুয়াটি উদ্ধার করিলাম তাহা এই–
যুবতী, ক্যান্ বা কর মন ভারী।
পাবনা থ্যাহে আন্যে দেব ট্যাহা-দামের মোটরি॥
ভরা বর্ষার জলপ্লাবনের উপর যখন নিঃশব্দে সূর্য অস্ত যাইতেছে এ গানটি ঠিক তখনকার উপযুক্ত কি না সে সম্বন্ধে পাঠকমাত্রেরই সন্দেহ হইতে পারে, কিন্তু গানের এই দুটি চরণে সেই শৈবালবিকীর্ণ জলমরুর মাঝখান হইতে সমস্ত গ্রামগুলি যেন কথা কহিয়া উঠিল। দেখিলাম, এই গোয়ালঘরের পাশে, এই কুলগাছের ছায়ায়, এখানেও যুবতী মন-ভারী করিয়া থাকেন এবং তাঁহার রোষারুণ কুটিল কটাক্ষপাতে গ্রাম্য কবির কবিতা ছন্দে-বন্ধে-সুরে-তালে মাঠে-ঘাটে জলে-স্থলে জাগিয়া উঠিতে থাকে।
জগতে যতপ্রকার দুর্বিপাক আছে যুবতীচিত্তের বিমুখতা তাহার মধ্যে অগ্রগণ্য; সেই দুর-গ্রহ-শান্তির জন্য কবিরা ছন্দোরচনা এবং প্রিয়প্রসাদবঞ্চিত হতভাগ্যগণ প্রাণপাত পর্যন্ত করিতে প্রস্তুত। কিন্তু যখন গানের মধ্যে শুনিলাম “পাবনা থেকে আনি দিব টাকা দামের মোটরি’, তখন ক্ষণকালের জন্য মনের মধ্যে বড়ো একটা আশ্বাস অনুভব করা গেল। মোটরি পদার্থটি কি তাহা ঠিক জানি না, কিন্তু তাহার মূল্য যে এক টাকার বেশি নহে কবি তাহাতে সন্দেহ রাখেন নাই। জগতের এক প্রান্তে পাবনা জিলায় যে এমন একটা স্থান আছে যেখানে প্রতিকূল প্রণয়িনীর জন্য অসাধ্যসাধন করিতে হয় না, পাবনা অপেক্ষা দুর্গম স্থানে যাইতে এবং “মোটরি’ অপেক্ষা দুর্লভ পদার্থ সংগ্রহ করিতে হয় না, ইহা মনে করিলে ভবযন্ত্রণা অপেক্ষাকৃত সুসহ বলিয়া বোধ হয়। কালিদাস ভবভূতি প্রভৃতি প্রথম শ্রেণীর কবিরা এমন স্থলে নিশ্চয়ই মানসসরোবরের স্বর্ণপদ্ম, আকাশের তারা এবং নন্দনকাননের পারিজাত অম্লানমুখে হাঁকিয়া বসিতেন। এবং উজ্জয়িনীর প্রথম শ্রেণীর যুবতীরা শিখরিণী ও মন্দাক্রান্তাচ্ছন্দে এমন দুঃসাধ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তাবমাত্র শুনিলে প্রসন্ন না হইয়া থাকিতে পারিতেন না।
অন্তত কাব্য পড়িয়া এইরূপ ভ্রম হয়। কিন্তু অবিশ্বাসী গদ্যজীবী লোকেরা এতটা কবিত্ব বিশ্বাস করে না। শুদ্ধমাত্র মন্ত্রপাঠের দ্বারা একপাল ভেড়া মারা যায় কি না এ প্রশ্নের উত্তরে ভল্টেয়ার বলিয়াছেন, যায়, কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে আর্সেনিক বিষও থাকা চাই। মন-ভারী-করা যুবতীর পক্ষে আকাশের তারা, নন্দনের পারিজাত এবং প্রাণসমর্পণের প্রস্তাব সন্তোষজনক হইতে পারে; কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই তাহার সঙ্গে সঙ্গে বাজুবন্ধ বা চরণচক্রের প্রয়োজন হয়। কবি ঐ কথাটা চাপিয়া যান; তিনি প্রমাণ করিতে চান যে, কেবল মন্ত্রবলে, কেবল ছন্দ এবং ভাবের জোরেই কাজ সিদ্ধ হয়–অলংকারের প্রয়োজন হইতে পারে, কিন্তু তাহা কাব্যালংকারের। এ দিকে আমাদের পাবনার জনপদবাসিনীরা কাব্যের আড়ম্বর বাহুল্য জ্ঞান করেন এবং তাঁহাদের চিরানুরক্ত গ্রামবাসী কবি মন্ত্রতন্ত্র বাদ দিয়া একেবারেই সোজা টাকা-দামের মোটরির কথাটা পাড়িয়া বসেন, সময় নষ্ট করেন না।
তবু একটা ছন্দ এবং একটা সুর চাই। এই জগৎপ্রান্তে এই পাবনা জিলার বিলের ধারেও তাহার প্রয়োজন আছে। তাহাতে করিয়া ঐ মোটরির দাম এক টাকার চেয়ে অনেকটা বাড়িয়া যায়। ঐ মোটরিটাকে রসের এবং ভাবের পরশ-পাথর ছোঁওয়াইয়া দেওয়া হয়। গানের সেই দুটো লাইনকে প্রচলিত গদ্যে বিনা সুরে বলিলে তাহার মধ্যে যে-একটি রূঢ় দৈন্য আসিয়া পড়ে, ছন্দে সুরে তাহা নিমেষের মধ্যে ঘুচিয়া যায়, সংসারের প্রতিদিনের ধূলিস্পর্শ হইতে ঐ ক’টি তুচ্ছ কথা ভাবের আবরণে আবৃত হইয়া উঠে।
মানুষের পক্ষে ইহার একটা একান্ত প্রয়োজন আছে। যে-সকল সাংসারিক ব্যাপারের দ্বারা সে সর্বদা ঘনিষ্ঠভাবে পরিবৃত তাহাকে সে ছন্দে লয়ে মণ্ডিত করিয়া তাহার উপর নিত্যসৌন্দর্যময় ভাবের রশ্মিপাত করিয়া দেখিতে চায়।
সেইজন্য জনপদে যেমন চাষবাষ এবং খেয়া চলিতেছে, সেখানে কামারের ঘরে লাঙলের ফলা, ছুতারের ঘরে ঢেঁকি এবং স্বর্ণকারের ঘরে টাকা-দামের মোটরি নির্মাণ হইতেছে, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে একটা সাহিত্যের গঠনকার্যও চলিতেছে–তাহার বিশ্রাম নাই। প্রতিদিন যাহা বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন খণ্ডখণ্ড ভাবে সম্পন্ন হইতেছে সাহিত্য তাহাকে ঐক্যসূত্রে গাঁথিয়া নিত্যকালের জন্য প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করিতেছে। গ্রামের মধ্যে প্রতিদিনের বিচিত্র কাজও চলিতেছে এবং তাহার ছিদ্রে ছিদ্রে চির-দিনের একটা রাগিনী বাজিয়া উঠিবার জন্য নিয়ত প্রয়াস পাইতেছে।
পদ্মা বাহিয়া চলিতে চলিতে বালুচরের মধ্যে যখন চকাচকীর কলরব শুনা যায় তখন তাহাকে কোকিলের কুহুতান বলিয়া কাহারো ভ্রম হয় না, তাহাতে পঞ্চম মধ্যম কড়িকোমল কোনোপ্রকার সুর ঠিকমত লাগে না ইহা নিশ্চয়, কিন্তু তবু ইহাকে পদ্মাচরের গান বলিলে কিছুই অসংগত হয় না। কারণ, ইহাতে সুর বেসুর যাহাই লাগুক, সেই নির্মল নদীর হাওয়ায় শীতের রৌদ্রে, অসংখ্য প্রাণীর জীবনসুখ-সম্ভোগের আনন্দধ্বনি বাজিয়া উঠে।
গ্রাম্যসাহিত্যের মধ্যেও কল্পনার তান অধিক থাক্ বা না থাক্ সেই আনন্দের সুর আছে। গ্রামবাসীরা যে জীবন প্রতিদিন ভোগ করিয়া আসিতেছে, যে কবি সেই জীবনকে ছন্দে তালে বাজাইয়া তোলে সে কবি সমস্ত গ্রামের হৃদয়কে ভাষা দান করে। পদ্মাচরের চক্রবাক সংগীতের মতো, তাহা নিখুঁত সুরতালের অপেক্ষা রাখে না। মেঘ-দূতের কবি অলকা পর্যন্ত গিয়াছেন, তিনি উজ্জয়িনীর রাজসভার কবি; আমাদের অখ্যাত গানের কবি কঠিন দায়ে পড়িয়াও পাবনা শহরের বেশি অগ্রসর হইতে পারে নাই–যদি পারিত, তবে তাহার গ্রামের লোক তাহার সঙ্গ ত্যাগ করিত। কল্পনার সংকীর্ণতা-দ্বারাই সে আপন প্রতিবেশীবর্গকে ঘনিষ্ঠসূত্রে বাঁধিতে পারিয়াছে, এবং সেই কারণেই তাহার গানের মধ্যে কল্পনাপ্রিয় একক কবির নহে, পরন্তু সমস্ত জনপদের হৃদয় কলরবে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে।
সেইজন্য বাংলা জনপদের মধ্যে ছড়া গান কথা আকারে যে সাহিত্য গ্রামবাসীর মনকে সকল সময়েই দোল দিতেছে তাহাকে কাব্যহিসাবে গ্রহণ করিতে গেলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে সমস্ত গ্রাম সমস্ত লোকালয়কে জড়াইয়া লইয়া পাঠ করিতে হয়; তাহারাই ইহার ভাঙা ছন্দ এবং অপূর্ণ মিলকে অর্থে ও প্রাণে ভরাট করিয়া তোলে। গ্রাম্যসাহিত্য বাংলার গ্রামের ছবির, গ্রামের স্মৃতির অপেক্ষা রাখে; সেইজন্যই বাঙালির কাছে ইহার একটি বিশেষ রস আছে। বৈষ্ণবী যখন “জয় রাধে’ বলিয়া ভিক্ষা করিতে অন্তঃপুরের আঙিনায় আসিয়া দাঁড়ায় তখন কুতূহলী গৃহকর্ত্রী এবং অবগুণ্ঠিত বধূগণ তাহা শুনিবার জন্য উৎসুক হইয়া আসেন। প্রবীণা পিতামহী, গল্পে গানে ছড়ায় যিনি আকণ্ঠ পরিপূর্ণ, কত শুক্লপক্ষের জ্যেৎস্নায় ও কৃষ্ণপক্ষের তারার আলোকে তাঁহাকে উত্ত্যক্ত করিয়া তুলিয়া গৃহের বালকবালিকা যুবকযুবতী একাগ্রমনে বহুশত বৎসর ধরিয়া যাহা শুনিয়া আসিতেছে বাঙালি পাঠকের নিকট তাহার রস গভীর এবং অক্ষয়।
গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন-অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের জনসাধারণেরই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য, সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না। সাহিত্যের যে অংশ সার্বভৌমিক তাহা এই প্রাদেশিক নিম্নস্তরের থাক্’টার উপরে দাঁড়াইয়া আছে। এইরূপ নিম্নসাহিত্য এবং উচ্চ-সাহিত্যের মধ্যে বরাবর ভিতরকার একটি যোগ আছে। যে অংশ আকাশের দিকে আছে তাহার ফুলফল-ডালপালার সঙ্গে মাটির নিচেকার শিকড়গুলার তুলনা হয় না–তবু তত্ত্ববিদ্দের কাছে তাহাদের সাদৃশ্য ও সম্বন্ধ কিছুতেই ঘুচিবার নহে।
নীচের সহিত উপরের এই-যে যোগ, প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য আলোচনা করিলে ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। অন্নদামঙ্গল ও কবিকঙ্কণের কবি যদিচ রাজসভা-ধনীসভার কবি, যদিচ তাঁহারা উভয়ে পণ্ডিত, সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিশারদ, তথাপি দেশীয় প্রচলিত সাহিত্যকে বেশি দূর ছাড়াইয়া যাইতে পারেন নাই। অন্নদামঙ্গল ও কুমারসম্ভবের আখ্যানে প্রভেদ অল্প, কিন্তু অন্নদামঙ্গল কুমারসম্ভবের ছাঁচে গড়া হয় নাই। তাহার দেবদেবী বাংলাদেশের গ্রাম্য হরগৌরী। কবিকঙ্কন চণ্ডী, ধর্মমঙ্গল, মনসার ভাসান, সত্যপীরের কথা, সমস্তই গ্রাম্যকাহিনী অবলম্বনে রচিত। সেই গ্রাম্য ছড়াগুলির পরিচয় পাইলে তবেই ভারতচন্দ্র-মুকুন্দরাম-রচিত কাব্যের যথার্থ পরিচয় পাইবার পথ হয়। রাজসভার কাব্যে ছন্দ মিল ও কাব্যকলা সুসম্পূর্ণ সন্দেহ নাই, কিন্তু গ্রাম্য ছড়াগুলির সহিত তাহার মর্মগত প্রভেদ ছিল না।
আমার হাতে যে ছড়াগুলি সঞ্চিত হইয়াছে তাহা অপেক্ষাকৃত পুরাতন কি নূতন নিঃসন্দেহ বলিতে পারি না। কিন্তু দু-এক শত বৎসরে এ-সকল কবিতার বয়সের কমিবেশি হয় না। আজ পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে পল্লীর কবি যে ছড়া রচনা করিয়াছে তাহাকে এক হিসাবে মুকুন্দরামের সমসাময়িক বলা যায়; কারণ, গ্রামের প্রাণটি যেখানে ঢাকা থাকে কালস্রোতের ঢেউগুলি সেখানে তেমন জোরের সঙ্গে ঘা দিতে পারে না। গ্রামের জীবনযাত্রা এবং সেই জীবনযাত্রার সঙ্গী সাহিত্য বহুকাল বিনা পরিবর্তনে একই ধারায় চলিয়া আসে।
কেবল সম্প্রতি অতি অল্পদিন হইল আধুনিক কাল, দূরদেশাগত নবীন জামাতার মতো নূতন চাল-চলন লইয়া পল্লীর অন্তঃপুরেও প্রবেশ করিয়াছে। গ্রামের মধ্যেও পরিবর্তনের হাত পড়িয়াছে। এজন্য গ্রাম্য ছড়া-সংগ্রহের ভার যাঁহারা লইয়াছেন তাঁহারা আমাকে লিখিতেছেন–
“প্রাচীনা ভিন্ন আজকালকার মেয়েদের কাছে এইরূপ কবিতা শুনিবার প্রত্যাশা নাই। তাহারা ইহা জানে না এবং জানিবার কৌতূহলও রাখে না। বর্ষীয়সী স্ত্রী-লোকের সংখ্যা খুব কম। তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে উহা জানেন না। দুই-একজন জানিলেও সকলে জানেন না। সুতরাং পাঁচটি ছড়া সংগ্রহ করিতে হইলে পাঁচ গ্রামের পাঁচজন বৃদ্ধার আশ্রয় লইতে হয়। এ দেশের পুরাতন বৈষ্ণবীগণের দুই-একজন মাঝে মাঝে এইরূপ কবিতা বলিয়া ভিক্ষা করে দেখিতে পাই। তাহাদের কথিত ছড়া-গুলি সমস্তই রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিষয়ক। এইরূপ বৈষ্ণবী সচরাচর মেলে না এবং মিলিলেও অনেকেই একবিধ ছড়াই গাহিয়া থাকে। এমতস্থলে একাধিক নূতন ছড়া সংগ্রহ করিতে হইলে অপেক্ষাকৃত বহু বৈষ্ণবীর সাহায্য আবশ্যক। তবে শস্যশ্যামলা মাতৃভূমির কৃপায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই-একটি বিদেশিনী নূতন বৈষ্ণবীর “জয় রাধে’ রব শুনিতে পাওয়া বড়ো কিছু আশ্চর্যের বিষয় নহে।’
পূর্বে গ্রাম্য ছড়াগুলি গ্রামের সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়েদেরও সাহিত্যরসতৃষ্ণা মিটাইবার জন্য ভিখারিনি ও পিতামহীদের মুখে মুখে ঘরে ঘরে প্রচারিত হইত। এখন তাঁহারা অনেকেই পড়িতে শিখিয়াছেন; বাংলায় ছাপাখানার সাহিত্য তাঁহাদের হাতে পড়িয়াছে। এখন গ্রাম্য ছড়াগুলি বোধ করি সমাজের অনেক নীচের স্তরে নামিয়া গেছে।
ছড়াগুলির বিষয়কে মোটামুটি দুই ভাগ করা যায়। হরগৌরী-বিষয়ক এবং কৃষ্ণ-রাধা-বিষয়ক। হরগৌরী-বিষয়ে বাঙালির ঘরের কথা এবং কৃষ্ণরাধা-বিষয়ে বাঙালির ভাবের কথা ব্যক্ত করিতেছে। এক দিকে সামাজিক দাম্পত্যবন্ধন, আর-এক দিকে সমাজবন্ধনের অতীত প্রেম।
দাম্পত্য-সম্বন্ধের মধ্যে একটা বিঘ্ন বিরাজ করিতেছে, দারিদ্র্য। সেই দারিদ্র্য-শৈলটাকে বেষ্টন করিয়া হরগৌরীর কাহিনী নানা দিক হইতে তরঙ্গিত হইয়া উঠিতেছে। কখনো বা শ্বশুর-শাশুড়ির স্নেহ সেই দারিদ্র্যকে আঘাত করিতেছে, কখনো বা স্ত্রী-পুরুষের প্রেম সেই দারিদ্র্যের উপরে আসিয়া প্রতিহত হইতেছে।
বাংলার কবিহৃদয় এই দারিদ্র্যকে মহত্ত্বে এবং দেবত্বে মহোচ্চ করিয়া তুলিয়াছে। বৈরাগ্য এবং আত্মবিস্মৃতির দ্বারা দারিদ্র্যের হীনতা ঘুচাইয়া কবি তাহাকে ঐশ্বর্যের অপেক্ষা অনেক বড়ো করিয়া দেখাইয়াছেন। ভোলানাথ দারিদ্র্যকে অঙ্গের ভূষণ করিয়াছিলেন–দরিদ্রসমাজের পক্ষে এমন আনন্দময় আদর্শ আর কিছুই নাই। “আমার সম্বল নাই’ যে বলে সেই গরিব। “আমার আবশ্যক নাই’ যে বলিতে পারে তাহার অভাব কিসের? শিব তো তাহারই আদর্শ।
অন্য দেশের ন্যায় ধনের সম্ভ্রম ভারতবর্ষে নাই, অন্তত পূর্বে ছিল না। যে বংশে বা গৃহে কুলশীলসম্মান আছে সে বংশে বা গৃহে ধন নাই এমন সম্ভাবনা আমাদের দেশে বিরল নহে। এইজন্য আমাদের দেশে ধনী ও নির্ধনের মধ্যে বিবাহের আদান-প্রদান সর্বদাই চলিয়া থাকে।
কিন্তু সামাজিক আদর্শ যেমনই হউক ধনের একটা স্বাভাবিক মত্ততা আছে। ধন-গৌরবে দরিদ্রের প্রতি ধনী কৃপাকটাক্ষপাত করিয়া থাকে। যেখানে সামাজিক উচ্চ-নীচতা নাই সেখানে ধনের উচ্চনীচতা আসিয়া একটা বিপ্লব বাধাইয়া দেয়। এইরূপ অবস্থা দাম্পত্য-সম্বন্ধে একটা মস্ত বিপাকের কারণ। স্বভাবতই ধনী শ্বশুর যখন দরিদ্র জামাতাকে অবজ্ঞা করে এবং ধনীকন্যা দরিদ্রপতি ও নিজের দুরদৃষ্টের প্রতি বিরক্ত হইয়া উঠে, তখন গৃহধর্ম কম্পান্বিত হইতে থাকে।
দাম্পত্যের এই দুর্গ্রহ কেমন করিয়া কাটিয়া যায় হরগৌরীর কাহিনীতে তাহা কীর্তিত হইয়াছে। সতী স্ত্রীর অটল শ্রদ্ধা তাহার একটা উপাদান; তাহার আর-একটা উপদান দারিদ্র্যের হীনতামোচন, মহত্ত্বকীর্তন। উমাপতি দরিদ্র হইলেও হেয় নহেন, এবং শ্মশানচারীর স্ত্রী পতিগৌরবে ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
দাম্পত্যবন্ধনের আর-একটি মহৎ বিঘ্ন স্বামীর বার্ধক্য ও কুরূপতা। হরগৌরীর সম্বন্ধে তাহাও পরাভূত হইয়াছে। বিবাহসভায় বৃদ্ধ জামাতাকে দেখিয়া মেনকা যখন আক্ষেপ করিতেছেন তখন অলৌকিক প্রভাবে বৃদ্ধের রূপযৌবন বসনভূষণ প্রকাশিত হইয়া পড়িল। এই অলৌকিক রূপযৌবন প্রত্যেক বৃদ্ধ স্বামীরই আছে, তাহা তাহার স্ত্রীর আন্তরিক ভক্তি-প্রীতির উপর নির্ভর করে। গ্রামের ভিক্ষুক কথক গায়ক হরগৌরীর কথায় বারে বারে দ্বারে দ্বারে সেই ভক্তি উদ্রেক করিয়া বেড়ায়।
গ্রামের কবিপ্রতিভা এইখানেই ক্ষান্ত হয় নাই। শিবকে গাঁজা ভাঙ প্রভৃতি নেশায় উন্মত্ত করিয়াছে। শুদ্ধ তাহাই নহে–অসভ্য কোঁচ-কামিনীদের প্রতি তাঁহার আসক্তি প্রচার করিতে ছাড়ে নাই। কালিদাসের অনুত্তরঙ্গ সমুদ্র ও নিবাতনিষ্কম্প দীপশিখা-বৎ যোগীশ্বর বাংলার পল্লীতে আসিয়া এমনি দুর্গতিপ্রাপ্ত হইয়াছেন।
কিন্তু স্থূল কথা এই যে, হরগৌরীর কথা–ছোটোবড়ো সমস্ত বিঘ্নের উপরে দাম্পত্যের বিজয়কাহিনী। হরগৌরীপ্রসঙ্গে আমাদের একান্নপারিবারিক সমাজের মর্মরূপিণী রমণীর এক সজীব আদর্শ গঠিত হইয়াছে। স্বামী দীন দরিদ্র বৃদ্ধ বিরূপ যেমনই হউক, স্ত্রী রূপযৌবন-ভক্তিপ্রীতি-ক্ষমাধৈর্য-তেজগর্বে সমুজ্জ্বলা। স্ত্রীই দরিদ্রের ধন, ভিখারির অন্নপূর্ণা, রিক্ত গৃহের সম্মানলক্ষ্মী।
হরগৌরীর গান যেমন সমাজের গান, রাধাকৃষ্ণের গান তেমনি সৌন্দর্যের গান। ইহার মধ্যে যে অধ্যাত্মতত্ত্ব আছে তাহা আমরা ছাড়িয়া দিতেছি। কারণ, তত্ত্ব যখন রূপকের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করে তখন তো সে আপন তত্ত্বরূপ গোপন করে। বাহ্যরূপেই সে সাধারণের হৃদয় আকর্ষণ করিয়া থাকে। রাধাকৃষ্ণের রূপকের মধ্যে এমন একটি পদার্থ আছে যাহা বাংলার বৈষ্ণব অবৈষ্ণব তত্ত্বজ্ঞানী ও মূঢ় সকলেরই পক্ষে উপাদেয়, এইজন্যই তাহা ছড়ায় গানে যাত্রায় কথকতায় পরিব্যাপ্ত হইতে পারিয়াছে।
সৌন্দর্যসূত্রে নরনারীর প্রেমের আকর্ষণ সকল দেশের সাহিত্যেই প্রচারিত। কেবল সামাজিক কর্তব্যবন্ধনে ইহাকে সম্পূর্ণে কুলাইয়া পায় না। সমাজের বাহিরেও ইহার শাসন বিস্তৃত। পঞ্চশরের গতিবিধি সর্বত্রই, এবং বসন্ত অর্থাৎ জগতের যৌবন এবং সৌন্দর্য তাঁহার নিত্য সহচর।
নরনারীর প্রেমের এই-যে একটি মোহিনী শক্তি আছে, যে শক্তিবলে সে মুহূর্তের মধ্যে জগতের সমস্ত চন্দ্রসূর্যতারা পুষ্পকানন নদনদীকে এক সূত্রে টানিয়া মধুরভাবে উজ্জ্বলভাবে আপনার চতুর্দিকে সাজাইয়া আনে, যে প্রেমের শক্তি আকস্মিক অনির্বচনীয় আবির্ভাবের দ্বারা এতদিনকার বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত উপেক্ষিত বিশ্বজগৎকে চক্ষের পলকে সম্পূর্ণ কৃতকৃতার্থ করিয়া তোলে–সেই শক্তিকে যুগে যুগে দেশে দেশে মনুষ্য অধ্যাত্ম-শক্তির রূপক বলিয়া অনুভব ও বর্ণনা করিয়াছেন। তাহার প্রমাণ সলোমন হাফেজ এবং বৈষ্ণব কবিদের পদাবলী। দুইটি মনুষ্যের প্রেমের মধ্যে এমন একটি বিরাট বিশ্বব্যাপকতা আছে যে আধ্যাত্মিক ভাবুকদের মনে হয়, সেই প্রেমের সম্পূর্ণ অর্থ সেই দুইটি মনুষ্যের মধ্যেই পর্যাপ্ত নহে; তাহা ইঙ্গিতে জগৎ ও জগদীশ্বরের মধ্যবর্তী অনন্ত-কালের সম্বন্ধ ও অপরিসীম ব্যাকুলতা জ্ঞাপন করিতেছে।
কাব্যের পক্ষে এমন সামগ্রী আর দ্বিতীয় নাই। ইহা একই কালে সুন্দর এবং বিরাট, অন্তরতম এবং বিশ্বগ্রাসী, লৌকিক এবং অনির্বচনীয়। যদিও স্ত্রীপুরুষের প্রকাশ্য মেলামেশা ও স্বাধীন বরণের অভাবে ভারতবর্ষীয় সমাজে এই প্রেম লাঞ্ছিত হইয়া গুপ্তভাবে বিরাজ করে, তথাপি ভারতবর্ষের কবিরা নানা ছলে, নানা কৌশলে, ইহাকে তাঁহাদের কাব্যে আবাহন করিয়া আনিয়াছেন। তাঁহারা প্রকাশ্যভাবে সমাজের অবমাননা না করিয়া কাব্যকে সমাজের বাহিরে স্থাপন করিয়াছন। মালিনী-নদীতীরে তপোবনে সহকারসনাথ-বনজ্যোৎস্না-কুঞ্জে নবযৌবনা শকুন্তলা সমাজ-কারাবাসী কবিহৃদয়ের কল্পনাস্বপ্ন। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রেম সমাজের অতীত, এমন-কি, তাহা সমাজবিরোধী। পুরূরবার প্রেমোন্মত্ততা সমাজবন্ধন ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া নদীগিরিবনের মধ্যে মদমত্ত বন্য হস্তীর মতো উদ্দামভাবে পরিভ্রমণ করিয়াছে। মেঘদূত বিরহের কাব্য। বিরহাবস্থায় দৃঢ়বদ্ধ দাম্পত্যসূত্রে কিঞ্চিৎ ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়া মানব যেন পুনশ্চ স্বতন্ত্রভাবে ভালোবাসিবার অবসর লাভ করে। স্ত্রীপুরুষের মধ্যে সেই ব্যবধান যেখানে পড়ে হৃদয়ের প্রবল অভিমুখী গতি আপনাকে স্বাধীনভাবে প্রবাহিত করিতে স্থান পায়। কুমারসম্ভবে কুমারী গৌরী যদি প্রচলিত সমাজনিয়মের বিরুদ্ধে শৈলতপোবনে একাকিনী মহাদেবের সেবা না করিতেন, তবে তৃতীয় সর্গের ন্যায় অমন অতুলনীয় কাব্যের সৃষ্টি হইত কী করিয়া? এক দিকে বসন্তপুষ্পাভরণা শিরীষপেলবা বেপথুমতী উমা, অন্য দিকে যোগাসীন মহাদেবের অগাধস্তম্ভিত সমুদ্রবিশাল হৃদয়, লোকালয়ের নিয়মপ্রাচীরের মধ্যে বিশ্ববিজয়ী প্রেমের এমন মহান সুযোগ মিলিত কোথায়?
যাহা হউক, মানবরচিত সমাজ আপনার মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত নয়। যে শক্তি সমাজকে সমাজের বাহিরের দিকে টানে সেই সৌন্দর্য সেই প্রেমের শক্তিকে অন্তত মানসলোকে স্থাপন করিয়া কল্পনার দ্বারা উপভোগ না করিয়া মানুষ থাকিতে পারে না। পার্থিব সমাজে যদি বা বাধা পায় তবে দ্বিগুণ তীব্রতার সহিত আধ্যাত্মিক ভাবের মধ্যে তাহাকে আয়ত্ত করিতে চেষ্টা করে। বৈষ্ণবের গান যে দেখিতে দেখিতে সমস্ত ভারতবর্ষ ছাইয়া ফেলিয়াছে ইহাই তাহার প্রধান কারণ। বৈষ্ণবের গান স্বাধীনতার গান। তাহা জাতি মানে না, কুল মানে না। অথচ এই উচ্ছৃঙ্খলতা সৌন্দর্যবন্ধনে হৃদয়বন্ধনে নিয়মিত। তাহা অন্ধ ইন্দ্রিয়ের উদ্ভ্রান্ত উন্মত্ততামাত্র নহে।
হরগৌরীকথায় দাম্পত্যবন্ধনে যেমন কতকগুলি বাধা বর্ণিত হইয়াছে, বৈষ্ণব গাথার প্রেমপ্রবাহেও তেমনি একমাত্র প্রবল বাধার উল্লেখ আছে–তাহা সমাজ। তাহা একাই এক সহস্র। বৈষ্ণব পদাবলীতে সেই সমাজবাধার চতুর্দিকে প্রেমের তরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে। এমন-কি, বৈষ্ণব কাব্যশাস্ত্রে পরকীয়া অনুরক্তির বিশেষ গৌরব বর্ণিত হইয়াছে। সে গৌরব সমাজনীতির হিসাবে নহে সে কথা বলাই বাহুল্য। তাহা নিছক প্রেমের হিসাবে। ইহাতে যে আত্মবিস্মৃতি, বিশ্ববিস্মৃতি, নিন্দা-ভয়-লজ্জা-শাসন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ঔদাসীন্য, কঠিন কুলাচার-লোকাচারের প্রতি অচেতনতা প্রকাশ পায়, তদ্দ্বারা প্রেমের প্রচণ্ড বল, দুর্বোধ রহস্য, তাহার বন্ধন-বিহীনতা, সমাজ-সংসার স্থান-কাল-পাত্র এবং যুক্তিতর্ক-কার্যকারণের অতীত একটা বিরাট ভাব পরিস্ফুট হইয়া উঠে। এই কারণে যাহা বিশ্বসমাজে সর্বত্রই একবাক্যে নিন্দিত সেই অভ্রভেদী কলঙ্কচূড়ার উপরে বৈষ্ণব কবিগণ তাঁহাদের বর্ণিত প্রেমকে স্থাপন করিয়া তাহার অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন করিয়াছেন। এই সর্বনাশী, সর্বত্যাগী, সর্ববন্ধনচ্ছেদী প্রেমকে আধ্যাত্মিক অর্থে গ্রহণ করিতে না পারিলে কাব্য হিসাবে ক্ষতি হয় না, সমাজনীতি হিসাবে হইবার কথা।
এইরূপ প্রেমগানের প্রচার সাধারণ লোকের পক্ষে বিপজ্জনক এবং সমাজের পক্ষে অহিতকর মনে হইতে পারে। কিন্তু ফলত তাহা সম্পূর্ণ সত্য নহে। মানবপ্রকৃতিকে সমাজ একেবারে উন্মূলিত করিতে পারে না। তাহা কাজে কথায় কল্পনায় আপনাকে নানাপ্রকারে ব্যক্ত করিয়া তোলে। তাহা এক দিক হইতে প্রতিহত হইয়া আর-এক দিক দিয়া প্রবাহিত হয়। মানবপ্রকৃতিকে অযথাপরিমাণে এবং সম্পূর্ণভাবে রোধ করাতেই সমাজের বিপদ। সে অবস্থায় যখন সেই রুদ্ধ প্রকৃতি কোনো-একটা আকারে বাহির হইবার পথ পায় তখনই বরঞ্চ বিপদের কতকটা লাঘব হয়। আমাদের দেশে যখন বন্ধবিহীন প্রেমের সমাজবিহিত প্রকাশ্য স্থান কোথাও নাই,সদর দরজা যখন তাহার পক্ষে একেবারেই বন্ধ, অথচ তাহাকে শাস্ত্র চাপা দিয়া গোর দিলেও সে যখন ভূত হইয়া মধ্যাহ্নরাত্রে রুদ্ধ দ্বারের ছিদ্রমধ্য দিয়া দ্বিগুণতর বলে লোকালয়ে পর্যটন করিয়া বেড়ায়, তখন বিশেষরূপে আমাদের সমাজেই সেই কুলমানগ্রাসী কলঙ্ক-অঙ্কিত প্রেম স্বাভাবিক নিয়মে গুপ্তভাবে স্থান পাইতে বাধ্য–বৈষ্ণব কবিরা সেই বন্ধননাশী প্রেমের গভীর দুর্নিবার আবেগকে সৌন্দর্যক্ষেত্রে অধ্যাত্মলোকে বহমান করিয়া তাহাকে অনেক পরিমাণে সংসারপথ হইতে মানসপথে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছেন, আমাদের সমাজের সেই চিরক্ষুধাতুর প্রেতটাকে পবিত্র গয়ায় পিণ্ডদান করিবার আয়োজন করিয়াছেন। তাঁহারা কামকে প্রেমে পরিণত করিবার জন্য ছন্দোবন্ধ কল্পনার বিবিধ পরশপাথর প্রয়োগ করিয়াছেন। তাঁহাদের রচনার মধ্যে যে ইন্দ্রিয়বিকার কোথায় স্থান পায় নাই তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু বৃহৎ স্রোতস্বিনী নদীতে যেমন অসংখ্য দূষিত ও মৃত পদার্থ প্রতিনিয়ত আপনাকে আপনি সংশোধন করে তেমনি সৌন্দর্য এবং ভাবের বেগে সেই-সমস্ত বিকার সহজেই শোধিত হইয়া চলিয়াছে। বরঞ্চ বিদ্যাসুন্দরের কবি সমাজের বিরুদ্ধে যথার্থ অপরাধী। সমাজের প্রাসাদের নীচে তিনি হাসিয়া হাসিয়া সুরঙ্গ খনন করিয়াছেন। সে সুরঙ্গমধ্যে পূত সূর্যালোক এবং উন্মুক্ত বায়ু প্রবেশপথ নাই। তথাপি এই বিদ্যাসুন্দর কাব্যের এবং বিদ্যাসুন্দর যাত্রার এত আদর আমাদের দেশে কেন? উহা অত্যাচারী কঠিন সমাজের প্রতি মানবপ্রকৃতির সুনিপুণ পরিহাস। বৈষ্ণব কবি যে জিনিসটাকে ভাবের ছায়াপথে সুন্দররূপে অঙ্কিত করিয়াছেন, ইনি সেইটাকে সমাজের পিঠের উপর দাগার মতো ছাপিয়া দিয়াছেন, যে দেখিতেছে সে’ই কৌতুক অনুভব করিতেছে।
যাহা হউক, মোটের উপর, হরগৌরী এবং কৃষ্ণরাধাকে লইয়া আমাদের গ্রাম্য সাহিত্য রচিত। তাহার মধ্যে হরগৌরীর কথা আমাদের ঘরের কথা। সেই হরগৌরীর কথায় আমাদের বাংলাদেশের একটা বড়ো মর্মের কথা আছে। কন্যা আমাদের গৃহের এক মস্ত ভার। কন্যাদায়ের মতো দায় নাই। কন্যাপিতৃত্বং খলু নাম কষ্টম্। সমাজের অনুশাসনে নির্দিষ্ট বয়স এবং সংকীর্ণ মণ্ডলীর মধ্যে কন্যার বিবাহ দিতে আমরা বাধ্য। সুতরাং সেই কৃত্রিম তাড়না-বশতই বরের দর অত্যন্ত বাড়িয়া যায়, তাহার রূপ গুণ অর্থ সামর্থ্যে আর তত প্রয়োজন থাকে না। কন্যাকে অযোগ্য পাত্রে সমর্পণ করা, ইহা আমাদের সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ঘটনা। ইহা লইয়া দুশ্চিন্তা, অনুতাপ, অশ্রুপাত, জামাতৃপরিবারের সহিত বিরোধ, পিতৃকুল ও পতিকুলের মধ্যবর্তিনী বালিকার নিষ্ঠুর মর্মবেদনা, সর্বদাই ঘরে ঘরে উদ্ভুত হইয়া থাকে। একান্নপরিবারে আমরা দূর ও নিকট, এমন-কি, নামমাত্র আত্মীয়কেও বাঁধিয়া রাখিতে চাই–কেবল কন্যাকেই ফেলিয়া দিতে-হয়। যে সমাজে স্বামী-স্ত্রী-ব্যতীত পুত্রকন্যা প্রভৃতি সকলেই বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, তাহারা আমাদের এই দুঃসহ বেদনা কল্পনা করিতে পারিবে না। আমাদের মিলনধর্মী পরিবারে এই একমাত্র বিচ্ছেদ। সুতরাং ঘুরিয়া ফিরিয়া সর্বদাই সেই ক্ষতবেদনায় হাত পড়ে। হরগৌরীর কথা বাংলার একান্নপরিবারে সেই প্রধান বেদনার কথা। শরৎ-সপ্তমীর দিনে সমস্ত বঙ্গভূমির ভিখারি-বধূ কন্যা মাতৃগৃহে আগমন করে, এবং বিজয়ার দিনে সেই ভিখারি-ঘরের অন্নপূর্ণা যখন স্বামীগৃহে ফিরিয়া যায় তখন সমস্ত বাংলাদেশের চোখে জল ভরিয়া আসে।
এই-সকল কারণে হরগৌরীর সম্বন্ধীয় গ্রাম্যছড়াগুলি বাস্তব ভাবের। তাহা রচয়িতা ও শ্রোতৃবর্গের একান্ত নিজের কথা। সেই-সকল কাব্যে জামাতার নিন্দা, স্ত্রীপুরুষের কলহ ও গৃহস্থালীর বর্ণনা যাহা আছে তাহাতে রাজভাব বা দেবভাব কিছুই নাই; তাহাতে বাংলাদেশের গ্রাম্য কুটিরের প্রাত্যহিক দৈন্য ও ক্ষুদ্রতা সমস্তই প্রতিবিম্বিত। তাহাতে কৈলাস ও হিমালয় আমাদের পানা-পুকুরের ঘাটের সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, এবং তাহাদের শিখররাজি আমাদের আম-বাগানের মাথা ছাড়াইয়া উঠিতে পারে নাই। যদি তাঁহারা নিজ নিজ অভ্রভেদী মূর্তি ধারণ করিবার চেষ্টামাত্র করিতেন তাহা হইলে বাংলার গ্রামের মধ্যে তাঁহাদের স্থান হইত না।
শরৎকালে রানী বলে বিনয়বচন
আর শুনেছ, গিরিরাজ, নিশার স্বপন?
এই স্বপ্ন হইতে কথা-আরম্ভ। সমস্ত আগমনী গানের এই ভূমিকা। প্রতিবৎসর শরৎকালে ভোরের বাতাস যখন শিশিরসিক্ত এবং রৌদ্রের রঙ কাঁচা সোনার মতো হইয়া আসে, তখন গিরিরানী সহসা একদিন তাঁহার শ্মশানবাসিনী সোনার গৌরীকে স্বপ্ন দেখেন, আর বলেন : আর শুনেছ গিরিরাজ নিশার স্বপন? এ স্বপ্ন গিরিরাজ আমাদের পিতামহ এবং প্রপিতামহদের সময় হইতে ললিত বিভাস এবং রামকেলি রাগিনীতে শুনিয়া আসিতেছেন, কিন্তু প্রত্যেক বৎসরই তিনি নূতন করিয়া শোনেন। ইতিবৃত্তের কোন্ বৎসরে জানি না, হরগৌরীর বিবাহের পরে প্রথম যে শরতে মেনকারানী স্বপ্ন দেখিয়া প্রত্যুষে জাগিয়া উঠিয়াছিলেন সেই প্রথম শরৎ সেই তাহার প্রথম স্বপ্ন লইয়াই বর্ষে বর্ষে ফিরিয়া আসে। জলে স্থলে আকাশে একটি বৃহৎ বেদনা বাজিয় উঠে, যাহাকে পরের হাতে দিয়াছি আমার সেই আপনার ধন কোথায়!
বৎসর গত হয়েছে কত, করছে শিবের ঘর।
যাও গিরিরাজ আনতে গৌরী কৈলাসশিখর॥
বলা বাহুল্য, গিরিরাজ নিতান্ত লঘু লোকটা নহেন। চলিতে ফিরিতে, এমন-কি, শোক-দুঃখ-চিন্তা অনুভব করিতে, তাঁহার স্বভাবতই কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটিয়া থাকে। তাঁহার সেই সর্বাঙ্গীণ জড়তা ও ঔদাসীন্যের জন্য একবার গৃহিণীর নিকট গোটাকয়েক তীব্র তিরস্কার-বাক্য শুনিয়া তবে তিনি অঙ্কুশাহত হস্তীর ন্যায় গাত্রোত্থান করিলেন।
শুনে কথা গিরিরাজা লজ্জায় কাতর
পঞ্চমীতে যাত্রা করে শাস্ত্রের বিচার॥
তা শুনি মেনকারানী শীঘ্রগতি ধরি
খাজা মণ্ডা মনোহরা দিলেন ভাণ্ড ভরি॥
মিশ্রিসাঁচ চিনির ফেনি ক্ষীর তক্তি সরে
চিনির ফেনা এলাচদানা মুক্তা থরে থরে॥
ভাঙের লাড়ু সিদ্ধি ব’লে পঞ্চমুখে দিলেন
ভাণ্ড ভরি গিরিরাজ তখনি সে নিলেন॥
কিন্তু দৌত্যকার্যে যেরূপ নিপুণতা থাকা আবশ্যক হিমালয়ের নিকট তাহা প্রত্যাশা করা যায় না। কৈলাসে কন্যার সহিত অনর্থক বচসা করিয়া তাঁহার বিপুল স্থূল প্রকৃতির পরিচয় দিলেন। দোষের মধ্যে অভিমানিনী তাঁকে বলিয়াছিলেন–
কহ বাবা নিশ্চয়, আর কব পাছে–
সত্য করি বলো আমার মা কেমন আছে।
তুমি নিঠুর হয়ে কুঠুর মনে পাসরিলা ঝি।
শিবনিন্দা করছ কত তার বলব কী॥
সত্য দোষারোপে ভালোমত উত্তর জোগায় না বলিয়া রাগ বেশি হয়। গিরিরাজ সুযোগ পাইলে শিবনিন্দা করিতে ছাড়েন না; এ কথার প্রতিবাদ করিতে না পারিয়া রুষ্ট হইয়া বলিয়া উঠিলেন–
মা, তুমি বল নিঠুর কুঠুর, শম্ভু বলেন শিলা।
ছার মেনকার বুদ্ধি শুনে তোমায় নিতে এলাম॥
তখন শুনে কথা জগৎমাতা কাঁদিয়া অস্থির।
পাঢ়া মেঘের বৃষ্টি যেন প’ল এক রীত॥
নয়নজলে ভেসে চলে, আকুল হল নন্দী–
কৈলাসেতে মিলল ঝরা, হল একটি নদী॥
কেঁদো না মা, কেঁদো না মা ত্রিপুরসুন্দরী।
কাল তোমাকে নিয়ে যাব পাষাণের পুরী॥
সন্দেশ দিয়েছিলেন মেনকারানী, দিলেন দুর্গার হাতে।
তুষ্ট হয়ে নারায়ণী ক্ষান্ত পেলেন তাতে॥
উমা কন শুন বাবা, বোসো পুনর্বার।
জলপান করিতে দিলেন নানা উপহার॥
যত্ন করি মহেশ্বরী রানুন করিলা।
শ্বশুর জামাতা দোঁহে ভোজন করিলা॥
ছড়া যাহাদের জন্য রচিত তাহারা যদি আজ পর্যন্ত ইহার ছন্দোবন্ধ ও মিলের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি না করিয়া থাকে, তবে আমাদের বলিবার কোনো কথাই নাই; কিন্তু জামাতৃগৃহে সমাগত পিতার সহিত কন্যার মান-অভিমান ও তাহার শান্তি ও পরে আহার-অভ্যর্থনা–এই গৃহচিত্র যেন প্রত্যক্ষের মতো দেখা যাইতেছে। নন্দীটা এক পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, সে মাঝে হইতে আকুল হইয়া গেল। শ্বশুরজামাতা ভোজনে বসিয়াছেন এবং গৌরী স্বহস্তে রন্ধন করিয়া উভয়কে পরিবেশন করিতেছেন, এ চিত্র মনে গাঁথা হইয়া রহিল।
শয়নকালে দুর্গা বলে আজ্ঞা দেহ স্বামী।
ইচ্ছা হয় যে বাপের বাড়ি কাল যাইব আমি॥
শুন গৌরী কৈলাসপুরী তুচ্ছ তোমার ঠাঁই।
দেখছি তোমার কাঙাল পিতার ঘর-দরজা নাই॥
শেষ দুইটি ছত্র বুঝিতে একটু গোল হয়; ইহার অর্থ এই যে তোমার বাসের পক্ষে কৈলাসপুরীই তুচ্ছ, এমন স্থলে তোমার কাঙাল পিতা তোমাকে স্থান দিতে পারেন এমন সাধ্য তাঁহার কী আছে।
পতিকে লইয়া পিতার সহিত বিরোধ করিতে হয়, আবার পিতাকে লইয়া পতির সহিত বিবাদ বাধিয়া উঠে, উমার এমনি অবস্থা।
গৌরী কন, আমি কইলে মিছে দন্দেজ হবে।
সেই-যে আমার কাঙাল পিতা ভিক্ষা মাংছেন কবে॥
তারা রাজার বেটা, দালান-কোঠা অট্টালিকাময়।
যাগযজ্ঞ করছে কত শ্মশানবাসী নয়॥
তারা নানা দানপুণ্যবান দেবকার্য করে।
এক দফাতে কাঙাল বটে, ভাঙ নাই তার ঘরে॥
কিন্তু কড়া জবাব দিয়া কার্যোদ্ধার হয় নাই। বরং তর্কে পরাস্ত হইলে গায়ের জোর আরো বাড়িয়া উঠে। সেই বুঝিয়া দুর্গা তখন–
গুটি পাঁচ-ছয় সিদ্ধির লাড়ু যত্ন ক’রে দিলেন।
দাম্পত্যযুদ্ধে এই ছয়টি সিদ্ধির লাড়ু কামানের ছয়টা গোলার মতো কাজ করিল; ভোলানাথ এক-দমে পরাভূত হইয়া গেলেন। সহসা পিতা কন্যা জামাতার ঘনিষ্ঠ মিলন হইয়া গেল। বাক্যহীন নন্দী সকৌতুক ভক্তিভরে দ্বারপার্শ্বে দাঁড়াইয়া মনে মনে হাসিতে লাগিল।
সম্ভ্রমে সম্ভাষণ করি বসলেন তিন জন।
দুগা, মর্তে যেয়ে কী আনিবে আমার কারণ॥
প্রতিবারে কেবলমাত্র বিল্বপত্র পাই।
দেবী বললেন, প্রভু ছাড়া কোন্ দ্রব্য খাই॥
সিঁদুর-ফোঁটা অলকছটা মুক্তা গাঁথা কেশে।
সোনার ঝাঁপা কনকচাঁপা, শিব ভুলেছেন যে বেশে॥
রত্নহার গলে তার দুলছে সোনার পাটা।
চাঁদনি রাত্রিতে যেন বিদ্যুৎ দিচ্ছে ছটা॥
তাড় কঙ্কণ সোন্ পৈঁছি শঙ্খ বাহুমূলে।
বাঁক-পরা মল সোনার নূপুর, আঁচল হেলে দোলে॥
সিংহাসন, পট্টবসন পরছে ভগবতী।
কার্তিক গণেশ চললেন লক্ষ্মী সরস্বতী॥
জয়া বিজয়া দাসী চললেন দুইজন।
গুপ্তভাবে চললেন শেষে দেব পঞ্চানন॥
গিরিসঙ্গে পরম রঙ্গে চললেন পরম সুখে।
ষষ্ঠী তিথিতে উপনীত হলেন মর্তলোকে॥
সারি সারি ঘটবারি আর গঙ্গাজল।
সাবধানে নিজমনে গাচ্ছেন মঙ্গল॥
তখন–
গিরিরানী কন বাণী চুমো দিয়ে মুখে
কও তারিণী জামাই-ঘরে ছিলে কেমন সুখে॥
এ ছড়াটি এইখানে শেষ হইল, ইহার বেশি আর বলিবার কথা নাই। এ দিকে বিদায়ের কাল সমাগত। কন্যাকে লইয়া শ্বশুরঘরের সহিত বাপের ঘরের একটু ঈর্ষার ভাব থাকে। বেশিদিন বধূকে বাপের বাড়িতে রাখা শ্বশুরপক্ষের মনঃপূত নহে। বহুকাল পরে মাতায় কন্যায় যথেষ্ট পরিতৃপ্তিপূর্বক মিলন হইতে না হইতেই শ্বশুরবাড়ি হইতে তাগিদ আসে, ধন্না বসিয়া যায়। স্ত্রীবিচ্ছেদবিধুর স্বামীর অধৈর্য তাহার কারণ নহে। হাজার হউক, বধূ পরের ঘর হইতে আসে; শ্বশুরঘরের সহিত তাহার সম্পূর্ণ জোড় লাগা বিশেষ চেষ্টার কাজ। সেখানকার নূতন কর্তব্য অভ্যাস ও পরিচয়বন্ধন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার বাল্যকালের স্বাভাবিক আশ্রয়স্থলে ঘন ঘন যাতায়াত বা দীর্ঘকাল অবস্থিতি করিতে দিলে জোড় লাগিবার ব্যাঘাত করে। বিশেষত বাপের বাড়িতে বিবাহিতা কন্যার কেবলই কর্তব্যহীন আদর, শ্বশুরবাড়িতে তাহার কর্তব্যের শাসন, এমন অবস্থায় দীর্ঘকাল বাপের বাড়ির আবহাওয়া শ্বশুরবর্গ বধূর পক্ষে প্রার্থনীয় জ্ঞান করেন না। এই-সকল নানা কারণে পিতৃগৃহে কন্যার গতিবিধিসম্বন্ধে শ্বশুরপক্ষীয়ের বিধান কিছু কঠোর হইয়াই থাকে। কন্যাপিতৃত্বের সেই একটা কষ্ট। বিজয়ার দিন বাংলাদেশের শ্বশুরবাড়ির সেই কড়া তাগিদ লইয়া শিব মেনকার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত। মাতৃস্নেহের স্বাভাবিক অধিকার সমাজ-শাসনের বিরুদ্ধে বৃথা আছাড় খাইয়া মরিতে লাগিল।
নাহি কাজ গিরিরাজ, শিবকে বলো যেয়ে
অমনি ভাবে ফিরে যাক সে, থাকবে আমার মেয়ে॥
তখন, শ্বশুরবাড়িতে দুর্গার যত কিছু দুঃখ আছে সমস্ত মাতার মনে পড়িতে লাগিল। শিবের ভাণ্ডারে যত অভাব, আচরণে যত ত্রুটি, চরিত্রে যত দোষ, সমস্ত তাঁহার নিকট জাজ্বল্যমান হইয়া উঠিল। অপাত্রে কন্যাদান করিয়াছেন, এখন সেটা যতটা পারেন সংশোধন করিবার ইচ্ছা, যতটা সম্ভব গৌরীকে মাতৃক্রোড়ে ফিরাইয়া লইবার চেষ্টা। শ্বশুরগৃহের আচারবিচার অনেক সময় দূর হইতে পিতৃগৃহের নিকট অযথা বলিয়া মনে হয় এবং পিতৃপক্ষীয়েরা স্নেহের আক্ষেপে কন্যার সমক্ষেই তাহার কঠোর সমালোচনা করিয়া থাকেন। মেনকা তাই শুরু করিলেন, এবং শিব সেই অন্যায় আচরণে ক্ষিপ্ত হইয়া শ্বশুরবাড়ির অনুশাসন সতেজে প্রচার করিয়া দিলেন।
মর্তে আসি পূর্বকথা ভুলছ দেখি মনে।
বারে বারে নিষেধ তোমায় করছি এ কারণে।
মায়ের কোলে মত্ত হয়ে ভুলছ দেখি স্বামী।
তোমার পিতা কেমন রাজা তাই দেখব আমি॥
শুনে কথা গিরিরাজা উষ্মাযুক্ত হল।
জয়-জোগাড়ে অভয়ারে যাত্রা করে দিল॥
যে নিবে সে ক’তে পারে, নইলে এমন শক্তি কার।
যাও তারিণী হরের ঘরে, এসো পুনর্বার॥
অনুগ্রহের সংকীর্ণ মেয়াদ উত্তীর্ণ হইল, কন্যা পতিগৃহে ফিরিয়া গেল।
এক্ষণে যে ছড়ার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি তাহাতে দেবদেবীর একটি গোপন ঘরের কথা বর্ণিত আছে।
শিব সঙ্গে রসরঙ্গে বসিয়ে ভবানী।
কুতূহলে উমা বলেন ত্রিশূল শূলপাণি॥
তুমি প্রভু, তুমি প্রভু ত্রৈলোক্যের সার।
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের বরুণ তোমারি কিংকর॥
তোমার নারী হয়ে আমার সাধ নাহি পোরে।
যেন বেন্যা পতির কপালে প’ড়ে রমণী ঝোরে॥
দিব্য সোনার অলংকার না পরিলাম গায়।
শামের বরন দুই শঙ্খ পরতে সাধ যায়॥
দেবের কাছে মরি লাজে হাত বাড়াতে নারি।
বারেক মোরে দাও শঙ্খ, তোমার ঘরে পরি॥
ভোলানাথ ভাবিলেন, একটা কৌতুক করা যাক, প্রথমেই একটু কোন্দল বাধাইয়া তুলিলেন।
ভেবে ভোলা হেসে কন শুন হে পার্বতী
আমি তো কড়ার ভিখারি ত্রিপুরারি শঙ্খ পাব কথি॥
হাতের শিঙাটা বেচলে পরে হবে না
একখানা শঙ্খের কড়ি।
বলদটা মূল করিলে হবে কাহনটেক কড়ি॥
এটি ওটি ঠাক ঠিকাটি চাও হে গৌরী
থাকলে দিতে পারি।
তোমার পিতা আছে বটে অর্থের অধিকারী।
সে কি দিতে পারে না দুমুটো শঙ্খের মুজুরি॥
এই-যে ধনহীনতার ভড়ং এটা মহাদেবের নিতান্ত বাড়াবাড়ি, স্ত্রীজাতির নিকট ইহা স্বভাবতই অসহ্য। স্ত্রী যখন ব্রেস্লেট প্রার্থনা করে কেরানিবাবু তখন আয়ব্যয়ের সুদীর্ঘ হিসাব বিশ্লেষণ করিয়া আপন দারিদ্র্য প্রমাণ করিতে বসিলে কোন্ ধর্মপত্নী তাহা অবিচলিত রসনায় সহ্য করিতে পারে। বিশেষত শিবের দারিদ্র্য ওটা নিতান্তই পোশাকি দারিদ্র্য, তাহা কেবল ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ সকলের উপরে টেক্কা দিবার জন্য, কেবল লক্ষ্মীর জননী অন্নপূর্ণার সহিত একটা অপরূপ কৌতুক করিবার অভিপ্রায়ে। কালিদাস শংকরের অট্টহাস্যকে কৈলাসশিখরের ভীষণ তুহিনপুঞ্জের সহিত তুলনা করিয়াছেন। মহেশ্বরের শুভ্র দারিদ্র্যও তাঁহার এক নিঃশব্দ অট্টহাস্য। কিন্তু দেবতার পক্ষেও কৌতুকের একটা সীমা আছে। মহাদেবী এ সম্বন্ধে নিজের মনের ভাব যেরূপে ব্যক্ত করিলেন তাহা অত্যন্ত স্পষ্ট। তাহাতে কোনো কথাই ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রহিল না।
গৌরী গর্জিয়ে কন ঠাকুর শিবাই
আমি গৌরী তোমার হাতে শঙ্খ পরতে চাই॥
আপনি যেমন যুব্-যুবতী অমনি যুবক পতি হয়
তবে সে বৈরস রস, নইলে কিছুই নয়॥
আপনি বুড়ো আধবয়সী ভাঙধুতুরায় মত্ত
আপনার মতো পরকে বলে মন্দ॥
এইখানে শেষ হয় নাই–ইহার পরে দেবী মনের ক্ষোভে আরো দুই-চারটি যে কথা বলিয়াছেন তাহা মহাদেবের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্বন্ধে, তাহা সাধারণ্যে প্রকাশযোগ্য নহে। সুতরাং আমরা উদ্ধৃত করিতে ক্ষান্ত হইলাম। ব্যাপারটা কেবল এইখানেই শেষ হইল না; স্ত্রীর রাগ যতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে, অর্থাৎ বাপের বাড়ি পর্যন্ত, তাহা গেল।
কোলে করি কার্তিক হাঁটায়ে লম্বোদরে
ক্রোধ করি হরের গৌরী গেলা বাপের ঘরে॥
এ দিকে শিব তাঁহার সংকল্পিত দাম্পত্য-প্রহসনের নেপথ্যবিধান শুরু করিলেন–
বিশ্বকর্মা এনে করান শঙ্খের গঠন।
শঙ্খ লইয়া শাঁখারি সাজিয়া বাহির হইলেন–
দুইবাহু শঙ্খ নিলেন নাম শ্রীরাম লক্ষ্ণণ।
কপটভাবে হিমালয়ে তলাসে ফেরেন॥
হাতে শূলী কাঁখে থলি শম্ভু ফেরে গলি গলি।
শঙ্খ নিবি শঙ্খ নিবি এই কথাটি ব’লে॥
সখীসঙ্গে বসে গৌরী আছে কুতূহলে।
শঙ্খ দেখি শঙ্খ দেখি এই কথাটি বলে॥
গৌরীকে দেখায়ে শাঁখারি শঙ্খ বার ক’ল্ল।
শঙ্খের উপরে যেন চন্দ্রের উদয় হল॥
মণি মুকুতা-প্রবাল-গাঁথা মাণিক্যের ঝুরি।
নব ঝলকে ঝলছে যেন ইন্দ্রের বিজুলি॥
দেবী খুশি হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–
শাঁখারি ভালো এনেছ শঙ্খ।
শঙ্খের কত নিবে তঙ্ক॥
দেবীর লুব্ধভাব দেখিয়া চতুর শাঁখারি প্রথমে দর-দামের কথা কিছুই আালোচনা করিল না; কহিল–
গৌরী,
ব্রহ্মলোক, বৈকুণ্ঠ, হরের কৈলাস, এ তো সবাই কয়।
বুঝে দিলেই হয়।
হস্ত ধুয়ে পরো শঙ্খ, দেরি উচিত নয়॥
শাঁখারি মুখে মুখে হরের স্থাবর সম্পত্তির যেরূপ ফর্দ দিল তাহাতে শাঁখাজোরা বিশেষ সস্তায় যাইবে মহাদেবীর এমন মনে করা উচিত ছিল না।
গৌরী আর মহাদেবে কথা হল দড়।
সকল সখী বলে দুর্গা শঙ্খ চেয়ে পরো॥
কেউ দিলেন তেল গামছা কেউ জলের বাটি।
দেবের ঊরুতে হস্ত থুয়ে বসলেন পার্বতী॥
দয়াল শিব বলেন, শঙ্খ আমার কথাটি ধরো–
দুর্গার হাতে গিয়ে শঙ্খ বজ্র হয়ে থাকো॥
শিলে নাহি ভেঙো শঙ্খ, খড়েগ নাহি ভাঙো।
দুর্গার সহিত করেন বাক্যের তরঙ্গ॥
এ কথা শুনিয়া মাতা মনে মনে হাসে।
শঙ্খ পরান জগৎপিতা মনের হরষে॥
শাঁখারি ভালো দিলে শঙ্খ মানায়ে।
ভাণ্ডার ভেঙে দেইগে তঙ্ক, লওগে গনিয়ে॥
এতক্ষণে শাঁখারি সময় বুঝিয়া কহিল–
আমি যদি তোমার শঙ্খের লব তঙ্ক।
জ্ঞেয়াত-মাঝারে মোর রহিবে কলঙ্ক॥
ইহারা যে বংশের শাঁখারি তাঁহাদের কুলাচার স্বতন্ত্র; তাঁহাদের বিষয়বুদ্ধি কিছুমাত্র নাই; টাকাকড়ি সম্বন্ধে বড়ো নিস্পৃহ; ইঁহারা যাঁহাকে শাঁখা পরান তাঁহাকে পাইলেই মূল্যের আর কোনোপ্রকার দাবি রাখেন না। ব্যবসায়টি অতি উত্তম।
কেমন কথা কও শাঁখারি কেমন কথা কও।
মানুষ বুঝিয়া শাঁখারি এ-সব কথা কও॥
শাঁখারি কহিল–
না করো বড়াই দুর্গা না করো বড়াই।
সকল তত্ত্ব জানি আমি এই বালকের ঠাঁই॥
তোমার পতি ভাঙড় শিব তা তো আমি জানি।
নিতি নিতি প্রতি ঘরে ভিক্ষা মাগেন তিনি॥
ভস্মমাখা তায় ভুজঙ্গ মাথে অঙ্গে।
নিরবধি ফেরেন তিনি ভূত-পেরেতের সঙ্গে॥
ইহাকেই বলে শোধ তোলা! নিজের সম্বন্ধে যে-সকল স্পষ্ট ভাষা মহাদেব সহধর্মিণীরই মুখ হইতে মধ্যে মধ্যে শুনিয়া আসিয়াছেন, অদ্য সুযোগমত সেই সত্য কথাগুলিই গৌরীর কানে তুলিলেন।
এই কথা শুনিয়া মায়ের রোদন বিপরীত।
বাহির করতে চান শঙ্খ না হয় বাহির॥
পাষাণ আনিল চণ্ডী, শঙ্খ না ভাঙিল।
শঙ্খেতে ঠেকিয়া পাষাণ খণ্ড খণ্ড হল॥
কোনোরূপে শঙ্খ যখন না হয় কর্তন।
খড়গ দিয়ে হাত কাটিতে দেবীর গেল মন॥
হস্ত কাটিলে শঙ্খে ভরিবে রুধিরে।
রুধির লাগিলে শঙ্খ নাহি লব ফিরে॥
মেনকা গো মা,
কী কুক্ষণে বাড়াছিলাম পা॥
মরিব মরিব মা গো হব আত্মঘাতী।
আপনার গলে দিব নরসিংহ কাতি॥
অবশেষে অন্য উপায় না দেখিয়া দুর্গা ধূপদীপনৈবেদ্য লইয়া ধ্যানে বসিলেন।
ধ্যানে পেলেন মহাদেবের চরণ দুখান।
তখন ব্যাপারটা বুঝা গেল, দেবতার কৌতুকের পরিসমাপ্তি হইল।
কোথা বা কন্যা, কোথা বা জামাতা।
সকলই দেখি যেন আপন দেবতা॥
এ যেন ঠিক স্বপ্নেরমতো হইল। নিমেষের মধ্যে–
দুর্গা গেলেন কৈলাসে, শিব গেলেন শ্মশানে।
ভাঙ ধুতুরা বেঁটে দুর্গা বসলেন আসনে।
সন্ধ্যা হলে দুইজনে হলেন একখানে॥
এইখানে চতুর্থ ছত্রের অপেক্ষা না রাখিয়াই ছড়া শেষ হইয়া গেল।
রাধাকৃষ্ণের সম্বন্ধীয় ছড়াগুলির জাতি স্বতন্ত্র। সেখানে বাস্তবিকতার কোঠা পার হইয়া মানসিকতার মধ্যে উত্তীর্ণ হইতে হয়। প্রাত্যহিক ঘটনা, সাংসারিক ব্যাপার, সামাজিক রহস্য সেখানে স্থান পায় না। সেই অপরূপ রাখালের রাজ্য বাঙালি ছড়া রচয়িতা ও শ্রোতাদের মানসরাজ্য।
স্থানে স্থানে ফেরেন রাখাল সঙ্গে কেহ নাই।
ভাণ্ডীবনে ধেনু চরান সুবল কানাই॥
সুবল বলিছে শুন ভাই রে কানাই
আজি তোরে ভাণ্ডীবনবিহারী সাজাই॥
এই সাজাইবার প্রস্তাব মাত্র শুনিয়া নিকুঞ্জে যেখানে যত ফুল ছিল সকলেই আগ্রহে ব্যাকুল হইয়া উঠিল।
কদম্বের পুষ্প বলেন সভা-বিদ্যমানে
সাজিয়া দুলিব আজি গোবিন্দের কানে॥
করবীর পুষ্প বলেন, আমার মর্ম কে বা জানে–
আজ আমায় রাখবেন হরি চূড়ার সাজনে॥
অলক ফুলের কনকদাম বেলফুলের গাঁথনি–
আমার হৃদয়ে শ্যাম দুলাবে চূড়ামণি॥
আনন্দেতে পদ্ম বলেন, তোমরা নানা ফুল
আমায় দেখিলে হবে চিত্ত ব্যাকুল।
চরণতলে থাকি আমি কমল পদ্ম নাম
রাধাকৃষ্ণে একাসনে হেরিব বয়ান॥
কোনো ফুলকেই নিরাশ হইতে হইল না, সেদিন তাহাদের ফুটিয়া ওঠা সার্থক হইল।
ফুলেরই উড়ানি ফুলেরই জামাজুরি
সুবল সাজাইলি ভালো।
ফুলেরই পাগ ফুলেরই পোশাক
সেজেছে বিহারীলাল॥
নানা আভরণ ফুলেরই ভূষণ
চূড়াতে করবী ফুল।
কপালে কিরীটিঅতি পরিপাটি
পড়েছে চাঁচর চুল॥
এ দিকে কৌতুহলী ভ্রমর-ভ্রমরী ময়ূর-ময়ূরী খঞ্জন-খঞ্জনীর মেলা বসিয়া গেল। যে-সকল পাখির কণ্ঠ আছে তাহারা সুবলের কলানৈপুণ্যের প্রশংসা করিতে লাগিল; কোকিল সস্ত্রীক আসিয়া বলিয়া গেল “কিংকিণী কিরীটি অতি পরিপাটি’।
ডাহুক ডাহুকী টিয়া টুয়া পাখি
ঝংকারে উড়িয়া যায়।
তাহারা ঝংকার করিয়া কী কথা বলিল?—
সুবল রাখাল সাজায়েছে ভালো
বিনোদবিহারী রায়।
এ দিকে চাতক-চাতকী শ্যামকে মেঘ ভ্রম করিয়া উড়িয়া উড়িয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া “জল দে’ “জল দে’ বলিয়া ডাকিয়া বেড়াইতে লাগিল। বনের মধ্যে শাখায় পল্লবে বাতাসে আকাশে ভারি একটা রব পড়িয়া গেল।
কানাই বলিছে, প্রাণের ভাই রে সুবল।
কেমনে সাজালে ভাই বল্ দেখি বল্॥
কানাই জানেন তাঁহার সাজ সম্পূর্ণ হয় নাই। কোকিল-কোকিলা আর ডাহুক-ডাহুকীরা যাহাই বলুক-না কেন, সুবলের রুচি এবং নৈপুণ্যের প্রশংসা করিবার সময় হয় নাই।
নানা ফুলে সাজালে ভাই, বামে দাও প্যারী।
তবে তো সাজিবে তোর বিনোদবিহারী॥
বৃন্দাবনের সর্বপ্রধান ফুলটিই বাকি ছিল। সেই অভাবটা পশু-পক্ষীদের নজরে না পড়িতে পারে, কিন্তু শ্যামকে যে বাজিতে লাগিল।
কুঞ্জপানে যে দিকে ভাই চেয়ে দেখি আঁখি
সুখময় কুঞ্জবন অন্ধকার দেখি॥
তখন লজ্জিত সুবল কহিল–
এই স্থানে থাকো তুমি নবীন বংশীধারী।
খুঁজিয়া মিলাব আজ কঠিন কিশোরী॥
এ দিকে ললিতা-বিশাখা সখীদের মাঝখানে রাধিকা বসিয়া আছেন।
সুবলকে দেখিয়া সবই হয়ে হরষিত–
এসো এসো বসো সুবল একি অচরিত॥
সুবল সংবাদ দিল–
মন্দ মন্দ বহিতেছে বসন্তের বা, পত্র পড়ে গলি।
কাঁদিয়া বলেন কৃষ্ণ কোথায় কিশোরী॥
কৃষ্ণের দুরবস্থার কথা শুনিয়া রাধা কাঁদিয়া উঠিয়া কহিলেন–
সাধ করে হার গেঁথেছি সই দিব কার গলে।
ঝাঁপ দিয়ে মরিব আজ যমুনার জলে॥
রাই অনাবশ্যক এইরূপ একটা দুঃসাধ্য দুঃসাহসিক ব্যাপার ঘটাইবার জন্য মুহূর্তের মধ্যে কৃতসংকল্প হইয়া উঠিলেন। কিন্তু অবশেষে সখীদের সহিত রফা করিয়া বলিলেন–
যেই সাজে আছি আমি এই বৃন্দাবনে
সেই সাজে যাব আমি কৃষ্ণদরশনে॥
দাঁড়া লো দাঁড়া লো সই বলে সহচরী।
ধীরে যাও, ফিরে চাও রাধিকাসুন্দরী।
রাধিকা সখীদের ডাকিয়া বলিলেন–
তোমরা গো পিছে এস মাথে করে দই।
নাথের কুশল হোক, ঝটিৎ এস সই॥
রাধা প্রথম আবেগে যদিও বলিয়াছিলেন যে সাজে আছেন সেই সাজেই যাইবেন, কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা রহিল না।
হালিয়া মাথার বেণী বামে বাঁধি চূড়া,
অলকা তিলকা দিয়ে, এঁটে পরে ধড়া।
ধড়ার উপরে তুলে নিলেন সুবর্ণের ঝরা॥
সোনার বিজটা শোভে হাতে তাড়বালা।
গলে শোভে পঞ্চরত্ন তক্তি কণ্ঠমালা॥
চরণে শোভিছে রাইয়ের সোনার নূপুর।
কটিতে কিংকিণী সাজে, বাজিছে মধুর॥
চিন্তা নাই চিন্তা নাই বিশাখা এসে বলে
ধবলীর বৎস একটি তুলে লও কোলে॥
সখীরা সব দধির ভাণ্ড মাথায় এবং রাধিকা ধবলীর এক বাছুর কোলে লইয়া, গোয়ালিনীর দল ব্রজের পথ দিয়া শ্যাম-দরশনে চলিল। কৃষ্ণ তখন রাধিকার রূপ ধ্যান করিতে করিতে অচেতন।
সাক্ষাতে দাঁড়ায়ে রাই বলিতেছে বাণী
কী ভাব পড়িছে মনে শ্যাম গুণমণি।
যে ভাব পড়েছে মনে সেই ভাব আমি॥
রাধিকা সগর্বে সবিনয়ে কহিলেন, তোমারই অন্তরের ভাব আমি বাহিরে প্রত্যক্ষ বিরাজমান।–
গাও তোলো চক্ষু মেলো ওহে নীলমণি।
কাঁদিয়ে কাঁদাও কেন, আমি বিনোদিনী॥
অঞ্চলেতে ছিল মালা দিল কৃষ্ণের গলে।
রাধাকৃষ্ণের যুগল মিলন ভাণ্ডীরবনে॥
ভাণ্ডীরবনবিহারীর সাজ সম্পূর্ণ হইল; সুবলের হাতের কাজ সমাধা হইয়া গেল।
ইহার মধ্যে বিশেষ করিয়া বাংলার গ্রামদৃশ্য গৃহচিত্র কিছুই নাই। গোয়ালিনীরা যেরূপ সাজে নূপুর-কিংকিণী বাজাইয়া দধি-মাথায় বাছুর-কোলে বনপথ দিয়া চলিয়াছে তাহা বাংলার গ্রামপথে প্রত্যহ, অথবা কদাচিৎ, দেখিতে পাওয়া যায় না। রাখালেরা মাঠের মধ্যে বটচ্ছায়ায় অনেকরকম খেলা করে, কিন্তু ফুল লইয়া তাহাদের ও তাহাদিগকে লইয়া ফুলের এমন মাতামাতি শুনা যায় না। এ-সমস্ত ভাবের সৃষ্টি। কৃষ্ণরাধার বিরহ-মিলন সমস্ত বিশ্ববাসীর বিরহ-মিলনের আদর্শ; ইহার মধ্যে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মণসমাজ বা মনুসংহিতা নাই, ইহার আাগাগোড়া রাখালি কাণ্ড। যেখানে সমাজ বলবান্ সেখানে বৃন্দাবনের গোচারণের সঙ্গে মথুরার রাজ্যপালনের একাকার হওয়া অত্যন্ত অসংগত। কিন্তু কৃষ্ণ-রাধার কাহিনী যে ভাবলোকে বিরাজ করিতেছে সেখানে ইহার কোনো কৈফিয়ত আবশ্যক করে না। এমন-কি, সেখানে চিরপ্রচলিত সমস্ত সমাজপ্রথাকে অতিক্রম করিয়া বৃন্দাবনের রাখালবৃত্তি মথুরার রাজত্ব অপেক্ষা অধিকতর গৌরবজনক বলিয়া সপ্রমাণ হইয়াছে। আমাদের দেশে, যেখানে কর্মবিভাগ শাস্ত্রশাসন এবং সামাজিক উচ্চনীচতার ভাব সাধারণের মনে এমন দৃঢ়বদ্ধমূল সেখানে কৃষ্ণরাধার কাহিনীতে এইপ্রকার আচারবিরুদ্ধ বন্ধনবিহীন ভাবের স্বাধীনতা যে কত বিস্ময়কর তাহা চিরাভ্যাসক্রমে আমরা অনুভব করি না।
কৃষ্ণ মথুরায় রাজত্ব করিতে গেলে রাধিকা কাঁদিয়া কহিলেন–
আর কি এমন ভাগ্য হবে ব্রজে আসবে হরি।
সে গিছে মথুরাপুরী, মিথ্যে আশা করি॥
রাজাকে পুনরায় রাখাল করিবার আশা দুরাশা, এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে। কিন্তু বৃন্দা বৃন্দাবনের আসল কথা বোঝে, সে জানে নিরাশ হইবার কোনো কারণ নাই। সে জানে বৃন্দাবন-মথুরায় কাশী-কাঞ্চীর নিয়ম ঠিক খাটে না।
বৃন্দে বলে আমি যদি এনে দিতে পারি
তবে মোরে কী ধন দিবে বলো তো কিশোরী॥
শুনে বাণী কমলিনী যেন পড়িল ধন্দে–
দেহপ্রাণ করেছে দান কৃষ্ণপদারবিন্দে।
এক কালেতে যাঁক সঁপেছি বিরাগ হলেন তাই।
যম-সম কোনো দেবতা রাধিকার নাই॥
ইহা বই নিশ্চয় কই কোথা পাব ধন।
মোর কেবল কৃষ্ণনাম অঙ্গের ভূষণ।
রাজার নন্দিনী মোরা প্রেমের ভিখারি।
বঁধুর কাছে সেই ধন লয়ে দিতে পারি।
বলছে দূতী শোন্ শ্রীমতী মিলবে শ্যামের সাথে।
তখন দুজনের দুই যুগল চরণ তাই দিয়ো মোর মাথে॥
এই পুরস্কারের কড়ার করাইয়া লইয়া দূতী বাহির হইলেন। যমুনা পার হইয়া পথের মধ্যে–
হাস্যরসে একজনকে জিজ্ঞাসিলেন তবে।
কও দেখি কার অধিকারে বসত কর সবে॥
সে লোক বললে তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্ররায়।
মেঘের ধারা রৌদ্রে যেমন লাগল দূতীর গায়॥
ননিচোরা রাখাল ছোঁড়া ঠাট করেছে আসি।
চোর বিনে তাকে কবে ডাকছে গোকুলবাসী॥
কৃষ্ণের এই রায়বাহাদুর খেতাবটি দূতীর কাছে অত্যন্ত কৌতুকাবহ বোধ হইল। কৃষ্ণচন্দ্ররায়! এ তো আসল নাম নয়। এ কেবল মূঢ় লোকদিগকে ভুলাইবার একটা আড়ম্বর। আসল নাম বৃন্দা জানে।
চললেন শেষে কাঙাল বেশে উতরিলেন দ্বারে।
হুকুম বিনে রাত্রিদিনে কেউ না যেতে পারে॥
বহুকষ্টে হুকুম আনাইয়া “বৃন্দাদূতী গেল সভার মাঝে’।
সম্ভাষণ করি দূতী থাকল কতক্ষণ।
একদৃষ্টে চেয়ে দেখে কৃষ্ণের বদন॥
ধড়াচূড়া ত্যাগ করিয়ে মুকুট দিয়েছ মাথে।
সব অঙ্গে রাজ-আভরণ, বংশী নাইকো হাতে॥
সোনার মালা কণ্ঠহার বাহুতে বাজুবন্ধ।
শ্বেত চামরে বাতাস পড়ে দেখে লাগে ধন্দ॥
নিশান উড়ে, ডঙ্কা মারে, বলছে খবরদার।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘটা ব্যবস্থা বিচার॥
আর এক দরখাস্ত করি শুন দামোদর।
যমুনাতে দেখে এলেম এক তরী মনোহর॥
শূন্য হয়ে ভাসছে তরী ওই যমুনাতীরে।
কাণ্ডারী-অভাবে নৌকা ঘাটে ঘাটে ফিরে॥
পূর্বে এক কাণ্ডারী ছিল সর্বলোকে কয়।
সে চোর পালালো কোথা তাকে ধরতে হয়॥
শুনতে পেলেম হেথা এলেম মথুরাতে আছে।
হাজির না হয় যদি জানতে পাবে পাছে।
মেয়ে হয়ে কয় কথা, পুরুষের ডরায় গা।
সভাশুদ্ধ নিঃশব্দ, কেউ না করে রা–।
ব্রজপুরে ঘর-বসতি মোর।
ভাণ্ড ভেঙে ননি খেয়ে পলায়েছে চোর॥
চোর ধরিতে এই সভাতে আসছে অভাগিনী।
কেমন রাজা বিচার করো জানব তা এখনি॥
বৃন্দা কৃষ্ণচন্দ্ররায়ের রাজসম্মান রক্ষা করিয়া ঠিক দস্তুরমত কথাগুলি বলিল, অন্তত কবির রিপোর্ট্ দৃষ্টে তাহাই বোধ হয়। তবে উহার মধ্যে কিছু স্পর্ধাও ছিল; বৃন্দা মথুরার উপরে আপন বৃন্দাবনের দেমাক ফলাইতে ছাড়ে নাই। “হাজির না হয় যদি জানতে পাবে পাছে’ এ কথাটা খুব চড়া কথা; শুনিয়া সভাস্থ সকলে নিঃশব্দ হইয়া গেল। মথুরার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায় কহিলেন–
ব্রজে ছিলে বৃন্দা দাসী বুঝি অনুমানে।
কোন্দিন বা দেখাসাক্ষাৎ ছিল বৃন্দাবনে॥
তখন বৃন্দা কচ্ছেন, কী জানি তা হবে কদাচিৎ।
বিষয় পেলে অনেক ভোলে মহতের রীত॥
কৃষ্ণ বৃন্দাবনের কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করিলে বৃন্দা কহিলেন–
হাতে ননি ডাকছে রানী গোপাল কোথা রয়।
ধেনু বৎস আদি তব তৃণ নাহি খায়॥
শতদল ভাসতেছে সেই সমুদ্রমাঝে।
কোন্ ছার ধুতুরা পেয়ে এত ডঙ্কা বাজে॥
মথুরার রাজত্বকে বৃন্দা ধুতুরার সহিত তুলনা করিল; তাহাতে মত্ততা আছে, কিন্তু বৃন্দাবনের সৌন্দর্য ও সুগন্ধ কোথায়?
বলা বাহুল্য ইহার পর বৃন্দার দৌত্য ব্যর্থ হয় নাই।–
দূতী কৃষ্ণ লয়ে বিদায় হয়ে ব্রজপুরে এল।
পশুপক্ষী আদি যত পরিত্রাণ পেল॥
ব্রজের ধন্য লতা তমাল পাতা ধন্য বৃন্দাবন।
ধন্য ধন্য রাধাকৃষ্ণের যুগলমিলন॥
বাংলার গ্রাম্যছড়ায় হরগৌরী এবং রধাকৃষ্ণের কথা ছাড়া সীতারাম ও রাম-রাবণের কথাও পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা তুলনায় স্বল্প। এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে, পশ্চিমে, যেখানে রামায়ণকথাই সাধারণের মধ্যে বহুলপরিমাণে প্রচলিত সেখানে বাংলা অপেক্ষা পৌরুষের চর্চা অধিক। আমাদের দেশে হরগৌরীকথায় স্ত্রী-পুরুষ এবং রাধাকৃষ্ণকথায় নায়ক-নায়িকার সম্বন্ধ নানারূপে বর্ণিত হইয়াছে; কিন্তু তাহার প্রসর সংকীর্ণ, তাহাতে সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বের খাদ্য পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে রাধাকৃষ্ণের কথায় সৌন্দর্যবৃত্তি এবং হরগৌরীর কথায় হৃদয়বৃত্তির চর্চা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে ধর্মপ্রবৃত্তির অবতারণা হয় নাই। তাহাতে বীরত্ব, মহত্ত্ব, অবিচলিত ভক্তি ও কঠোর ত্যাগস্বীকারের আদর্শ নাই। রামসীতার দাম্পত্য আমাদের দেশপ্রচলিত হরগৌরীর দাম্পত্য অপেক্ষা বহুতরগুণে শ্রেষ্ঠ, উন্নত এবং বিশুদ্ধ; তাহা যেমন কঠোর গম্ভীর তেমনি স্নিগ্ধ কোমল। রামায়ণকথায় এক দিকে কর্তব্যের দুরূহ কাঠিন্য অপর দিকে ভাবের অপরিসীম মাধুর্য একত্র সম্মিলিত। তাহাতে দাম্পত্য, সৌভ্রাত্র, পিতৃভক্তি, প্রভুভক্তি, প্রজাবাৎসল্য প্রভৃতি মনুষ্যের যত প্রকার উচ্চ অঙ্গের হৃদয়বন্ধন আছে তাহার শ্রেষ্ঠ আদর্শ পরিস্ফুট হইয়াছে। তাহাতে সর্বপ্রকার হৃদ্বৃত্তিকে মহৎধর্মনিয়মের দ্বারা পদে পদে সংযত করিবার কঠোর শাসন প্রচারিত। সর্বতোভাবে মানুষকে মানুষ করিবার উপযোগী এমন শিক্ষা আর কোনো দেশে কোনো সাহিত্যে নাই। বাংলাদেশের মাটিতে সেই রামায়ণকথা হরগৌরী ও রাধাকৃষ্ণের কথার উপরে যে মাথা তুলিয়া উঠিতে পারে নাই তাহা আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। রামকে যাহারা যুদ্ধক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নরদেবতার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে তাহাদের পৌরুষ কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধর্মপরতার আদর্শ আমাদের অপেক্ষা উচ্চতর।
ফাল্গুন-চৈত্র ১৩০৫
ছেলেভুলানো ছড়া : ২
ভূমিকা
আমাদের অলংকারশাস্ত্রে নয় রসের উল্লেখ আছে, কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে যে রসটি পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোক্ত কোনো রসের অন্তর্গত নহে। সদ্যঃকর্ষণে মাটি হইতে যে সৌরভটি বাহির হয়, অথবা শিশুর নবনীতকোমল দেহের যে স্নেহোদ্বেলকর গন্ধ, তাহাকে পুষ্প চন্দন গোলাপ-জল আতর বা ধূপের সুগন্ধের সহিত এক শ্রেণীতে ভুক্ত করা যায় না। সমস্ত সুগন্ধের অপেক্ষা তাহার মধ্যে যেমন একটি অপূর্ব আদিমতা আছে, ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে তেমনি একটি আদিম সৌকুমার্য আছে–সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস নাম দেওয়া যাইতে পারে। তাহা তীব্র নহে, গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত স্নিগ্ধ সরস এবং যুক্তিসংগতিহীন।
শুধুমাত্র এই রসের দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াই আমি বাংলাদেশের ছড়া-সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। রুচিভেদবশত সে রস সকলের প্রীতিকর না হইতে পারে, কিন্তু এই ছড়াগুলি স্থায়ীভাবে সংগ্রহ করিয়া রাখা কর্তব্য সে বিষয়ে বোধ করি কাহারো মতান্তর হইতে পারে না। কারণ, ইহা আমাদের জাতীয় সম্পত্তি। বহুকাল হইতে আমাদের দেশে মাতৃভাণ্ডারে এই ছড়াগুলি রক্ষিত হইয়া আসিয়াছে; এই ছড়ার মধ্যে আমাদের মাতৃমাতামহীগণের স্নেহ-সংগীতস্বর জড়িত হইয়া আছে, এই ছড়ার ছন্দে আমাদের পিতৃপিতামহগণের শৈশবনৃত্যের নূপুরনিক্কণ ঝংকৃত হইতেছে। অথচ, আজকাল এই ছড়াগুলি লোকে ক্রমশই বিস্মৃত হইয়া যাইতেছে। সামাজিক পরিবর্তনের স্রোতে ছোটোবড়ো অনেক জিনিস অলক্ষিতভাবে ভাসিয়া যাইতেছে। অতএব জাতীয় পুরাতন সম্পত্তি সযত্নে সংগ্রহ করিয়া রাখিবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে।
ছড়াগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হইতে সংগ্রহ করা হইয়াছে; এইজন্য ইহার অনেকগুলির মধ্যে বাংলার অনেক উপভাষা (dialect) লক্ষিত হইবে। একই ছড়ার আনেকগুলি পাঠও পাওয়া যায়; তাহার মধ্যে কোনোটিই বর্জনীয় নহে। কারণ, ছড়ায় বিশুদ্ধ পাঠ বা আদিম পাঠ বলিয়া কিছু নির্ণয় করিবার উপায় অথবা প্রয়োজন নাই। কালে কালে মুখে মুখে এই ছড়াগুলি এতই জড়িত মিশ্রিত এবং পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন পাঠের মধ্য হইতে কোনো-একটি বিশেষ পাঠ নির্বাচিত করিয়া লওয়া সংগত হয় না। কারণ, এই কামচারিতা, কামরূপধারিতা, ছড়াগুলির প্রকতিগত। ইহারা অতীত কীর্তির ন্যায় মৃতভাবে রক্ষিত নহে। ইহারা সজীব, ইহরা সচল; ইহারা দেশকালপাত্রবিশেষে প্রতিক্ষণে আপনাকে অবস্থার উপযোগী করিয়া তুলিতেছে। ছড়ার সেই নিয়তপরিবর্তনশীল প্রকৃতিটি দেখাইতে গেলে তাহার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ রক্ষা করা আবশ্যক। নিম্নে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।–
প্রথম পাঠ
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে॥
বাজতে বাজতে চলল ডুলি।
ডুলি গেল সেই কমলাপুলি॥
কমলাপুলির টিয়েটা।
সূয্যিমামার বিয়েটা॥
আয় রঙ্গ হাটে যাই।
গুয়া পান কিনে খাই॥
একটা পান ফোঁপরা।
মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া॥
কচি কচি কুমড়োর ঝোল।
ওরে খুকু গা তোল্॥
আমি তো বটে নন্দঘোষ–
মাথায় কাপড় দে॥
হলুদ বনে কলুদ ফুল।
তারার নামে টগর ফুল॥
দ্বিতীয় পাঠ
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঢাঁই মিরগেল ঘাঘর বাজে॥
বাজতে বাজতে প’ল ঠুলি।
ঠুলি গেল কমলাফুলি॥
আয় রে কমলা হাটে যাই।
পান-গুয়োটা কিনে খাই॥
কচি কুমড়োর ঝোল।
ওরে জামাই গা তোল্॥
জ্যোৎস্নাতে ফটিক ফোটে–
কদমতলায় কে রে।
আমি তো বটে নন্দঘোষ–
মাথায় কাপড় দে রে॥
তৃতীয় পাঠ
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
লাল মিরগেল ঘাঘর বাজে॥
বাজতে বাজতে এল ডুলি।
ডুলি গেল সেই কমলাপুলি॥
কমলাপুলির বিয়েটা।
সূয্যিমামার টিয়েটা॥
হাড় মুড়্ মুড়্ কেলে জিরে।
কুসুম কুসুম পানের বিঁড়ে॥
রাই রাই রাই রাবণ।
হলুদ ফুলে কলুদ ফুল।
তারার নামে টগ্গর ফুল॥
এক গাচি করে মেয়ে খাঁড়া।
এক গাচি করে পুরুষ খাঁড়া॥
জামাই বেটা ভাত খাবি তো
এখানে এস বোস্।
খা গণ্ডা গণ্ডা কাঁটালের কোষ॥
উপরি-উদ্ধৃত ছড়াগুলির মধ্যে মূল পাঠ কোনটি, তাহা নির্ণয় করা অসম্ভব এবং মূল পাঠটি রক্ষা করিয়া অন্য পাঠগুলি ত্যাগ করাও উচিত হয় না। ইহাদের পরিবর্তনগুলিও কৌতুকাবহ এবং বিশেষ আলোচনার যোগ্য। “আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে’–এই ছত্রটির কোনো পরিষ্কার অর্থ আছে কি না জানি না; অথবা যদি ইহা অন্য কোনো ছত্রের অপভ্রংশ হয় তবে সে ছত্রটি কী ছিল তাহাও অনুমান করা সহজ নহে। কিন্তু ইহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, প্রথম কয়েক ছত্র বিবাহযাত্রার বর্ণনা। দ্বিতীয় ছত্রে যে বাজনা কয়েকটির উল্লেখ আছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন পাঠে কতই বিকৃত হইয়াছে। আবার ভিন্ন স্থান হইতে আমরা এই ছড়ার আর-একটি পাঠ প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাতে আছে–
আগ্ডম বাগ্ডম ঘোড়াডম সাজে।
ডান মেকড়া ঘাঘর বাজে॥
বাজতে বাজতে পড়ল টুরি।
টুরি গেল কমলাপুরি॥
ভাষার যে ক্রমশ কিরূপে রূপান্তর হইতে থাকে, এই-সকল ছড়া হইতে তাহার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
ছড়া-সংগ্রহ
১
মাসি পিসি বনগাঁবাসী, বনের ধারে ঘর।
কখনো মাসি বলেন না যে খই মোওয়াটা ধর্॥
কিসের মাসি, কিসের পিসি, কিসের বৃন্দাবন।
এত দিনে জানিলাম মা বড়ো ধন॥
মাকে দিলুম আমন-দোলা।
বাপকে দিলুম নীলে ঘোড়া॥
আপনি যাব গৌড়।
আনব সোনার মউর॥
তাইতে দেব ভায়ের বিয়ে।
আপনি নাচব ধেয়ে॥
২
কে মেরেছে, কে ধরেছে সোনার গতরে।
আধ কাঠা চাল দেব গালের ভিতরে।
কে মেরেছে, কে ধরেছে, কে দিয়েছে গাল।
তার সঙ্গে গোসা করে ভাত খাও নি কাল॥
কে মেরেছে, কে ধরেছে, কে দিয়েছে গাল।
তার সঙ্গে কোঁদল করে আসব আমি কাল॥
মারি নাইকো, ধরি নাইকো, বলি নাইকো দূর।
সবেমাত্র বলেছি গোপাল চরাও গে বাছুর॥
৩
পুঁটু নাচে কোন্খানে।
শতদলের মাঝখানে।
সেখানে পুঁটু কী করে।
চুল ঝাড়ে আর ফুল পাড়ে।
ডুব দিয়ে দিয়ে মাছ ধরে॥
৪
ধন ধোনা ধন ধোনা।
চোত-বোশেখের বেনা॥
ধন বর্ষাকালের ছাতা।
জাড় কালের কাঁথা॥
ধন চুল বাঁধবার দড়ি।
হুড়কো দেবার নড়ি॥
পেতে শুতে বিছানা নেই।
ধন ধুলোয় গড়াগড়ি॥
ধন পরানের পেটে।
কোন্ পরানে বলব রে ধন
যাও কাদাতে হেঁটে॥
ধন ধোনা ধন ধন।
এমন ধন যার ঘরে নাই তার বৃথায় জীবন॥
৫
ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি আমার বাড়ি যেয়ো।
সরু সুতোর কাপড় দেব, ভাত রেঁধে খেয়ো॥
আমার বাড়ির জাদুকে আমার বাড়ি সাজে।
লোকের বাড়ি গেলে জাদু কোঁদলখানি বাজে॥
হোক কোঁদল ভাঙুক খাড়ু।
দু হাতে কিনে দেব ঝালের নাড়ু॥
ঝালের নাড়ু বাছা আমার না খেলে না ছুঁলে।
পাড়ার ছেলেগুলো কেড়ে এসে খেলে॥
গোয়াল থেকে কিনে দেব দুদ্ওলা গাই।
বাছার বালাই নিয়ে আমি মরে যাই॥
দুদ্ওলা গাইটে পালে হল হারা।
ঘরে আছে আওটা দুধ আর চাঁপাকলা।
তাই দিয়ে জাদুকে ভোলা রে ভোলা॥
৬
ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি ঘুমের বাড়ি যেয়ো।
বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খেয়ো॥
শান-বাঁধানো ঘাট দেব, বেসম মেখে নেয়ো।
শীতলপাটি পেড়ে দেব, পড়ে ঘুম যেয়ো॥
আঁব-কাঁটালের বাগান দেব, ছায়ায় ছায়ায় যাবে।
চার চার বেয়ারা দেব, কাঁধে করে নেবে॥
দুই দুই বাঁদি দেব, পায়ে তেল দেবে।
উল্কি ধানের মুড়কি দেব নারেঙ্গা ধানের খই।
গাছ-পাকা রম্ভা দেব হাঁড়ি-ভরা দই॥
৭
ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি আমার বাড়ি এসো।
শেজ নেই, মাদুর নেই, পুঁটুর চোখে বোসো॥
বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খেয়ো।
খিড়কি দুয়ার খুলে দেব, ফুড়ুৎ করে যেয়ো॥
৮
ও পাড়াতে যেয়ো না, বঁধু এসেছে।
বঁধুর পাতের ভাত খেয়ো না, ভাব লেগেছে॥
ভাব ভাব কদমের ফুল ফুটে রয়েছে।
ঢাকনখুলে দেখো বড়ো বউর খোকা হয়েছে॥
৯
পানকৌড়ি পনকৌড়ি ডাঙায় ওঠো’সে।
তোমার শাশুড়ি বলে গেছে বেগুন কোটো’সে॥
ও বেগুন কুটো না, বীচ রেখেছে।
ও ঘরেতে যেয়ো না, বঁধু এয়েছে॥
বঁধুর পান খেয়ো না, ঝগড়া করেছে।
দাদাকে দেখে কদম-পানা ফুটে উঠেছে॥
১০
পানকৌড়ি পানকৌড়ি ডাঙায় ওঠো’সে।
তোমার শাশুড়ি বলে গেছেন আলু কোটো’সে॥
কী করে কুটব, চাকা চাকা ক’রে॥
ও দুয়োরে যেয়ো না, বঁধু এসেছে।
বঁধুর পান খেয়ো না, ভাব লেগেছে।
ভাব ভাব কদমের ফুল ফুটে উঠেছে॥
১১
ঘুঘু মেতি সই
পুত কই।
হাটে গেছে॥
হাট কই।
পুড়ে গেছে॥
ছাই কই।
গোয়ালে আছে॥
সোনা-কুড়ে পড়বি না ছাই-কুড়ে পড়বি?
১২
ওরে আমার ধন ছেলে
পথে বসে বসে কান্ছিলে॥
মা ব’লে ব’লে ডাকছিলে।
ধুলো-কাদা কত মাক্ছিলে॥
সে যদি তোমার মা হ’ত
ধুলো-কাদা ঝেড়ে কোলে নিত॥
১৩
পুঁটুমণি গো মেয়ে
বর দিব চেয়ে॥
কোন্ গাঁয়ের বর।
নিমাই সরকারের বেটা, পালকি বের কর্॥
বের করেছি, বের করেছি ফুলের ঝারা দিয়ে।
পুঁটুমণিকে নিয়ে যাব বকুলতলা দিয়ে॥
১৪
ধুলোর দোসর নন্দকিশোর ধুলো মাখা গায়।
ধুলো ঝেড়ে করব কোলে আয় নন্দরায়॥
১৫
ধুলোর দোসর নন্দকিশোর গা করেছ খড়ি।
কলুবাড়ি যাও, তেল আনো গে, আমি দিব তার কড়ি॥
১৬
আয় রে চাঁদা, আগড় বাঁধা, দুয়ারে বাঁধা হাতি।
চোখ ঢুল্ঢুল্্ নয়নতারা দেখ্সে চাঁদের বাজি॥
১৭
বড়োবউ গো ছোটোবউ গো জলকে যাবি গো।
জলের মধ্যে ফুল ফুটেছে দেখতে পাবি গো॥
কেষ্ট বেড়ান কূলে কূলে, তাঁত নিবি গো।
তারি জন্যে মার খেয়েছি, পিঠ দেখো গো॥
বড়োবউ গো ছোটোবউ গো আরেক কথা শুন্সে॥
রাধার ঘরে চোর ঢুকেছে চুড়োবাঁধা মিন্সে॥
ঘটি নেয় না, বাটি নেয় না, নেয় না সোনার ঝারি।
যে ঘরেতে রাঙা বউ সেই ঘরেতে চুরি॥
১৮
খোকা গেছে মাছ ধরতে, দেব্তা এল জল।
ও দেব্তা তোর পায়ে ধরি খোকন আসুক ঘর॥
কাজ নাইকো মাছে, আগুন লাগুক মাছে।
খোকনের পায়ে কাদা লাগে পাছে॥
১৯
এ পারেতে বেনা, ও পারেতে বেনা।
মাছ ধরেছি চুনোচানা॥
হাঁড়ির ভিতর ধনে।
গৌরী বেটী কনে॥
নোকে বেটা বর।
টাঁকশালেতে চাকরি করে ঘুঘুডাঙায় ঘর॥
ঘুঘুডাঙায় ঘুঘু মরে চাল-ভাজা খেয়ে।
ঘুঘুর মরণ দেখতে যাব এয়োশাঁখা পরে॥
শাঁখাটি ভাঙল। ঘুঘুটি ম’ল॥
২০
কাঁদুনে রে কাঁদুনে কুলতলাতে বাসা।
পরের ছেলে কাঁদবে ব’লে মনে করেছ আশা॥
হাত ভাঙব, পা ভাঙব, করব নদী পার।
সারারাত কেঁদো না রে, জাদু, ঘুমো একবার॥
২১
তালগাছেতে হুতুম্থুমো কান আছে পাঁদারু।
মেঘ ডাকছে ব’লে বুক করছে গুরু গুরু॥
তোমাদের কিসের আনাগোনা।
উড়ে মেড়ার বাপ আসছে দিদিন্ ধিনা ধিনা॥
২২
দোল দোল দোলানি।
কানে দেব চৌদানি॥
কোমরে দেব ভেড়ার টোপ।
ফেটে মরবে পাড়ার লোক॥
মেয়ে নয়কো, সাত বেটা।
গড়িয়ে দেব কোমর-পাটা॥
দেখ্ শত্তুর চেয়ে।
আমার কত সাধের মেয়ে॥
২৩
ইকড়ি মিকড়ি চাম-চিকড়ি, চাম কাটে মজুমদার।
ধেয়ে এল দামুদর॥
দামুদর ছুতরের পো।
হিঙুল গাছে বেঁধে থো॥
হিঙুল করে কড়মড়।
দাদা দিলে জগন্নাথ॥
জগন্নাথের হাঁড়িকুঁড়ি।
দুয়োরে বসে চাল কাঁড়ি॥
চাল কাঁড়তে হল বেলা।
ভাত খাওসে দুপুরবেলা॥
ভাতে পড়ল মাছি।
কোদাল দিয়ে চাঁচি॥
কোদাল হল ভোঁতা।
খা ছুতরের মাথা॥
২৪
উলু কেতু দুলু কেতু নলের বাঁশি।
নল ভেঙেছে একাদশী॥
একা নল পঞ্চদল।
কে যাবি রে কামার-সাগর॥
কামার মাগী কের্কেরানি যেন পাটরানী॥
আক-বন ডাব-বন।
কুড়ি কিষ্টি বেড়াবন॥
কার পেটের দুয়ো।
কার পেটের সুয়ো॥
ব’লে গেছে চড়ুই রাজা
চোরের পেটে চাল-কড়াই-ভাজা॥
কাঠবেড়ালি মদ্দা মাগী কাপড় কেচে দে।
হারদোচ খেলাতে ডুলকি কিনে দে॥
ডুলকির ভিতর পাকা পান।
ছি, হিঁদুর সোয়ামি মোচর্মান॥
এক পাথর কলাপোড়া এক পাথর ঝোল।
নাচে আমার খুকুমণি, বাজা তোরা ঢোল॥
২৫
উলুকুটু ধুলুকুটু নলের বাঁশি।
নল ভেঙেছে একাদশী॥
একা নল পঞ্চদল।
মা দিয়েছে কামারশাল॥
কামার মাগীর ঘুর্ঘুরুনি।
অর্পণ দর্পণ। কুড়ি গুষ্টি ব্রাহ্মণ॥
২৬
রানু কেন কেঁদেছে।
ভিজে কাঠে রেঁধেছে॥
কাল যাব আমি গঞ্জের হাট।
কিনে আনব শুকনো কাঠ॥
তোমার কান্না কেন শুনি।
তোমার শিকেয় তোলা ননি।
তুমি খাও না সারা দিনই॥
২৭
খোকোমণি দুধের ফেনি ডাবলোর ঘি।
খোকোর বিয়ের সময় করব আমি কী॥
সাত মাগী দাসী দেব পায়ে তেল দিতে।
সাত মিন্সে কাহার দেব দুলান দুলাতে॥
সরু ধানের চিঁড়ে দেব নাগর খেলাতে।
রসকরা নাড়ু দেব শাশুড়ি ভুলাতে॥
২৮
খোকো আমাদের সোনা
চার পুখুরের কোণা।
বাড়িতে সেকরা ডেকে মোহর কেটে
গড়িয়ে দেব দানা।
তোমরা কেউ কোরো না মানা॥
২৯
খোকো আমাদের লক্ষ্মী।
গলায় দেব তক্তি॥
কাঁকালে দেব হেলে।
পাক দিয়ে দিয়ে নিয়ে বেড়াব আমাদের ছেলে॥
হিল্লা দিয়ে বেড়াবে যেন বড়ো মানুষের হলে॥
৩০
ধন ধন ধনিয়ে কাপড় দেব বুনিয়ে।
তাতে দেব হীরের টোপ।
ফেটে মরবে পাড়ার লোক॥
৩১
আলতানুড়ি গাছের গুঁড়ি জোড়-পুতুলের বিয়ে।
এত টাকা নিলে বাবা দূরে দিলে বিয়ে।
এখন কেন কান্ছ বাবা গামছা মুড়ি দিয়ে॥
আগে কাঁদে মা বাপ, পাছে কাঁদে পর।
পাড়াপড়সি নিয়ে গেল শ্বশুরদের ঘর॥
শ্বশুরদের ঘরখানি বেতের ছাউনি।
তাতে বসে পান খান দুর্গা ভবানী॥
হেঁই দুর্গা, হেঁই দুর্গা, তোমার মেয়ের বিয়ে।
তোমার মেয়ের বিয়ে দাও ফুলের মালা দিয়ে।
ফুলের মালা গোঁদের ডালা কোন্ সোহাগির বউ।
হীরেদাদার মড়্ মড়ে থান, ঠাকুরদাদার বউ॥
এক বাড়িতে দই দিব্য এক বাড়িতে চিঁড়ে।
এমন ক’রে ভোজন কোরো গোক্ষুনাথের কিরে॥
৩২
হ্যাদে রে কলমি লতা
এতকাল ছিলে কোথা॥
এতকাল ছিলাম বনে।
বনেতে বাগদি ম’ল, আমারে যেতে হল॥
তুমি নেও কলসী কাঁকে, আমি নিই বন্দু হাতে।
চলো যাই রাজপথে–ছেলের মা গয়না গাঁথে॥
ছেলেটি তুড়ুক নাচে॥
৩৩
খোকা যাবে নায়ে, রোদ লাগিবে গায়ে।
লক্ষটাকার মল্মলি থান সোনার চাদর গায়ে॥
তাতে নাল গোলাপের ফুল।
যত বাঙালের মেয়ে দেখে ব্যাকুল॥
সয়দাবাদের ময়দা, কাশিমবাজারের ঘি।
একটু বিলম্ব করো, খোকাকে লুচি ভেজে দি॥
উলোর ভুঁয়ের ময়দারে ময়দাবাদের ঘি।
শান্তিপুরের কড়াই এনে নুচি ভেজে দি॥
৩৪
সুড়্সুড়ুনি গুড়্গুড়ুনি নদী এল বান।
শিবঠাকুর বিয়ে কল্লেন, তিন কন্যে দান॥
এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যে খান।
এক কন্যে না পেয়ে বাপের বাড়ি যান॥
বাপেদের তেল আমলা, মালীদের ফুল–
এমন ক’রে চুল বাঁধব হাজার টাকা মূল॥
হাজারে বাজারে পড়ে পেলাম খাঁড়া।
সেই খাঁড়া দিয়ে কাটলাম নাল কচুর দাঁটা॥
৩৫
খোকাবাবু চৌধুরী
গাঁ পেয়েছে আগুড়ি।
মাছ পেয়েছে পবা॥
আমার খোকামণির বউ ডাকছে।
ভাত খাওসে বাবা॥
৩৬
একবার নাচো চাঁদের কোণা।
আমি মুরলী বাঁধিয়ে দেব যত লাগে সোনা।
আবার তোমার নাচন আমি জানি, জানে না ব্রজাঙ্গনা॥
৩৭
শিব নাচে, ব্রহ্মা নাচে, আর নাচে ইন্দ্র।
গোকুলে গোয়ালা নাচে পাইয়ে গোবিন্দ॥
ক্ষীর-খিরসে ক্ষীরের নাড়ু, মর্তমানের কলা।
নুটিয়ে নুটিয়ে খায় যত গোপের বালা॥
নন্দের মন্দিরে গোয়ালা এল ধেয়ে।
তাদের হাতে নড়ি, কাঁধে ভাঁড়, নাচে থেয়ে থেয়ে॥
৩৮
খোকা নাচে কোন্খানে।
শতদলের মাঝখানে॥
সেখানে খোকা চুল ঝাড়ে–
থোকা থোকা ফুল পড়ে।
তাই নিয়ে খোকা খেলা করে॥
৩৯
অন্নপূর্ণা দুধের সর।
কাল যাব লো পরের ঘর॥
পরের বেটা মারলে চড়।
কানতে কানতে খুড়োর ঘর।
খুড়ো দিলে বুড়ো বর॥
হেঁই খুড়ো তোর পায়ে ধরি
রেখে আায় গে মায়ের বাড়ি॥
মায়ে দিল সরু শাঁখা
বাপে দিল শাড়ি।
ঝপ্ ক’রে মা বিদেয় কর্–
রথ আসছে বাড়ি॥
আগে আয় রে চৌপল–
পিছে যায় রে ডুলি।
দাঁড়া রে কাহার মিন্সে
মাকে স্থির করি॥
মা বড়ো নির্বুদ্ধি কেঁদে কেন মর।
আপুনি ভাবিয়ে দেখো কার ঘর কর॥
৪০
খোকা নাচে বুকের মাঝে।
নাক নিয়ে গেল বোয়াল মাছে॥
ওরে বোয়াল ফিরে আয়।
খোকার নাচন দেখে যা॥
৪১
মাসি পিসি বনকাপাসি, বনের মধ্যে টিয়ে।
মাসি গিয়েছে বৃন্দাবন দেখে আসি গিয়ে॥
কিসের মাসি, কিসের পিসি, কিসের বৃন্দাবন।
আজ হতে জানলাম মা বড়ো ধন॥
মাকে দিলাম শাঁখা শাড়ি, বাপকে দিলাম নীলে ঘোড়া।
ভাইয়ের দিলাম বিয়ে॥
কলসীতে তেল নেইকো, কিবা সাধের বিয়ে।
কলসীতে তেল নেইকো, নাচব থিয়ে থিয়ে॥
৪২
মাসি পিসি বনকাপাসি, বনের মধ্যে ঘর।
কখনো বললি নে মাসি কড়ার নাড়ু ধর্॥
৪৩
খোকো মানিক ধন।
বাড়ি-কাছে ফুলের বাগান তাতে বৃন্দাবন॥
৪৪
কিসের লেগে কাঁদ খোকো কিসের লেগে কাঁদ।
কিবা নেই আমার ঘরে।
আমি সোনার বাঁশি বাঁধিয়ে দেব
মুক্তা থরে থরে॥
৪৫
ওরে আমার সোনা
এতখানি রাতে কেন বেহন-ধান ভানা।
বাড়িতে মানুষ এসেছে তিনজনা।
বাম মাছ রেঁধেলি শোলমাছের পোনা॥
৪৬
কে ধরেছে, কে মেরেছে, কে দিয়েছে গাল।
খোকার গুণের বালাই নিয়ে মরে যেন সে কাল॥
৪৭
কাজল বলে আজল আমি রাঙামুখে যাই–
কালো মুখে গেলে আমার হতমান হয়॥
৪৮
খোকো আমার কী দিয়ে ভাত খাবে।
নদীর কূলে চিংড়িমাছ বাড়ির বেগুন দিয়ে॥
৪৯
খোকো যাবে রথে চড়ে, বেঙ হবে সারথি।
মাটির পুতুল নটর-পটর, পিঁপড়ে ধরে ছাতি।
ছাতির উপর কোম্পানি কোন্ সাহেবের ধন তুমি॥
৫০
খোকো যাবে মাছ ধরিতে গায়ে নাগিবে কাদা।
কলুবাড়ি গিয়ে তেল নেও গে, দাম দেবে তোমার দাদা॥
৫১
খোকো যাবে মাছ ধরিতে ক্ষীরনদীর বিল।
মাছ নয় গুগুলির পেছে উড়ছে দুটো চিল॥
৫২
খোকো যাবে মোষ চরাতে, খেয়ে যাবে কী।
আমার শিকের উপর গমের রুটি তবলা-ভরা ঘি॥
৫৩
খোকো ঘুমো ঘুমো।
তালতলাতে বাঘ ডাকছে দারুণ হুমো॥
৫৪
ঘুমতা ঘুমায় ঘুমতা ঘুমায় গাছের বাকলা।
ষষ্ঠীতলায় ঘুম যায় মস্ত হাতি ঘোড়া॥
ছাইগাদায় ঘুম যায় খেঁকি কুকুর।
খাটপালঙ্গে ঘুম যায় ষষ্ঠীঠাকুর।
আমার কোলে ঘুম যায় খোকোমণি॥
৫৫
আতা গাছে তোতা পাখি, দালিম গাছে মউ।
কথা কও না কেন বউ?–
কথা কব কী ছলে?
কথা কইতে গা জ্বলে॥
৫৬
ও পারে তিল গাছটি
তিল ঝুর ঝুর করে।
তারি তলায় মা আামার
লক্ষ্মী প্রদীপ জ্বালে॥
মা আমার জটাধারী
ঘর নিকুচ্ছেন।
বাবা আমার বুড়োশিব
নৌকা সাজাচ্ছেন॥
ভাই আমার রাজ্যেশ্বর
ঘড়া ডুবাচ্ছেন।
ঐ আসছে প্যাখ্না বিবি
প্যাক্ প্যাক্ প্যাক্
ও দাদা দেখ্ দেখ্ দেখ্॥
৫৭
খোকো আমার ধন ছেলে
পথে বসে বসে কান্ছিলে॥
রাঙা গায়ে ধুলো মাখছিলে
মা ব’লে ধন ডাকছিলে॥
৫৮
খোকা খোকা ডাক পাড়ি।
খোকা গিয়েছে কার বাড়ি॥
আন্ গো তোরা লাল ছড়ি।
খোকাকে মেরে খুন করি॥
৫৯
ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি আমাদের বাড়ি যেয়ো।
খাট নেই, পালঙ্গ নেই, খোকার চোখে বোসো॥
খোকার মা বাড়ি নেই, শুয়ে ঘুম যেয়ো।
মাচার নীচে দুধ আছে, টেনেটুনে খেয়ো॥
নিশির কাপড় খসিয়ে দেব, বাঘের নাচন চেয়ো।
বাটা ভরে পান দেব, দুয়োরে বসে খেয়ো।
খিড়কি দুয়োর কেটে দেব, ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ যেয়ো॥
৬০
খুকিমণি দুধের ফেনি বওগাছের মউ।
হাড়ি-ডুগ্ডুগানি উঠান-ঝাড়নি মণ্ডা-খেকোর বউ॥
৬১
নিদ পাড়ে, নিদ পাড়ে গাছের পাতাড়ি।
ষষ্ঠীতলায় নিদ পাড়ে বুড়ো মাথারি॥
খেড়ো ঘরে নিদ পাড়ে কালা কুকুর।
আমাদের বাড়ি নিদ পাড়ে খোকা ঠাকুর॥
৬২
হরম বিবির খড়ম পায়।
লাল বিবির জুতো পায়॥
চল্ লো বিবি ঢাকা যাই
ঢাকা গিয়ে ফল খাই।
সে ফলের বোঁটা নাই॥
৬৩
ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে আর বিলে।
সুন্দরীরে বিয়া দিলাম ডাকাতের মেলে॥
ডাকাত আলো মা।
পাট কাপড় দিয়ে বেড়ে নিলে
দেখতে দিলে না॥
আগে যদি জানতাম ডুলি ধরে কানতাম॥
৬৪
ইটা কমলের মা লো ভিটা ছেড়ে দে।
তোর ছাওয়ালের বিয়া, বাদ্য এনে দে॥
ছোটো বেলায় খেলাইছিলাম ঘুটি মুছি দিয়া।
মা গালাইছিলেন খুব্রি বলিয়া॥
এখন কেন কাঁদো মা গো ডুলির খুরা ধরে।
পরের পুতে নিয়ে যাবে ডুম্ডুমি বাজিয়ে॥
৬৫
কে রে, কে রে, কে রে!
তপ্ত দুধে চিনির পানা
মণ্ডা ফেলে দে রে॥
৬৬
আয় রে পাখি টিয়ে!
খোকা আমাদের পান খেয়েছে
নজর বাঁধা দিয়ে॥
৬৭
আয় রে পাখি লটকুনা!
ভেজে দিব তোরে বর-বটনা॥
খাবি আর কল্কলাবি।
খোকাকে নিয়ে ঘুম পাড়াবি॥
৬৮
ষষ্ঠী বাছা পানের গোছা
তুলে নাড়া রে।
যে আবাগী দেখতে নারে
পাড়া ছেড়ে যা রে॥
৬৯
ধুলায় ধূসর নন্দকিশোর,
ধুলা মেখেছে গায়।
ধুলা ঝেড়ে কোলে করো
সোনার জাদুরায়॥
৭০
খোকা আমাদের কই–
জলে ভাসে খই।
শুকোলো বাটার পান
অম্বল হল দই॥
৭১
খোকো খোকো ডাক পাড়ি।
খোকো বলে মা শাক তুলি॥
মরুক মরুক শাক তোলা।
খোকো খাবে দুধকলা॥
৭২
আমার খোকো যাবে গাই চরাতে
গায়ের নাম হাসি।
আমি সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দেব
মোহন-চুড়া বাঁশি॥
৭৩
খোকোর আমার নিদন্তের হাসি
আমি বড়োই ভালোবাসি॥
৭৪
খোকো যাবে নায়ে
লাল জুতুয়া পায়ে।
পাঁচ-শো টাকার মল্মলি থান
সোনার চাদর গায়ে॥
তোমরা কে বলিবে কালো।
পাটনা থেকে হলুদ এনে
গা ক’রে দিব আলো॥
৭৫
খোকো ঘুমালে দিব দান
পাব ফুলের ডালি।
কোন্ ঘাটে ফুল তুলেছে
ওরে বনমালী।
চাঁদমুখেতে রোদ লেগেছে,
তুলে ধরো ডালি॥
খোকো আমাদের ধন।
বাড়িতে নটের বন।
বাহির-বাড়ি ঘর করেছি,
সোনার সিংহাসন॥
৭৬
আয় ঘুম আয় কলাবাগান দিয়ে–
হৈঁড়ে-পানা মেঘ করেছে।
লখার মা নথ পরেছে কপাল ফুটো ক’রে।
আমানি খেতে দাঁত ভেঙেছে।
সিঁদুর পরবে কিসে॥
৭৭
খোকোমণির বিয়ে দেব হটমালার দেশে।
তারা গাই বলদে চষে।
তারা হীরেয় দাঁত ঘষে।
রুই মাছ পালঙের শাক ভারে ভারে আসে॥
খোকোর দিদি কোণায় বসে আছে।
কেউ দুটি চাইতে গেলে, বলে, আর কি আমার আছে॥
৭৮
এত টকা নিলে বাবা ছাঁদ্লাতলায় বসে।
এখন কেন কাঁদ বাবা গামছা মুখে দিয়ে॥
আমরা যাব পরের ঘরে পর-অধীন হয়ে।
পরের বেটী মুখ করবে মুখ নাড়া দিয়ে।
দুই চক্ষের জল পড়বে বসুধারা দিয়ে॥
৭৯
ও পারে দুটো শিয়াল চন্দন মেখেছে।
কে দেখেছে, কে দেখেছে, দাদা দেখেছে॥
দাদার হাতের লাল নাঠিখান ফেলে মেরেছে।
দুই দিকে দুই কাৎলা মাছ ভেসে উঠেছে॥
একটা নিলে কিঁয়ের মা একটা নিলে কিঁয়ে।
ঢোকুম্ কুম্ বাজনা বাজে, অকার মার বিয়ে॥
৮০
ওই আসছে খোঁড়া জামাই ডিং ডিং বাজিয়ে।
ক্ষীরের হাঁড়িতে দই প’ল, ছাই খাক্ সে॥
হাঁড়ায় আছে কাৎলা মাছ, ধরে আন্ গে।
দুই দিকে দুই কাৎলা মাছ ভেসে উঠেছে॥
একটি নিলেন গুরুঠাকুর একটি নিলে টিয়ে।
টিয়ের মার বিয়ে লাল গামছা দিয়ে॥
লাল গামছায় হল নাকো, তসর এনে দে।
তসর করে মসর-মসর, শাড়ি এনে দে।
শাড়ির ভারে উঠতে নারি, শালারা কাঁদে॥
৮১
আলুর পাতায় ছালুরে ভাই ভেল্লা পাতায় দই।
সকল জামাই এল রে আমার খোঁড়া জামাই কই॥
ওই আসছে খোঁড়া জামাই টুঙটুঙি বাজিয়ে।
ভাঙা ঘরে শুতে দিলাম ইঁদুরে নিল কান।
কেঁদো না কেঁদো না জামাই গোরু দিব দান।
সেই গোরুটার নাম থুইয়ো পুণ্যবতীর চাঁদ॥