যুবতী, ক্যান্ বা কর মন ভারী।
পাবনা থ্যাহে আন্যে দেব ট্যাহা-দামের মোটরি॥
ভরা বর্ষার জলপ্লাবনের উপর যখন নিঃশব্দে সূর্য অস্ত যাইতেছে এ গানটি ঠিক তখনকার উপযুক্ত কি না সে সম্বন্ধে পাঠকমাত্রেরই সন্দেহ হইতে পারে, কিন্তু গানের এই দুটি চরণে সেই শৈবালবিকীর্ণ জলমরুর মাঝখান হইতে সমস্ত গ্রামগুলি যেন কথা কহিয়া উঠিল। দেখিলাম, এই গোয়ালঘরের পাশে, এই কুলগাছের ছায়ায়, এখানেও যুবতী মন-ভারী করিয়া থাকেন এবং তাঁহার রোষারুণ কুটিল কটাক্ষপাতে গ্রাম্য কবির কবিতা ছন্দে-বন্ধে-সুরে-তালে মাঠে-ঘাটে জলে-স্থলে জাগিয়া উঠিতে থাকে।
জগতে যতপ্রকার দুর্বিপাক আছে যুবতীচিত্তের বিমুখতা তাহার মধ্যে অগ্রগণ্য; সেই দুর-গ্রহ-শান্তির জন্য কবিরা ছন্দোরচনা এবং প্রিয়প্রসাদবঞ্চিত হতভাগ্যগণ প্রাণপাত পর্যন্ত করিতে প্রস্তুত। কিন্তু যখন গানের মধ্যে শুনিলাম “পাবনা থেকে আনি দিব টাকা দামের মোটরি’, তখন ক্ষণকালের জন্য মনের মধ্যে বড়ো একটা আশ্বাস অনুভব করা গেল। মোটরি পদার্থটি কি তাহা ঠিক জানি না, কিন্তু তাহার মূল্য যে এক টাকার বেশি নহে কবি তাহাতে সন্দেহ রাখেন নাই। জগতের এক প্রান্তে পাবনা জিলায় যে এমন একটা স্থান আছে যেখানে প্রতিকূল প্রণয়িনীর জন্য অসাধ্যসাধন করিতে হয় না, পাবনা অপেক্ষা দুর্গম স্থানে যাইতে এবং “মোটরি’ অপেক্ষা দুর্লভ পদার্থ সংগ্রহ করিতে হয় না, ইহা মনে করিলে ভবযন্ত্রণা অপেক্ষাকৃত সুসহ বলিয়া বোধ হয়। কালিদাস ভবভূতি প্রভৃতি প্রথম শ্রেণীর কবিরা এমন স্থলে নিশ্চয়ই মানসসরোবরের স্বর্ণপদ্ম, আকাশের তারা এবং নন্দনকাননের পারিজাত অম্লানমুখে হাঁকিয়া বসিতেন। এবং উজ্জয়িনীর প্রথম শ্রেণীর যুবতীরা শিখরিণী ও মন্দাক্রান্তাচ্ছন্দে এমন দুঃসাধ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তাবমাত্র শুনিলে প্রসন্ন না হইয়া থাকিতে পারিতেন না।
অন্তত কাব্য পড়িয়া এইরূপ ভ্রম হয়। কিন্তু অবিশ্বাসী গদ্যজীবী লোকেরা এতটা কবিত্ব বিশ্বাস করে না। শুদ্ধমাত্র মন্ত্রপাঠের দ্বারা একপাল ভেড়া মারা যায় কি না এ প্রশ্নের উত্তরে ভল্টেয়ার বলিয়াছেন, যায়, কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে আর্সেনিক বিষও থাকা চাই। মন-ভারী-করা যুবতীর পক্ষে আকাশের তারা, নন্দনের পারিজাত এবং প্রাণসমর্পণের প্রস্তাব সন্তোষজনক হইতে পারে; কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই তাহার সঙ্গে সঙ্গে বাজুবন্ধ বা চরণচক্রের প্রয়োজন হয়। কবি ঐ কথাটা চাপিয়া যান; তিনি প্রমাণ করিতে চান যে, কেবল মন্ত্রবলে, কেবল ছন্দ এবং ভাবের জোরেই কাজ সিদ্ধ হয়–অলংকারের প্রয়োজন হইতে পারে, কিন্তু তাহা কাব্যালংকারের। এ দিকে আমাদের পাবনার জনপদবাসিনীরা কাব্যের আড়ম্বর বাহুল্য জ্ঞান করেন এবং তাঁহাদের চিরানুরক্ত গ্রামবাসী কবি মন্ত্রতন্ত্র বাদ দিয়া একেবারেই সোজা টাকা-দামের মোটরির কথাটা পাড়িয়া বসেন, সময় নষ্ট করেন না।
তবু একটা ছন্দ এবং একটা সুর চাই। এই জগৎপ্রান্তে এই পাবনা জিলার বিলের ধারেও তাহার প্রয়োজন আছে। তাহাতে করিয়া ঐ মোটরির দাম এক টাকার চেয়ে অনেকটা বাড়িয়া যায়। ঐ মোটরিটাকে রসের এবং ভাবের পরশ-পাথর ছোঁওয়াইয়া দেওয়া হয়। গানের সেই দুটো লাইনকে প্রচলিত গদ্যে বিনা সুরে বলিলে তাহার মধ্যে যে-একটি রূঢ় দৈন্য আসিয়া পড়ে, ছন্দে সুরে তাহা নিমেষের মধ্যে ঘুচিয়া যায়, সংসারের প্রতিদিনের ধূলিস্পর্শ হইতে ঐ ক’টি তুচ্ছ কথা ভাবের আবরণে আবৃত হইয়া উঠে।
মানুষের পক্ষে ইহার একটা একান্ত প্রয়োজন আছে। যে-সকল সাংসারিক ব্যাপারের দ্বারা সে সর্বদা ঘনিষ্ঠভাবে পরিবৃত তাহাকে সে ছন্দে লয়ে মণ্ডিত করিয়া তাহার উপর নিত্যসৌন্দর্যময় ভাবের রশ্মিপাত করিয়া দেখিতে চায়।
সেইজন্য জনপদে যেমন চাষবাষ এবং খেয়া চলিতেছে, সেখানে কামারের ঘরে লাঙলের ফলা, ছুতারের ঘরে ঢেঁকি এবং স্বর্ণকারের ঘরে টাকা-দামের মোটরি নির্মাণ হইতেছে, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে একটা সাহিত্যের গঠনকার্যও চলিতেছে–তাহার বিশ্রাম নাই। প্রতিদিন যাহা বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন খণ্ডখণ্ড ভাবে সম্পন্ন হইতেছে সাহিত্য তাহাকে ঐক্যসূত্রে গাঁথিয়া নিত্যকালের জন্য প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করিতেছে। গ্রামের মধ্যে প্রতিদিনের বিচিত্র কাজও চলিতেছে এবং তাহার ছিদ্রে ছিদ্রে চির-দিনের একটা রাগিনী বাজিয়া উঠিবার জন্য নিয়ত প্রয়াস পাইতেছে।
পদ্মা বাহিয়া চলিতে চলিতে বালুচরের মধ্যে যখন চকাচকীর কলরব শুনা যায় তখন তাহাকে কোকিলের কুহুতান বলিয়া কাহারো ভ্রম হয় না, তাহাতে পঞ্চম মধ্যম কড়িকোমল কোনোপ্রকার সুর ঠিকমত লাগে না ইহা নিশ্চয়, কিন্তু তবু ইহাকে পদ্মাচরের গান বলিলে কিছুই অসংগত হয় না। কারণ, ইহাতে সুর বেসুর যাহাই লাগুক, সেই নির্মল নদীর হাওয়ায় শীতের রৌদ্রে, অসংখ্য প্রাণীর জীবনসুখ-সম্ভোগের আনন্দধ্বনি বাজিয়া উঠে।
গ্রাম্যসাহিত্যের মধ্যেও কল্পনার তান অধিক থাক্ বা না থাক্ সেই আনন্দের সুর আছে। গ্রামবাসীরা যে জীবন প্রতিদিন ভোগ করিয়া আসিতেছে, যে কবি সেই জীবনকে ছন্দে তালে বাজাইয়া তোলে সে কবি সমস্ত গ্রামের হৃদয়কে ভাষা দান করে। পদ্মাচরের চক্রবাক সংগীতের মতো, তাহা নিখুঁত সুরতালের অপেক্ষা রাখে না। মেঘ-দূতের কবি অলকা পর্যন্ত গিয়াছেন, তিনি উজ্জয়িনীর রাজসভার কবি; আমাদের অখ্যাত গানের কবি কঠিন দায়ে পড়িয়াও পাবনা শহরের বেশি অগ্রসর হইতে পারে নাই–যদি পারিত, তবে তাহার গ্রামের লোক তাহার সঙ্গ ত্যাগ করিত। কল্পনার সংকীর্ণতা-দ্বারাই সে আপন প্রতিবেশীবর্গকে ঘনিষ্ঠসূত্রে বাঁধিতে পারিয়াছে, এবং সেই কারণেই তাহার গানের মধ্যে কল্পনাপ্রিয় একক কবির নহে, পরন্তু সমস্ত জনপদের হৃদয় কলরবে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে।