ইহার মধ্যে বিশেষ করিয়া বাংলার গ্রামদৃশ্য গৃহচিত্র কিছুই নাই। গোয়ালিনীরা যেরূপ সাজে নূপুর-কিংকিণী বাজাইয়া দধি-মাথায় বাছুর-কোলে বনপথ দিয়া চলিয়াছে তাহা বাংলার গ্রামপথে প্রত্যহ, অথবা কদাচিৎ, দেখিতে পাওয়া যায় না। রাখালেরা মাঠের মধ্যে বটচ্ছায়ায় অনেকরকম খেলা করে, কিন্তু ফুল লইয়া তাহাদের ও তাহাদিগকে লইয়া ফুলের এমন মাতামাতি শুনা যায় না। এ-সমস্ত ভাবের সৃষ্টি। কৃষ্ণরাধার বিরহ-মিলন সমস্ত বিশ্ববাসীর বিরহ-মিলনের আদর্শ; ইহার মধ্যে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মণসমাজ বা মনুসংহিতা নাই, ইহার আাগাগোড়া রাখালি কাণ্ড। যেখানে সমাজ বলবান্ সেখানে বৃন্দাবনের গোচারণের সঙ্গে মথুরার রাজ্যপালনের একাকার হওয়া অত্যন্ত অসংগত। কিন্তু কৃষ্ণ-রাধার কাহিনী যে ভাবলোকে বিরাজ করিতেছে সেখানে ইহার কোনো কৈফিয়ত আবশ্যক করে না। এমন-কি, সেখানে চিরপ্রচলিত সমস্ত সমাজপ্রথাকে অতিক্রম করিয়া বৃন্দাবনের রাখালবৃত্তি মথুরার রাজত্ব অপেক্ষা অধিকতর গৌরবজনক বলিয়া সপ্রমাণ হইয়াছে। আমাদের দেশে, যেখানে কর্মবিভাগ শাস্ত্রশাসন এবং সামাজিক উচ্চনীচতার ভাব সাধারণের মনে এমন দৃঢ়বদ্ধমূল সেখানে কৃষ্ণরাধার কাহিনীতে এইপ্রকার আচারবিরুদ্ধ বন্ধনবিহীন ভাবের স্বাধীনতা যে কত বিস্ময়কর তাহা চিরাভ্যাসক্রমে আমরা অনুভব করি না।
কৃষ্ণ মথুরায় রাজত্ব করিতে গেলে রাধিকা কাঁদিয়া কহিলেন–
আর কি এমন ভাগ্য হবে ব্রজে আসবে হরি।
সে গিছে মথুরাপুরী, মিথ্যে আশা করি॥
রাজাকে পুনরায় রাখাল করিবার আশা দুরাশা, এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে। কিন্তু বৃন্দা বৃন্দাবনের আসল কথা বোঝে, সে জানে নিরাশ হইবার কোনো কারণ নাই। সে জানে বৃন্দাবন-মথুরায় কাশী-কাঞ্চীর নিয়ম ঠিক খাটে না।
বৃন্দে বলে আমি যদি এনে দিতে পারি
তবে মোরে কী ধন দিবে বলো তো কিশোরী॥
শুনে বাণী কমলিনী যেন পড়িল ধন্দে–
দেহপ্রাণ করেছে দান কৃষ্ণপদারবিন্দে।
এক কালেতে যাঁক সঁপেছি বিরাগ হলেন তাই।
যম-সম কোনো দেবতা রাধিকার নাই॥
ইহা বই নিশ্চয় কই কোথা পাব ধন।
মোর কেবল কৃষ্ণনাম অঙ্গের ভূষণ।
রাজার নন্দিনী মোরা প্রেমের ভিখারি।
বঁধুর কাছে সেই ধন লয়ে দিতে পারি।
বলছে দূতী শোন্ শ্রীমতী মিলবে শ্যামের সাথে।
তখন দুজনের দুই যুগল চরণ তাই দিয়ো মোর মাথে॥
এই পুরস্কারের কড়ার করাইয়া লইয়া দূতী বাহির হইলেন। যমুনা পার হইয়া পথের মধ্যে–
হাস্যরসে একজনকে জিজ্ঞাসিলেন তবে।
কও দেখি কার অধিকারে বসত কর সবে॥
সে লোক বললে তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্ররায়।
মেঘের ধারা রৌদ্রে যেমন লাগল দূতীর গায়॥
ননিচোরা রাখাল ছোঁড়া ঠাট করেছে আসি।
চোর বিনে তাকে কবে ডাকছে গোকুলবাসী॥
কৃষ্ণের এই রায়বাহাদুর খেতাবটি দূতীর কাছে অত্যন্ত কৌতুকাবহ বোধ হইল। কৃষ্ণচন্দ্ররায়! এ তো আসল নাম নয়। এ কেবল মূঢ় লোকদিগকে ভুলাইবার একটা আড়ম্বর। আসল নাম বৃন্দা জানে।
চললেন শেষে কাঙাল বেশে উতরিলেন দ্বারে।
হুকুম বিনে রাত্রিদিনে কেউ না যেতে পারে॥
বহুকষ্টে হুকুম আনাইয়া “বৃন্দাদূতী গেল সভার মাঝে’।
সম্ভাষণ করি দূতী থাকল কতক্ষণ।
একদৃষ্টে চেয়ে দেখে কৃষ্ণের বদন॥
ধড়াচূড়া ত্যাগ করিয়ে মুকুট দিয়েছ মাথে।
সব অঙ্গে রাজ-আভরণ, বংশী নাইকো হাতে॥
সোনার মালা কণ্ঠহার বাহুতে বাজুবন্ধ।
শ্বেত চামরে বাতাস পড়ে দেখে লাগে ধন্দ॥
নিশান উড়ে, ডঙ্কা মারে, বলছে খবরদার।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘটা ব্যবস্থা বিচার॥
আর এক দরখাস্ত করি শুন দামোদর।
যমুনাতে দেখে এলেম এক তরী মনোহর॥
শূন্য হয়ে ভাসছে তরী ওই যমুনাতীরে।
কাণ্ডারী-অভাবে নৌকা ঘাটে ঘাটে ফিরে॥
পূর্বে এক কাণ্ডারী ছিল সর্বলোকে কয়।
সে চোর পালালো কোথা তাকে ধরতে হয়॥
শুনতে পেলেম হেথা এলেম মথুরাতে আছে।
হাজির না হয় যদি জানতে পাবে পাছে।
মেয়ে হয়ে কয় কথা, পুরুষের ডরায় গা।
সভাশুদ্ধ নিঃশব্দ, কেউ না করে রা–।
ব্রজপুরে ঘর-বসতি মোর।
ভাণ্ড ভেঙে ননি খেয়ে পলায়েছে চোর॥
চোর ধরিতে এই সভাতে আসছে অভাগিনী।
কেমন রাজা বিচার করো জানব তা এখনি॥
বৃন্দা কৃষ্ণচন্দ্ররায়ের রাজসম্মান রক্ষা করিয়া ঠিক দস্তুরমত কথাগুলি বলিল, অন্তত কবির রিপোর্ট্ দৃষ্টে তাহাই বোধ হয়। তবে উহার মধ্যে কিছু স্পর্ধাও ছিল; বৃন্দা মথুরার উপরে আপন বৃন্দাবনের দেমাক ফলাইতে ছাড়ে নাই। “হাজির না হয় যদি জানতে পাবে পাছে’ এ কথাটা খুব চড়া কথা; শুনিয়া সভাস্থ সকলে নিঃশব্দ হইয়া গেল। মথুরার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায় কহিলেন–
ব্রজে ছিলে বৃন্দা দাসী বুঝি অনুমানে।
কোন্দিন বা দেখাসাক্ষাৎ ছিল বৃন্দাবনে॥
তখন বৃন্দা কচ্ছেন, কী জানি তা হবে কদাচিৎ।
বিষয় পেলে অনেক ভোলে মহতের রীত॥
কৃষ্ণ বৃন্দাবনের কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করিলে বৃন্দা কহিলেন–
হাতে ননি ডাকছে রানী গোপাল কোথা রয়।
ধেনু বৎস আদি তব তৃণ নাহি খায়॥
শতদল ভাসতেছে সেই সমুদ্রমাঝে।
কোন্ ছার ধুতুরা পেয়ে এত ডঙ্কা বাজে॥
মথুরার রাজত্বকে বৃন্দা ধুতুরার সহিত তুলনা করিল; তাহাতে মত্ততা আছে, কিন্তু বৃন্দাবনের সৌন্দর্য ও সুগন্ধ কোথায়?
বলা বাহুল্য ইহার পর বৃন্দার দৌত্য ব্যর্থ হয় নাই।–
দূতী কৃষ্ণ লয়ে বিদায় হয়ে ব্রজপুরে এল।
পশুপক্ষী আদি যত পরিত্রাণ পেল॥
ব্রজের ধন্য লতা তমাল পাতা ধন্য বৃন্দাবন।
ধন্য ধন্য রাধাকৃষ্ণের যুগলমিলন॥
বাংলার গ্রাম্যছড়ায় হরগৌরী এবং রধাকৃষ্ণের কথা ছাড়া সীতারাম ও রাম-রাবণের কথাও পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা তুলনায় স্বল্প। এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে, পশ্চিমে, যেখানে রামায়ণকথাই সাধারণের মধ্যে বহুলপরিমাণে প্রচলিত সেখানে বাংলা অপেক্ষা পৌরুষের চর্চা অধিক। আমাদের দেশে হরগৌরীকথায় স্ত্রী-পুরুষ এবং রাধাকৃষ্ণকথায় নায়ক-নায়িকার সম্বন্ধ নানারূপে বর্ণিত হইয়াছে; কিন্তু তাহার প্রসর সংকীর্ণ, তাহাতে সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বের খাদ্য পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে রাধাকৃষ্ণের কথায় সৌন্দর্যবৃত্তি এবং হরগৌরীর কথায় হৃদয়বৃত্তির চর্চা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে ধর্মপ্রবৃত্তির অবতারণা হয় নাই। তাহাতে বীরত্ব, মহত্ত্ব, অবিচলিত ভক্তি ও কঠোর ত্যাগস্বীকারের আদর্শ নাই। রামসীতার দাম্পত্য আমাদের দেশপ্রচলিত হরগৌরীর দাম্পত্য অপেক্ষা বহুতরগুণে শ্রেষ্ঠ, উন্নত এবং বিশুদ্ধ; তাহা যেমন কঠোর গম্ভীর তেমনি স্নিগ্ধ কোমল। রামায়ণকথায় এক দিকে কর্তব্যের দুরূহ কাঠিন্য অপর দিকে ভাবের অপরিসীম মাধুর্য একত্র সম্মিলিত। তাহাতে দাম্পত্য, সৌভ্রাত্র, পিতৃভক্তি, প্রভুভক্তি, প্রজাবাৎসল্য প্রভৃতি মনুষ্যের যত প্রকার উচ্চ অঙ্গের হৃদয়বন্ধন আছে তাহার শ্রেষ্ঠ আদর্শ পরিস্ফুট হইয়াছে। তাহাতে সর্বপ্রকার হৃদ্বৃত্তিকে মহৎধর্মনিয়মের দ্বারা পদে পদে সংযত করিবার কঠোর শাসন প্রচারিত। সর্বতোভাবে মানুষকে মানুষ করিবার উপযোগী এমন শিক্ষা আর কোনো দেশে কোনো সাহিত্যে নাই। বাংলাদেশের মাটিতে সেই রামায়ণকথা হরগৌরী ও রাধাকৃষ্ণের কথার উপরে যে মাথা তুলিয়া উঠিতে পারে নাই তাহা আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। রামকে যাহারা যুদ্ধক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নরদেবতার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে তাহাদের পৌরুষ কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধর্মপরতার আদর্শ আমাদের অপেক্ষা উচ্চতর।