ভেবে ভোলা হেসে কন শুন হে পার্বতী
আমি তো কড়ার ভিখারি ত্রিপুরারি শঙ্খ পাব কথি॥
হাতের শিঙাটা বেচলে পরে হবে না
একখানা শঙ্খের কড়ি।
বলদটা মূল করিলে হবে কাহনটেক কড়ি॥
এটি ওটি ঠাক ঠিকাটি চাও হে গৌরী
থাকলে দিতে পারি।
তোমার পিতা আছে বটে অর্থের অধিকারী।
সে কি দিতে পারে না দুমুটো শঙ্খের মুজুরি॥
এই-যে ধনহীনতার ভড়ং এটা মহাদেবের নিতান্ত বাড়াবাড়ি, স্ত্রীজাতির নিকট ইহা স্বভাবতই অসহ্য। স্ত্রী যখন ব্রেস্লেট প্রার্থনা করে কেরানিবাবু তখন আয়ব্যয়ের সুদীর্ঘ হিসাব বিশ্লেষণ করিয়া আপন দারিদ্র্য প্রমাণ করিতে বসিলে কোন্ ধর্মপত্নী তাহা অবিচলিত রসনায় সহ্য করিতে পারে। বিশেষত শিবের দারিদ্র্য ওটা নিতান্তই পোশাকি দারিদ্র্য, তাহা কেবল ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ সকলের উপরে টেক্কা দিবার জন্য, কেবল লক্ষ্মীর জননী অন্নপূর্ণার সহিত একটা অপরূপ কৌতুক করিবার অভিপ্রায়ে। কালিদাস শংকরের অট্টহাস্যকে কৈলাসশিখরের ভীষণ তুহিনপুঞ্জের সহিত তুলনা করিয়াছেন। মহেশ্বরের শুভ্র দারিদ্র্যও তাঁহার এক নিঃশব্দ অট্টহাস্য। কিন্তু দেবতার পক্ষেও কৌতুকের একটা সীমা আছে। মহাদেবী এ সম্বন্ধে নিজের মনের ভাব যেরূপে ব্যক্ত করিলেন তাহা অত্যন্ত স্পষ্ট। তাহাতে কোনো কথাই ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রহিল না।
গৌরী গর্জিয়ে কন ঠাকুর শিবাই
আমি গৌরী তোমার হাতে শঙ্খ পরতে চাই॥
আপনি যেমন যুব্-যুবতী অমনি যুবক পতি হয়
তবে সে বৈরস রস, নইলে কিছুই নয়॥
আপনি বুড়ো আধবয়সী ভাঙধুতুরায় মত্ত
আপনার মতো পরকে বলে মন্দ॥
এইখানে শেষ হয় নাই–ইহার পরে দেবী মনের ক্ষোভে আরো দুই-চারটি যে কথা বলিয়াছেন তাহা মহাদেবের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্বন্ধে, তাহা সাধারণ্যে প্রকাশযোগ্য নহে। সুতরাং আমরা উদ্ধৃত করিতে ক্ষান্ত হইলাম। ব্যাপারটা কেবল এইখানেই শেষ হইল না; স্ত্রীর রাগ যতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে, অর্থাৎ বাপের বাড়ি পর্যন্ত, তাহা গেল।
কোলে করি কার্তিক হাঁটায়ে লম্বোদরে
ক্রোধ করি হরের গৌরী গেলা বাপের ঘরে॥
এ দিকে শিব তাঁহার সংকল্পিত দাম্পত্য-প্রহসনের নেপথ্যবিধান শুরু করিলেন–
বিশ্বকর্মা এনে করান শঙ্খের গঠন।
শঙ্খ লইয়া শাঁখারি সাজিয়া বাহির হইলেন–
দুইবাহু শঙ্খ নিলেন নাম শ্রীরাম লক্ষ্ণণ।
কপটভাবে হিমালয়ে তলাসে ফেরেন॥
হাতে শূলী কাঁখে থলি শম্ভু ফেরে গলি গলি।
শঙ্খ নিবি শঙ্খ নিবি এই কথাটি ব’লে॥
সখীসঙ্গে বসে গৌরী আছে কুতূহলে।
শঙ্খ দেখি শঙ্খ দেখি এই কথাটি বলে॥
গৌরীকে দেখায়ে শাঁখারি শঙ্খ বার ক’ল্ল।
শঙ্খের উপরে যেন চন্দ্রের উদয় হল॥
মণি মুকুতা-প্রবাল-গাঁথা মাণিক্যের ঝুরি।
নব ঝলকে ঝলছে যেন ইন্দ্রের বিজুলি॥
দেবী খুশি হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–
শাঁখারি ভালো এনেছ শঙ্খ।
শঙ্খের কত নিবে তঙ্ক॥
দেবীর লুব্ধভাব দেখিয়া চতুর শাঁখারি প্রথমে দর-দামের কথা কিছুই আালোচনা করিল না; কহিল–
গৌরী,
ব্রহ্মলোক, বৈকুণ্ঠ, হরের কৈলাস, এ তো সবাই কয়।
বুঝে দিলেই হয়।
হস্ত ধুয়ে পরো শঙ্খ, দেরি উচিত নয়॥
শাঁখারি মুখে মুখে হরের স্থাবর সম্পত্তির যেরূপ ফর্দ দিল তাহাতে শাঁখাজোরা বিশেষ সস্তায় যাইবে মহাদেবীর এমন মনে করা উচিত ছিল না।
গৌরী আর মহাদেবে কথা হল দড়।
সকল সখী বলে দুর্গা শঙ্খ চেয়ে পরো॥
কেউ দিলেন তেল গামছা কেউ জলের বাটি।
দেবের ঊরুতে হস্ত থুয়ে বসলেন পার্বতী॥
দয়াল শিব বলেন, শঙ্খ আমার কথাটি ধরো–
দুর্গার হাতে গিয়ে শঙ্খ বজ্র হয়ে থাকো॥
শিলে নাহি ভেঙো শঙ্খ, খড়েগ নাহি ভাঙো।
দুর্গার সহিত করেন বাক্যের তরঙ্গ॥
এ কথা শুনিয়া মাতা মনে মনে হাসে।
শঙ্খ পরান জগৎপিতা মনের হরষে॥
শাঁখারি ভালো দিলে শঙ্খ মানায়ে।
ভাণ্ডার ভেঙে দেইগে তঙ্ক, লওগে গনিয়ে॥
এতক্ষণে শাঁখারি সময় বুঝিয়া কহিল–
আমি যদি তোমার শঙ্খের লব তঙ্ক।
জ্ঞেয়াত-মাঝারে মোর রহিবে কলঙ্ক॥
ইহারা যে বংশের শাঁখারি তাঁহাদের কুলাচার স্বতন্ত্র; তাঁহাদের বিষয়বুদ্ধি কিছুমাত্র নাই; টাকাকড়ি সম্বন্ধে বড়ো নিস্পৃহ; ইঁহারা যাঁহাকে শাঁখা পরান তাঁহাকে পাইলেই মূল্যের আর কোনোপ্রকার দাবি রাখেন না। ব্যবসায়টি অতি উত্তম।
কেমন কথা কও শাঁখারি কেমন কথা কও।
মানুষ বুঝিয়া শাঁখারি এ-সব কথা কও॥
শাঁখারি কহিল–
না করো বড়াই দুর্গা না করো বড়াই।
সকল তত্ত্ব জানি আমি এই বালকের ঠাঁই॥
তোমার পতি ভাঙড় শিব তা তো আমি জানি।
নিতি নিতি প্রতি ঘরে ভিক্ষা মাগেন তিনি॥
ভস্মমাখা তায় ভুজঙ্গ মাথে অঙ্গে।
নিরবধি ফেরেন তিনি ভূত-পেরেতের সঙ্গে॥
ইহাকেই বলে শোধ তোলা! নিজের সম্বন্ধে যে-সকল স্পষ্ট ভাষা মহাদেব সহধর্মিণীরই মুখ হইতে মধ্যে মধ্যে শুনিয়া আসিয়াছেন, অদ্য সুযোগমত সেই সত্য কথাগুলিই গৌরীর কানে তুলিলেন।
এই কথা শুনিয়া মায়ের রোদন বিপরীত।
বাহির করতে চান শঙ্খ না হয় বাহির॥
পাষাণ আনিল চণ্ডী, শঙ্খ না ভাঙিল।
শঙ্খেতে ঠেকিয়া পাষাণ খণ্ড খণ্ড হল॥
কোনোরূপে শঙ্খ যখন না হয় কর্তন।
খড়গ দিয়ে হাত কাটিতে দেবীর গেল মন॥
হস্ত কাটিলে শঙ্খে ভরিবে রুধিরে।
রুধির লাগিলে শঙ্খ নাহি লব ফিরে॥
মেনকা গো মা,
কী কুক্ষণে বাড়াছিলাম পা॥
মরিব মরিব মা গো হব আত্মঘাতী।
আপনার গলে দিব নরসিংহ কাতি॥
অবশেষে অন্য উপায় না দেখিয়া দুর্গা ধূপদীপনৈবেদ্য লইয়া ধ্যানে বসিলেন।