ভাষার অন্তরে একটা প্রকৃতিগত অভিরুচি আছে, সে সম্বন্ধে যাঁদের আছে সহজ বোধশক্তি, ভাষাসৃষ্টি-কার্যে তাঁরা স্বতই এই রুচিকে বাঁচিয়ে চলেন, একে ক্ষুণ্ন করেন না। সংস্কৃতশাস্ত্রে বিদ্যাসাগরের ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। এইজন্য বাংলা ভাষার নির্মাণকার্যে সংস্কৃত ভাষার ভাণ্ডার থেকে তিনি যথোচিত উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু উপকরণের ব্যবহারে তাঁর শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ ছিল। তাই তাঁর আহরিত সংস্কৃত শব্দের সবগুলিই বাংলা ভাষা সহজে গ্রহণ করেছে, আজ পর্যন্ত তার কোনোটিই অপ্রচলিত হয়ে যায় নি। বস্তুত পাণ্ডিত্য উদ্ধত হয়ে উঠে তাঁর সৃষ্টিকার্যের ব্যাঘাত করতে পারে নি। এতেই তাঁর ক্ষমতার বিশেষ গৌরব। তিনি বাংলা ভাষার মূর্তি নির্মাণের সময় মর্যাদারক্ষার প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন ধ্বনি-হিল্লোলের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিস্তর নূতন সংস্কৃত শব্দ অভিধান থেকে সংকলন করেছিলেন। অসামান্য কবিত্বশক্তি সত্ত্বেও সেগুলি তাঁর নিজের কাব্যের অলংকৃতিরূপেই রয়ে গেল, বাংলা ভাষার জৈব উপাদানরূপে স্বীকৃত হল না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের দান বাংলা ভাষার প্রাণ-পদার্থের সঙ্গে চিরকালের মতো মিলে গেছে, কিছুই ব্যর্থ হয় নি।
শুধু তাই নয়। যে গদ্যভাষারীতির তিনি প্রবর্তন করেছেন, তার ছাঁদটি বাংলা ভাষায় সাহিত্যরচনা-কার্যের ভূমিকা নির্মাণ করে দিয়েছে। অথচ যদিও তাঁর সমসাময়িক ঈশ্বর গুপ্তের মতো রচয়িতার গদ্যভঙ্গির অনুকরণে তখনকার অনেক বিশিষ্ট সাহিত্যিক আপন রচনার ভিত গাঁথছিলেন, তবু সে আজ ইতিহাসের অনাদৃত নেপথ্যে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। তাই আজ বিশেষ করে মনে করিয়ে দেবার দিন এল যে, সৃষ্টিকর্তারূপে বিদ্যাসাগরের যে স্মরণীয়তা আজও বাংলা ভাষার মধ্যে সজীব শক্তিতে সঞ্চারিত তাকে নানা নব নব পরিণতির অন্তরাল অতিক্রম করে সম্মানের অর্ঘ্য নিবেদন করা বাঙালির নিত্যকৃত্যের মধ্যে যেন গণ্য হয়। সেই কর্তব্যপালনের সুযোগ ঘটাবার জন্যে বিদ্যাসাগরের জন্মপ্রদেশে এই যে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সর্বসাধারণের উদ্দেশে আমি তার দ্বার উদ্ঘাটন করি। পুণ্যস্মৃতি বিদ্যাসাগরের সম্মাননার অনুষ্ঠানে আমাকে যে সম্মানের পদে আহ্বান করা হয়েছে, তার একটি বিশেষ সার্থকতা আছে। কারণ এইসঙ্গে আমার স্মরণ করবার এই উপলক্ষ ঘটল যে, বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি, একদা তার দ্বার উদ্ঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
এখনো আমার সম্মাননিবেদন সম্পূর্ণ হয় নি। সব শেষের কথা উপসংহারে বলতে চাই। প্রাচীন আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের বংশে বিদ্যাসাগরের জন্ম, তবু আপন বুদ্ধির দীপ্তিতে তাঁর মধ্যে ব্যক্ত হয়েছিল আনুষ্ঠানিকতার বন্ধন-বিমুক্ত মন। সেই স্বাধীনচেতা তেজস্বী ব্রাহ্মণ যে অসামান্য পৌরুষের সঙ্গে সমাজের বিরুদ্ধতাকে একদা তাঁর সকরুণ হৃদয়ের আঘাতে ঠেলে দিয়ে উপেক্ষা করেছিলেন, অদম্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে জয়ী করেছিলেন আপন শুভ সংকল্পকে, সেই তাঁর উত্তুঙ্গ মহত্ত্বের ইতিহাসকে সাধারণত তাঁর দেশের বহু লোক সসংকোচ নিঃশব্দে অতিক্রম করে থাকেন। এ কথা ভুলে যান যে, আচারগত অভ্যস্ত মতের পার্থক্য বড়ো কথা নয়,কিন্তু যে দেশে অপরাজেয় নির্ভীক চারিত্রশক্তি সচরাচর দুর্লভ, সে দেশে নিষ্ঠুর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্রের নির্বিচল হিতব্রতপালন সমাজের কাছে মহৎ প্রেরণা। তাঁর জীবনীতে দেখা গেছে, ক্ষতির আশঙ্কা উপেক্ষা করে দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বারংবার আত্মসম্মান রক্ষা করেছেন, তেমনিই যে শ্রেয়োবুদ্ধির প্রবর্তনায় দণ্ডপাণি-সমাজ-শাসনের কাছে তিনি মাথা নত করেন নি, সেও কঠিন সংকটের বিপক্ষে তাঁর আত্মসম্মান রক্ষার মূল্যবান দৃষ্টান্ত। দীন দুঃখীকে তিনি অর্থদানের দ্বারা দয়া করেছেন, সে কথা তাঁর দেশের সকল লোক স্বীকার করে; কিন্তু অনাথা নারীদের প্রতি যে করুণায় তিনি সমাজের রুদ্ধ হৃদয়দ্বারে প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছিলেন, তার শ্রেষ্ঠতা আরো অনেক বেশি, কেননা তার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে কেবলমাত্র তাঁর ত্যাগশক্তি নয়, তাঁর বীরত্ব। তাই কামনা করি, আজ তাঁর যে কীর্তিকে লক্ষ্য করে এই স্মৃতিসদনের দ্বার উন্মোচন করা হল, তার মধ্যে সর্বসমক্ষে সমুজ্জ্বল হয়ে থাক্ তাঁর মহাপুরুষোচিত কারুণ্যের স্মৃতি।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ পৌষ, ১৩৪৬
উইলিয়াম পিয়ার্সন
ভারতবর্ষে ফিরিবার ঠিক পূর্বে ইটালিতে ভ্রমণকালে শ্রীযুক্ত উইলিয়াম পিয়ার্সন মহাশয়ের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর আমাদের নিকট পৌঁছিয়াছে। তাঁহার নাম জনসাধারণের নিকট বিস্তৃতভাবে পরিচিত না হইতে পারে, কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস যে তাঁহার মৃত্যুতে যে ক্ষতি হইল তাহা শুধু তাঁহার আত্মীয় এবং বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই আবদ্ধ নহে। বিশ্বমানবের প্রতি ভালোবাসা তাঁহার কাছে যেরূপ সত্যকার সামগ্রী ছিল, সেবার আদর্শকে তিনি তাঁহার সহিত যেরূপ পূর্ণভাবে মিলাইতে পারিয়াছিলেন, খুব কম লোকেরই ভিতর আমরা তাহা দেখিয়াছি। যে-সকল অজ্ঞাত অখ্যাতনামা লোকের মধ্যে প্রতিবেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার মতোও কোনো বিশেষত্ব ছিল না, সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সহিত স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া তিনি তাহাদের নিজের সখ্য দান করিতে সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন, এবং এই দানের মধ্যে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অহংকার রিপুর সৎকর্মসাধনজনিত আত্মতৃপ্তিগত ভাববিলাসের কিছুমাত্র প্রভাব ছিল না। দুঃস্থ অভাবগ্রস্ত লোককে তিনি নিত্যনিয়ত যে-সাহায্য করিতেন তাহার জন্য তাঁহার সর্বসাধারণের প্রশংসা দ্বারা পুরস্কৃত হইবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, তাঁহার কাছে নিজের দৈনিককৃত্যের মতোই তাহা নিতান্ত সহজ এবং প্রচ্ছন্ন ছিল। তাঁহার দেশপ্রেম ছিল সর্বমানবের দেশের প্রতি, পৃথিবীর যে-কোনো দেশের লোকের উপর কিছুমাত্র অবিচার বা নিষ্ঠুর আচরণ ঘটিলে তিনি অন্তরের সহিত বেদনা অনুভব করিতেন, এবং মহৎভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া তাহাদের সাহায্যে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য তিনি নির্ভীকচিত্তে আপন দেশবাসীর নিকট শাস্তি বরণ করিয়া লইয়াছেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে তিনি আপন আবাসভূমি বলিয়া জানিয়াছিলেন, তিনি অনুভব করিয়াছিলেন যে, এইখানেই তিনি তাঁহার বিশ্বমানবের প্রতি সেবার আদর্শকে উপলব্ধি করিতে পারিবেন, এবং যে-ভারতের কল্যাণের সহিত তাঁহার জীবনের সকল আশা জড়িত ছিল, তাহার প্রতিও নিজের সুগভীর ভালোবাসা প্রকাশ করিবার সুযোগ পাইবেন।