আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে,
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥
শান্তিনিকেতন পত্রিকা, ভাদ্র, ১৩৩০
সুকুমার রায় – ০২
সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তাঁর ভাবসমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল সেইজন্যেই তিনি তার বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীয় রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির দানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকাল-মৃত্যুর সকরুণতা পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে রইল।
২। ৬। ৪০, গৌরীপুর ভবন, কালিম্পঙ
সুহৃত্তম শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
হে মিত্র, পঞ্চাশৎবর্ষ পূর্ণ করিয়া তুমি তোমার জীবনের ও বঙ্গসাহিত্যের মধ্যগগনে আরোহণ করিয়াছ আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি।
যখন নবীন ছিলে তখনই তোমার ললাটে জ্ঞানের শুভ্র মুকুট পরাইয়া বিধাতা তোমাকে বিদ্বৎসমাজে প্রবীণের অধিকার দান করিয়াছিলেন। আজ তুমি যশে ও বয়সে প্রৌঢ়,কিন্তু তোমার হৃদয়ের মধ্যে নবীনতার অমৃতরস চিরসঞ্চিত। অন্তরে তুমি অজয়, কীর্তিতে তুমি অমর,আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি।
সর্বজনপ্রিয়, তুমি মাধুর্যধারায় তোমার বন্ধুগণের চিত্তলোক অভিষিক্ত করিয়াছ। তোমার হৃদয় সুন্দর,তোমার বাক্য সুন্দর, তোমার হাস্য সুন্দর, হে রামেন্দ্রসুন্দর,আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি।
পূর্বদিগন্তে তোমার প্রতিভার রশ্মিচ্ছটা স্বদেশের নবপ্রভাতে উদ্বোধন সঞ্চার করিতেছে। জ্ঞান প্রেম ও কর্মের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্যে চিরদিন তুমি দেশমাতার পূজা করিয়াছ। হে মাতৃভূমির প্রিয়পুত্র, আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি।
সাহিত্য-পরিষদের সারথি তুমি এই রথটিকে নিরন্তর বিজয়পথে চালনা করিয়াছ।এই দু:সাধ্য কার্যে তুমি অক্রোধের দ্বারা ক্রোধকে জয় করিয়াছ,ক্ষমার দ্বারা বিরোধকে বশ করিয়াছ, বীর্যের দ্বারা অবসাদকে দূর করিয়াছ এবং প্রীতির দ্বারা কল্যাণকে আমন্ত্রণ করিয়াছ। আমি তোমাক সাদর অভিবাদন করিতেছি।
প্রিয়াণাং ত্বা প্রিয়পতিং হবামহে
নিধীনাং ত্বা নিধিপতিং হবামহে
প্রিয়গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রিয় তুমি, তোমাকে আহ্বান করি, নিধিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নিধি তুমি, তোমাকে আহ্বান করি। তোমাকে দীর্ঘজীবনে আহ্বান করি, দেশের কল্যাণে আহ্বান করি, বন্ধুজনের হৃদয়াসনে আহ্বান করি।
প্রবাসী
স্বামী শিবানন্দ
দেশে যে-সকল মহৎ প্রতিষ্ঠানে মানুষই মুখ্য, কর্মব্যবস্থা গৌণ, মানুষের অভাব ঘটিলে তাহাদের প্রাণশক্তিতে আঘাত লাগে। শিবানন্দ স্বামীর মৃত্যুতে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আশ্রমে সেই দুর্যোগ ঘটিল। এখন যাঁরা বর্তমান আছেন, প্রাণ দিয়া মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব তাঁহাদেরই। অহমিকাবর্জিত পরস্পর ঘনিষ্ঠতার প্রয়োজন এখন আরও বাড়িয়া উঠিল। নহিলে শূন্য পূর্ণ হইবে না এবং সেই ছিদ্রপথে বিশ্লিষ্টতার আক্রমণ আশ্রমের অন্তরে প্রবেশ করিতে পারে, সেই আশঙ্কা অনুভব করিতেছি। মহাপুরুষের কীর্তি ও স্মৃতি রক্ষার মহৎভার যাঁহাদের উপরে তাঁহারা নিজেদের ভুলিয়া সাধনাকে অক্ষুণ্ন রাখিবার এক লক্ষ্যে সকলে সম্মিলিত হইবেন– শিবানন্দ স্বামী তাঁহার মৃত্যুর মধ্যে এই বাণী রাখিয়া গিয়াছেন।
দোল পূর্ণিমা, ১৩৪০
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
১
বালককালে আমার সাহস যে কত ছিল তার দুটি দৃষ্টান্ত মনে পড়ছে। মানিকতলায় রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ঘরে আমার যাওয়া-আসা ছিল, আর তার চেয়ে স্পর্ধা প্রকাশ করেছি পটলডাঙায় বঙ্কিমচন্দ্রের সামনে যখন-তখন হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে।
একটা কথা মনে রাখা চাই তখন যাঁরা নামজাদা ছিলেন তাঁদের কাজের জায়গা বা আরামের ঘর এখনকার মতো সকলের পক্ষেই এত সুগম ছিল না। তখন সাহিত্যে যাঁদের প্রভাব ছিল বেশি তাঁদের সংখ্যা ছিল কম, তাঁদের আমরা সমীহ ক’রে চলতুম। তখনকার গণ্য লোকেরা সকলেই রাশভারি ছিলেন ব’লে আমার মনে পড়ে। সেকালে সমাজে একটা ব্যবহারবিধি ছিল, তাই পরস্পরের মর্যাদা লঙ্ঘন সহজ ছিল না।
রাজেন্দ্রলালের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ছিল, গাম্ভীর্য ও বিনয়ে মিশ্রিত তাঁর সহজ আভিজাত্যে আমি মুগ্ধ ছিলুম। তাঁর কাছে নিজের জোরে আমি প্রশ্রয় দাবি করি নি তিনি স্নেহ করে আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমশায়ের কথা সব প্রথমে আমি তাঁরই কাছে শুনেছিলাম। অনুভব করেছিলেম শাস্ত্রীমশায়ের প্রতি তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। সে সময়ে এশিয়াটিক সোসাইটির কাজে তাঁর সঙ্গে অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত কাজ করতেন। তাঁদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমহাশয়কে তিনি যে বিশেষভাবে আদর করেছিলেন পরেও তার প্রমাণ দেখেছি।
এই প্রসঙ্গে রাজেন্দ্রলালের কথা আমাকে বলতে হল তার কারণ এই যে শাস্ত্রীমশায় দীর্ঘকাল যে রাস্তা ধরে কাজ করেছেন সে রাস্তা আমার পক্ষে দুর্গম। সেইজন্যে তাঁকে প্রথম চিনেছি রাজেন্দ্রলালের প্রশংসাবাক্য থেকে আমার পক্ষে সেই যথেষ্ট।