দিনের বেলাটা কর্ম দিয়ে, খেলা দিয়ে ভরাট থাকে। রাত্রি যখন আসে, শিশু তখন ভয় পায়, কাঁদে। প্রত্যক্ষ তার কাছে আচ্ছন্ন হয়ে যায় বলে সে মনে করে সবই বুঝি গেল। কিন্তু আমরা জানি, ছেদ ঘটে না, রাত্রি ধাত্রীর মতো দিনকে অঞ্চলের আবরণের মধ্যে পালন করে। রাত্রিতে অন্ধকারের কালো ফাঁকটা যদি না থাকত তা হলে নক্ষত্রলোকের জ্যোতির্ময় ব্যঞ্জনা পেতুম কেমন করে? সেই নক্ষত্র আমাদের বলছে, “তোমর পৃথিবী তো এক ফোঁটা মাটি, দিনের বেলায় তাঁকেই তোমার সর্বস্ব জেনে আঁকড়ে পড়ে আছ। অন্ধকারে আমাদের দিকে চেয়ে দেখো– আমরাও তোমার। আমাদের নিয়ে আর তোমাকে নিয়ে এক হয়ে আছে এই বিশ্ব, এইটেই সত্য।’ অন্ধকারের মধ্যে নিখিলবিশ্বের ব্যঞ্জনা যেমন, মৃত্যুর মধ্যেও পরম প্রাণের ব্যঞ্জনা তেমনি।
আমার ফাঁক মানব না। ফাঁককে মানাই নাস্তিকতা। চোখে যেখানে ফাঁক দেখি আমাদের অন্তরাত্মা সেইখানে যেন পূর্ণকে দেখে। আমার মধ্যে এবং অন্যের মধ্যে মানুষে মানুষে তো আকাশগত ফাঁক আছে; যে লোক সেই ফাঁকটাকেই অত্যন্ত বেশি করে সত্য জানে সেই হল স্বার্থপর সেই হল অহংনিষ্ঠ। সে বলে, ও আলাদা, আমি আলাদা। মহাত্মা কাকে বলি যিনি সেই ফাঁককে আত্মীয়সম্বন্ধের দ্বারা পূর্ণ করে জানেন, জ্যোতির্বিৎ যেমন করে জানেন যে, পৃথিবী ও চন্দ্রের মাঝখানকার শূন্য পরস্পরের আত্মীয়তার আকর্ষণসূত্র বহন করছে। এক দেশের মানুষের সঙ্গে আর-এক দেশের মানুষের ফাঁক আরো বড়ো। শুধু আকাশের ফাঁক নয়, আচারের ফাঁক, ভাষার ফাঁক, ইতিহাসের ফাঁক। এই ফাঁককে যারা পূর্ণ করে দেখতে পারলে না তারা পরস্পর লড়াই করে পরস্পরকে প্রতারণা করে মরছে। তারা প্রত্যেকেই “আমরা বড়ো’ “আমরা স্বতন্ত্র’ এই কথা গর্ব করে জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ঘোষণা করে বেড়াচ্ছে। অন্ধ যদি বুক ফুলিয়ে বলে, “আমি ছাড়া বিশ্বে আর কিছুই নেই’ সে যেমন হয় এও তেমনি। আমাদের ঋষিরা বলেছেন, পরকে যে আত্মবৎ দেখেছে সেই সত্যকে দেখেছে। কেবল কুটুম্বকে, কেবল দেশের মানুষকে আত্মবৎ দেখা নয়, মহাপুরুষেরা বলেছেন শত্রুকেও আত্মবৎ দেখতে হবে। এই সত্যকে আমি আয়ত্ত করতে পারি নি বলে একে অসত্য বলে উপহাস করতে পারব না, একে আমার সাধনার মধ্যে গ্রহণ করতে হবে। কেননা পূর্ণস্বরূপের বিশ্বে আমরা ফাঁক মানতে পারব না। এই কথাটি আজ এত জোরের সঙ্গে আমার মনে বেজে উঠেছে তার কারণ সেদিন সেই যুবকের মৃত্যুশয্যায় দেখলুম সুদীর্ঘকাল দুঃখভোগের পরে জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মতো অত বড়ো বিচ্ছেদকে, প্রাণ যাকে পরম শত্রু বলে জানে, তাকেও তিনি পরিপূর্ণ করে দেখতে পেয়েছেন। তাই আমাকে গাইতে অনুরোধ করেছিলেন–
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে,
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ,
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥
যে গানটি তিনি আমাকে দুবার অনুরোধ করে শুনলেন সেটি এই :
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো– গভীর শান্তি এ যে,
আমার সকল ছাড়িয়ে গিয়ে উঠল কোথায় বেজে।
ছাড়িয়ে গৃহ, ছাড়িয়ে আরাম, ছাড়িয়ে আপনারে
সাথে করে নিল আমার জন্মমরণপারে–
এল পথিক সেজে॥
চরণে তার নিখিল ভুবন নীরব গগনেতে–
আলো-আঁধার আঁচলখানি আসন দিল পেতে।
এতকালের ভয়ভাবনা কোথায় যে যায় সরে,
ভালোমন্দ ভাঙাচোরা আলোয় ওঠে ভরে–
কালিমা যায় মেজে।–
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো– গভীর শান্তি এ যে।
জীবনকে আমরা অত্যন্ত সত্য বলে অনুভব করি কেন? কেননা এই জীবনের আশ্রয়ে আমাদের চৈতন্য বহুবিচিত্রের সঙ্গে আপনার বহুবিধ সম্বন্ধ অনুভব করে। এই সম্বন্ধবোধ বর্জিত হয়ে থাকলে আমরা জড় পদার্থের মতো থাকতুম, সকলের সঙ্গে যোগে নিজেকে সত্য বলে উপলব্ধি করতে পারতুম না। এই সুযোগটি দিয়েছে বলেই প্রাণকে এত মূল্যবান জানি। মৃত্যুর সম্মুখেও যাঁদের চিত্ত প্রসন্ন ও প্রশান্ত থাকে তাঁরা মৃত্যুর মধ্যেও সেই মূল্যটি দেখতে পান। যিনি সকল সম্বন্ধের সেতু, সকল আত্মীয়তার আধার, বহুর মধ্য দিয়ে যিনি এককে বিধৃত করে রেখেছেন, তাঁরা মৃত্যুর রিক্ততার মধ্যে তাঁকেই সুস্পষ্ট করে দেখতে পান। সেইজন্যেই এই মৃত্যুপথের পথিক আমাকে গান গাইতে বলেছিলেন, পূর্ণতার গান, আনন্দের গান। তাঁকে গান শুনিয়ে ফিরে এসে সে রাত্রে আমি একলা বসে ভাবলুম, মৃত্যু তো জীবনের সব শেষের ছেদ, কিন্তু জীবনেরই মাঝে মাঝেও তো পদে পদে ছেদ আছে। জীবনের গান মরণের শমে এসে থামে বটে, কিন্তু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার তাল তো কেবলই মাত্রায় মাত্রায় ছেদ দেখিয়ে যায়। সেই ছেদগুলি যদি বেতালা না হয়, যদি তা ভিতরে ভিতরে ছন্দোময় সংগীতের দ্বারা পূর্ণ হয় তা হলেই শমে এসে আনন্দের বিচ্ছেদ ঘটে না। কিন্তু ছেদগুলি যদি সংগীতকে, পূর্ণতাকে বাধা দিয়ে চলে, তা হলেই শম একেবারে নিরর্থক হয়ে ওঠে। জীবনের ছেদগুলি যদি ত্যাগে, ভক্তিতে, পূর্ণস্বরূপের কাছে আত্মনিবেদনে ভরিয়ে রাখতে পারি– মৌচাকের কক্ষগুলি মৌমাছি যেমন মধুতে ভরিয়ে রাখে– তা হলে যাই ঘটুক না, কিছুতেই ক্ষতি নেই। তা হলে শূন্যই পূর্ণের ব্যঞ্জনাকে বহন করে। বিশ্বের মর্মকুহর থেকে নিরন্তর ধ্বনিত হচ্ছে ওঁ, হাঁ– আমি আছি। আমাদের অন্তর থেকে আত্মা সুখে দুঃখে উৎসবে শোকে সাড়া দিক ওঁ, হাঁ, সব পূর্ণ, পরিপূর্ণ! বলুক,