পূর্বে বলেছি, অপরিসীম অজানা থেকে জানার মধ্যে মানুষ আসবামাত্রই সেই না-জানার শূন্যতা এক নিমেষে চলে যায়– সেই না-জানার মহা গহ্বর সত্যের দ্বারা নিমেষে পূর্ণ হয়ে যায়। অন্তরের মধ্যে বুঝতে পারি, আমাদের গোচরতা এবং অগোচরতা, দুইকেই ব্যাপ্ত করে সত্যের লীলা চলছে। অগোচরতা সত্যের বিলোপ নয়। পাবার বেলায় এই যে আমাদের অনুভূতি, ছাড়বার বেলায় একে আমরা ভুলব কেন? ঢেউয়ের চূড়াটি নীচের থেকে উপরে যখন উঠে পড়ল, তখন সত্যের বার্তা পেয়েছি; ঢেউয়ের চূড়াটি যখন উপর থেকে নীচে নেমে পড়ল, তখন সত্যের সেই বার্তাটিকে কেন বিশ্বাস করব না? এক-সময়ে সত্য আমাদের গোচরে এসে “আমি আছি’ এই কথাটি আমাদের মনের মধ্যে লিখে দিল– তার স্বাক্ষর রইল; এখন সে যদি অগোচরে যায়, অন্তরের মধ্যে তার এই দলিল মিথ্যে হবে কেন? ঋষি বলেছেন–
“ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূর্য্যঃ
ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুর্দ্ধাবতি পঞ্চমঃ।”
এই শ্লোকটির অর্থ এই যে, মৃত্যু সৃষ্টির বিরুদ্ধ শক্তি নয়। এই পৃথিবীর সৃষ্টিতে যেগুলি চালকশক্তি, তার মধ্যে অগ্নি হচ্ছে একটি; অণু-পরমাণুর অন্তরে অন্তরে থেকে তাপরূপে অগ্নি যোজন-বিয়োজনের কাজ করছেই। সূর্যও তেমনি পৃথিবীর সমস্ত প্রাণকে এবং ঋতু সম্বৎসরকে চালনা করছে। জল পৃথিবীর নাড়ীতে নাড়ীতে প্রবহমান, বায়ু পৃথিবীর নিশ্বাসে নিশ্বাসে সমীরিত। সৃষ্টির এই ধাবমান শক্তির মধ্যেই মৃত্যুকেও গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যু প্রতি মুহূর্তেই প্রাণকে অগ্রসর করে দিচ্ছে– মৃত্যু ও প্রাণ এই দুইয়ে মিলে তবে জীবন। এই মৃত্যুকে প্রাণের থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিভক্ত করে দেখলে, মিথ্যার বিভীষিকা আমাদের ভয় দেখাতে থাকে। এই মৃত্যু আর প্রাণের বিশ্বব্যাপী বিরাট ছন্দের মধ্যে আমাদের সকলের অস্তিত্ব বিধৃত হয়ে লীলায়িত হচ্ছে; এই ছন্দের যতিকে ছন্দ থেকে পৃথক করে দেখলেই তাকে শূন্য করে দেখা হয়; দুইকে অভেদ করে দেখলেই তবে ছন্দকে পূর্ণ করে পাওয়া যায়। প্রিয়জনের মৃত্যুতেই এই যতিকে ছন্দের অঙ্গ বলে দেখা সহজ হয়– কেননা, আমাদের প্রীতির ধনের বিনাশ স্বীকার করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। এইজন্যে শ্রাদ্ধের দিন হচ্ছে শ্রদ্ধার দিন, এই কথা বলবার দিন যে, মৃত্যুর মধ্যে আমরা প্রাণকেই শ্রদ্ধা করি।
আমাদের প্রেমের ধন স্নেহের ধন যারা চলে যায়, তারা সেই শ্রদ্ধাকে জাগিয়ে দিক, তারা আমাদের জীবনগৃহের যে দরজা খুলে দিয়ে যায়, তার মধ্য দিয়ে আমরা শূন্যকে যেন না দেখি, অসীম পূর্ণকেই যেন দেখতে পাই। আমাদের সেই যে অসত্যদৃষ্টি, যা জীবন-মৃত্যুকে ভাগ করে ভয়কে জাগিয়ে তোলে, তার হাত থেকে সত্যস্বরূপ আমাদের রক্ষা করুন, মৃত্যুর ভিতর দিয়ে তিনি আমাদের অমৃতে নিয়ে যান।
প্রবাসী, আশ্বিন, ১৩৪২
শিবনাথ শাস্ত্রী
শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠ ছিল না। তাঁহাকে আমি যেটুকু চিনিতাম, সে আমার পিতার সহিত তাঁহার যোগের মধ্য দিয়া।
আমার পিতার জীবনের সঙ্গে তাঁহার সুরের মিল ছিল। মতের মিল থাকিলে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা হয় ভক্তি হয়, সুরের মিল থাকিলে গভীর প্রীতির সম্বন্ধ ঘটে।
আমার পিতার ধর্মসাধনা তত্ত্বজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। অর্থাৎ তাহার সাধনা খালকাটা জলের মতো ছিল না, সে ছিল নদীর স্রোতের মতো। সেই নদী আপনার ধারার পথ আপনি কাটিয়া সমুদ্রে গিয়া পৌঁছে। এই পথ হয়তো বাঁকিয়া-চুরিয়া যায়, কিন্তু ইহার গতির লক্ষ্য আপন স্বভাবের বেগেই সেই সমুদ্রের দিকে। গাছ আপন সকল পাতা মেলিয়া সূর্যালোককে সহজেই গ্রহণ করে এবং আপন জীবনের সহিত তাহাকে মিলিত করিয়া আপনার সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত ও সঞ্চিত করিয়া তুলে। এই গাছকে বাধার মধ্যে রাখিলেও সে স্বভাবের একাগ্র প্রেরণায় যে-কোনো ছিদ্রের মধ্য দিয়া আপন আকাঙক্ষাকে সূর্যালোকের দিকে প্রসারিত করিয়া দেয়। এই আকাঙক্ষা গাছটির সমগ্র প্রাণশক্তির আকাঙক্ষা।
তেমনি বুদ্ধিবিচারের অনুসরণে নয় কিন্তু আত্মার প্রাণবেগের ব্যাকুল অনুধাবনেই পিতৃদেব সমস্ত কঠিন বাধা ভেদ করিয়া অসীমের অভিমুখে জীবনকে উদ্ঘাটিত করিয়াছিলেন। তাঁহার এই সমগ্রজীবনের সহজ ব্যাকুলতার স্বভাবটি শিবনাথ ঠিকমতো বুঝিয়াছিলেন। কেননা তাঁহার নিজের মধ্যেও আধ্যাত্মিকতার এই সহজ বোধটি ছিল।
তিনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘরে যে সংস্কারের মধ্যে জন্মিয়াছিলেন তাহার বাধা অত্যন্ত কঠিন। কেননা, সে শুধু অভ্যাসের বাধা নহে; শুধু জন্মগত বিশ্বাসের বেষ্টন নহে। মানুষের সব চেয়ে প্রবল অভিমান যে ক্ষমতাভিমান সেই অভিমান তাহার সঙ্গে জড়িত। এই অভিমান লইয়া পৃথিবীতে কত ঈর্ষা দ্বেষ, কত যুদ্ধবিগ্রহ। ব্রাহ্মণের সেই প্রভূত সামাজিক ক্ষমতা, সেই অভ্রভেদী বর্ণাভিমানের প্রাচীরে বেষ্টিত থাকিয়াও তাঁহার আত্মা আপনার স্বভাবের প্রেরণাতেই সমস্ত নিষেধ ও প্রলোভন বিদীর্ণ করিয়া মুক্তির অভিমুখে ধাবিত হইয়াছিল। তমসো মা জ্যোতির্গময় এই প্রার্থনাটি তিনি শাস্ত্র হইতে পান নাই, বুদ্ধিবিচার হইতে পান নাই, ইহা তাঁহার জীবনীশক্তিরই কেন্দ্রনিহিত ছিল, এইজন্য তাঁহার সমস্ত জীবনের বিকাশই এই প্রার্থনার ব্যাখ্যা।
জাগ্রত আত্মার এই স্বভাবের গতিটিই সকল ধর্ম-সমাজের প্রধান শিক্ষার বিষয়। সাধকের মধ্যে ইহারই রূপটি ইহারই বেগটি যদি দেখিতে পাই তবেই সে আমাদের পরম লাভ হয়। মতের ব্যাখ্যা এবং উপদেশকে যদি বা পথ বলা যায় কিন্তু দৃষ্টি বলা যায় না। বাঁধা পথ না থাকিলেও দৃষ্টি আপন পথ খুঁজিয়া বাহির করে। এমন-কি, পথ অত্যন্ত বেশি বাঁধা হইলেই মানুষের দৃষ্টির জড়তা ঘটে, মানুষ চোখ বুজিয়া চলিতে থাকে, অথবা চিরদিন অন্যের হাত ধরিয়া চলিতে চায়। কিন্তু প্রাণক্রিয়া প্রাণের মধ্য দিয়াই সঞ্চারিত হয়। আত্মার প্রাণশক্তি সহজ প্রাণশক্তির দ্বারাই উদ্বোধিত হয়। কেবল বাহিরের পথ বাঁধায় নহে, সেই অন্তরের উদ্বোধনে যাঁহারা ব্রাহ্মসমাজকে সাহায্য করিয়াছেন শিবনাথ তাঁহাদের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি।