প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩২৯
বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য
আজকের এই অস্তোন্মুখ সূর্যের মতোই আমার হৃদয় আমার জীবনের পশ্চিম দিগন্ত থেকে তোমার প্রতি তার আশীর্বাদ বিকীর্ণ করছে।
তোমার সঙ্গে আজ আমার এই মিলন আর-একদিনকার শুভ সম্মিলনের আলোকেই উদ্দীপ্ত হয়ে দেখা দিলে। সে কথা আজ তোমাকে জানিয়ে দেবার উপলক্ষ ঘটল বলে আমি আনন্দিত। তখন তোমার জন্ম হয় নি, আমি তখন বালক। একদা তোমার স্বর্গগত প্রপিতামহ বীরচন্দ্র মাণিক্য তাঁর মন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, কেবল আমাকে এই কথা জানাবার জন্যে যে তিনি আমাকে শ্রেষ্ঠ কবির সম্মান দিতে চান। দেশের কাছ থেকে এই আমি প্রথম সমাদর পেয়েছিলুম। প্রত্যাশা করি নি এবং এই বহুমানের যোগ্যতা লাভ করবার দিন তখন অনেক সুদূরে ছিল। তার পরে স্বাস্থ্যের সন্ধানে কার্সিয়াঙে যাবার সময়ে আমাকে তাঁর সঙ্গে ডেকে নিয়েছিলেন। তিনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়ো ছিলেন কিন্তু আমার সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা করতেন প্রিয় বয়স্যের মতো। তাঁর সংগীতের জ্ঞান অসাধারণ ছিল কিন্তু আমার সেই কাঁচা বয়সের রচিত ছেলেমানুষি গান তিনি আদর করে শুনতেন, বোধ হয় তার মধ্যে ভাবী পরিণতির সম্ভাবনা প্রত্যাশা করে। এ যেন কোন্ অদৃশ্য রশ্মির লিপি অঙ্কিত হয়েছিল তাঁর কল্পনার পটে। আজ সকলের চেয়ে বিস্ময় লাগে এই কথা মনে করে যে, বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে মহারাজার মনে যে-সকল সংকল্প ছিল, আমাকে নিয়ে তিনি সে সম্বন্ধে পরামর্শ করতেন এবং আমাকে সেই সাহিত্য অনুষ্ঠানের সহযোগী করবেন বলে প্রস্তাব করেছিলেন। তার অনতিকাল পরেই কলকাতায় ফিরে এসে তাঁর মৃত্যু হল; মনে ভাবলুম এই রাজবংশের সঙ্গে আমার সম্বন্ধসূত্র এইখানেই অকস্মাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু তা যে হল না সেও আমার পক্ষে বিস্ময়কর। তাঁর অভাবে ত্রিপুরায় আমার যে সৌহৃদ্যের আসন শূন্য হল মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য অবিলম্বে আমাকে সেখানে আহ্বান করে নিলেন। তাঁর কাছ থেকে যে অকৃত্রিম ও অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সমাদর পেয়েছিলুম তা দুর্লভ। আজ এ কথা গর্ব করে তোমাকে বলবার অধিকার আমার হয়েছে যে, ভারতবর্ষের যে কবি পৃথিবীতে সমাদৃত, তাঁকে তাঁর অনতিব্যক্ত খ্যাতির মুহূর্তে বন্ধুভাবে স্বীকার করে নেওয়াতে ত্রিপুরা রাজবংশ গৌরব লাভ করেছেন। তেমন গৌরব বর্তমান ভারতবর্ষের কোনো রাজকুল আজ পর্যন্ত পান নি। এই সম্মেলনের যে একটা ঐতিহাসিক মহার্ঘতা আছে আশা করি সে কথা তুমি উপলব্ধি করেছ। যে সংস্কৃতি, যে চিত্তোৎকর্ষ দেশের সকলের চেয়ে বড়ো মানসিক সম্পদ, একদা রাজারা তাকে রাজৈশ্বর্যের প্রধান অঙ্গ বলে গণ্য করতেন, তোমার পিতামহেরা সে কথা মনে মনে জানতেন। এই সংস্কৃতির সূত্রেই তাঁদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ছিল, এবং সে সম্বন্ধ অত্যন্ত সত্য ছিল। আজ তোমার আগমনে সেদিনকার সুখস্মৃতির দক্ষিণ সমীরণ তুমি বহন করে এনেছ। আজ তুমি বর্তমান দিনকে সেই অতীতের অর্ঘ্য এনে দিয়েছ, এই উপলক্ষে তুমি আমার স্নিগ্ধ হৃদয়ের সেই দান গ্রহণ করো যা তোমার পিতামহদের অর্পণ করেছিলুম, আর গ্রহণ করো আমার সর্বান্তঃকরণের আশীর্বাদ।
আনন্দবাজার পত্রিকা,২৫ পৌষ, ১৩৪৫
বীরেশ্বর
সেদিন আমাদের বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানের দিন ছিল। আমরা তারই জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। মৃত্যু যে গোপনে উৎসবের আলিঙ্গন থেকে উৎসবের কোলের একটি ছেলেকে কেড়ে নিতে এসেছিল সে সংবাদ আমার জানা ছিল না। আমাদের আশ্রম তারই অনুসরণে পাঠিয়ে দিলে আপদ অনারব্ধ উৎসবকে তার জীবনান্তের শেষ ছায়ার মতো। সেদিন আমাদের বর্ষপঞ্জীর উৎসব-গণনায় একটি শূন্য চিহ্ন রয়ে গেল যেখানে ছিল বীরেশ্বরের আবাল্যকালের আসন। শ্রীনিকেতনের হলকর্ষণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবার মুখে কে একজন বললে গোঁসাইজির ঘরে দুশ্চিন্তাজনক রোগ দেখা দিয়েছে, ব্যস্ততার মুখে কথাটা ভালো করে আমার কানে পৌঁছয় নি। আমি মুহূর্তের জন্যেও ভাবতে পারি নি যে বীরেশ্বরই তার লক্ষ্য।
সে ছিল মূর্তিমান প্রাণের প্রতীক, যৌবনের তেজে দীপ্ত। তাকে ভালোবেসেছে আশ্রমের সকলেই, সে ভালোবেসেছে আশ্রমকে। তার সত্তার মধ্যে এমন একটি উদ্যমের পূর্ণতা ছিল যে তাকে হারাবার কথা কল্পনাও করতে পারি নি।
অবশেষে দারুণ সংবাদ নিশ্চিত হয়ে কানে পৌঁছল– তার পর থেকে কত অর্ধরাত্রে ঘুমের ফাঁকে কত ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে, কতবার দিনের বেলায় কাজের মাঝে মাঝে তার ছবি মনে অকস্মাৎ ছায়া ফেলে গেল।
সংসারে যাওয়া-আসার পথে, আলো-আঁধারের পর্যাবর্তনে ভিড়ের সঙ্গে মিলে যখন মৃত্যু দেখা দেয় তখন তাকে অসংগত বলে মনে হয় না। বনে অজস্র ফুল ফোটে আর ঝরে, সেই ফোটা-ঝরার ছন্দ একসঙ্গে মেলানো। তেমনি বিরাট সংসারের মাঝখানে জীবনে মৃত্যুতে চিরদিন ধরেই তাল মিলিয়ে চলে। মৃত্যু সেখানে জীবনের ছবিতে দুঃখের দাগ কাটে, চিত্রপটকে ছিন্ন করে না। কিন্তু আশ্রমের মধ্যে সেই মৃত্যুকে আমরা তো অত সহজে মেনে নিতে পারি নে। যারা এখানে মিলেছে তারা মিলেছে পান্থশালায়, সামনে তাদের এগোবার পথ, সেই পথের পাথেয় সংগ্রহ করছে, এখানে সাংসারিক সুখদুঃখের দ্বন্দ্ব নেই। এখানকার আশাপ্রত্যাশা প্রভাত-সূর্যের আলোকে দূরপ্রসারিত ভবিষ্যতের দিকে। এর মধ্যে মৃত্যু যখন আসে তখন অভাবনীয় একাট নিষ্ঠুর প্রতিবাদ নিয়ে আসে। অতি তীব্র বেদনায় অনুভব করি এখানে তার অনধিকার।