সে সময়ে আমার নিজের নির্জন আসন ছিল পদ্মাতীরে বালুতটে। সেখানেও কিছুদিন তাঁহাকে অতিথি পাইয়াছিলাম। যাহারা সভাচর জাতীয় সামাজিক, তাহাদের পক্ষে পদ্মাতীরের সঙ্গবিরলতা অত্যন্ত শূন্য ঠেকিবার কথা; কিন্তু জগদিন্দ্র সেখানকার নিভৃত প্রকৃতির আমন্ত্রণ হইতে বঞ্চিত হন নাই; সেখানকার জল স্থল আকাশের সুরের সঙ্গে তাঁহার মনের মধ্যে সঙ্গৎ জমিয়াছিল, তাল কাটে নাই।
জগদিন্দ্রনাথ আমার এই নির্জন আতিথ্যের জবাব দিয়াছিলেন বিশাল জনসংঘের মধ্যে। যে বৎসর নাটোরে প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সম্মিলনীর সভা বসিল, সেবার তাঁহার আহ্বানে খামখেয়ালির প্রায় সকলেই তাঁহার ঘরে গিয়া জড়ো হইল। স্বভাবদোষে সেখানেও বিদ্রোহের হাওয়া তুলিয়াছিলাম, জগদিন্দ্র হইয়াছিলেন তাহার সহায়। তখন প্রাদেশিক সম্মিলনীতে বক্তৃতাদি হইত ইংরেজি ভাষায়– অনেকদিন হইতে আমার কাছে তাহা একই কালে হাস্যকর ও দুঃখকর ঠেকিত। এবার নিরন্তর উৎপাত করিয়া আমরা এই অদ্ভুত কদাচার ভাঙিয়া দিয়াছিলাম। তাহাতে প্রবীণ দেশহিতৈষীর দল আমার উপর বিষম বিরক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহাদের সেই রুদ্রতায় যে কৌতুক ফেনিল হইয়া উঠিয়াছিল তাহার মধ্যে জগদিন্দ্রনাথের হাস্য প্রচুর পরিমাণে ছিল।
সেবারে সব চেয়ে যাহা আমরা উপভোগ করিয়াছিলাম, সে তাঁহার আতিথ্যের আয়োজন নহে, আতিথ্যের রস। সেই বিরাট যজ্ঞে উপকরণের বাহুল্যই হইয়াছিল, কিন্তু সেটা বড়ো কথা নহে। এত বৃহৎ জনতার মধ্যে তাঁহার সঙ্গ তাঁহার সৌজন্য যে কেমন করিয়া সর্বব্যাপী হইয়া বিরাজ করিত, তাহাই আমার কাছে বিস্ময়ের বিষয়। আমাদের দেশে যজ্ঞকর্তার অবস্থা যে কিরূপ শোচনীয়, তাহা বাঙালি বরযাত্রীদের মেজাজ আলোচনা করিলেই বুঝা যায়। সময় অসময় সম্ভব অসম্ভবের বিচার নাই, সমস্ত ক্ষণ আবদার অভিযোগ অভিমানের তুফান তুলিবার চেষ্টা। সর্বজনীন কর্মানুষ্ঠানে সকল দলেরই যে সম্মিলিত দায়িত্ব সে কথা মনে থাকে না; নিমন্ত্রিতেরা যেন নিমন্ত্রণ কর্তার প্রতিপক্ষ, তাহাকে হয়রান করিয়া তুলিতে যেন বাহাদুরী আছে, লজ্জা মাত্র নাই। সেবারেও সেইরূপ বরযাত্র মেজাজের লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু জগদিন্দ্রনাথ দিনে রাতে অনুনয় বিনয়ে সেই-সকল উত্তেজিত অতিথি-অভ্যাগতের অহৈতুক প্রকোপ প্রশমনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অযোগ্য ব্যক্তিদের কর্তৃক অন্যায় রূপে লাঞ্ছিত হইয়াও মুহূর্তকালের জন্য তাঁহার প্রসন্নতা দূর হয় নাই। সভাধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে আর-এক অত্যাচারকারী অনাহূত অতিথির অকস্মাৎ আবির্ভাবে সকলের চমক লাগিল, সে আর কেহ নহে সেই বছরের ভূমিকম্প। সভা ভাঙিয়া গেল, পৃথিবীর শ্যামল গাত্রাবরণখানাকে কোন্ দৈত্য নখ দিয়া ছিঁড়িতে লাগিল, দালান ফাটিল– চারি দিকেই বিভীষিকা। বিঘ্ন বিপদ যাহা ঘটিবার তাহা তো ঘটিল, তাহার চেয়েও প্রবলতর পীড়া বাধাইল অনিশ্চিতের আশঙ্কা। রেলপথ বন্ধ, তারে খবর চলে না, অতিথিগণ সকলেই ঘরের খবরের জন্য উদ্বিগ্ন। দুর্দৈবের বড়ো ধাক্কাটা যখন থামিয়াছে তখনো ক্ষণে ক্ষণে ধরণীর হৃৎকম্প থামে না। পাকা কোঠায় থাকিতে কাহারো সাহস হয় না, চালা ঘরে কোনো প্রকারে সকলের গোঁজামিলন। যিনি গৃহস্বামী এই দুর্বিপাকে নিঃসন্দেহই নিজের সংসারের জন্য তাঁহার উদ্বেগের সীমা ছিল না। কিন্তু নিজের ক্ষতি ও বিপত্তির চিন্তা তাঁহার মনের মধ্যে যে আলোড়িত হইতেছিল বাহির হইতে তাহা কে বুঝিবে? বিধাতা তাঁহার আতিথেয়তার যে কী কঠিন পরীক্ষা করিয়াছিলেন তাহা আমরা জানি, আর সেই পরীক্ষায় তিনি যে কিরূপ সগৌরবে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন তাহাও আমাদের মনে পড়ে।
যে সৌজন্য, যে বৈদগ্ধ্য, যে আত্মমর্যাদাবোধ, যে সামাজিক আত্মোৎসর্গ আমাদের দেশের প্রাচীন অভিজাত বংশীয়ের উপযুক্ত, জগদিন্দ্রনাথের তাহা অজস্র ছিল, তাহার সঙ্গে ছিল আধুনিক যুগের শিক্ষা। জগদিন্দ্রনাথের চিত্তবিকাশে দুইটি বিদ্যার ধারার সমান মিলন দেখিয়াছি। সংস্কৃত শাস্ত্র ও সাহিত্যে তাঁহার যেমন গভীর আনন্দ ছিল, ইংরেজি সাহিত্যেও তাঁহার তেমনি ছিল অধিকার। এই অধিকার বাহিরের শিক্ষায় নহে অন্তরের ধারণাশক্তিতে। তাঁহার চিত্তরাজ্যে যাহা আমাদের মনকে সব চেয়ে আকর্ষণ করিয়াছিল, তাহা পাণ্ডিত্যের উপাদান নহে, তাহা সহজ সহৃদয়তায় প্রদীপ্ত রুচির আলোক।
সংসারে সাধারণ আদর্শমতো ভালো লোক অনেকে আছেন, কিন্তু তাঁহাদিগকে মনে রাখিতে পারি না। তাঁহারা যেন গুণের তালিকা মাত্র। যে অলক্ষ্য সূত্রে সেই গুণগুলিকে এক করিয়া মানুষের ব্যক্তিস্বরূপটিকে পরিস্ফুট করিয়া তুলে, জগদিন্দ্রনাথের মধ্যে তাহাই ছিল। এইজন্য যখন তিনি ইহলোক হইতে চলিয়া গেলেন, বন্ধুদের স্মৃতিলোকে তাঁহার মূর্তি অম্লান ভাবে প্রতিষ্ঠিত রহিল।
মানসী ও মর্ম্মবাণী, মাঘ, ১৩৩২
জগদীশচন্দ্র
তরুণ বয়সে জগদীশচন্দ্র যখন কীর্তির দুর্গম পথে সংসারে অপরিচিতরূপে প্রথম যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন, যখন পদে পদে নানা বাধা তাঁর গতিকে ব্যাহত করছিল, সেইসময়ে আমি তাঁর ভাবী সাফল্যের প্রতি নিঃসংশয়ে শ্রদ্ধাদৃষ্টি রেখে বারে বারে গদ্যে পদ্যে তাঁকে যেমন করে অভিনন্দন জানিয়েছি, জয়লাভের পূর্বেই তাঁর জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছি, আজ চিরবিচ্ছেদের দিনে তেমন প্রবল কণ্ঠে তাঁকে সম্মান নিবেদন করতে পারি সে শক্তি আমার নেই। আর কিছু দিন আগেই অজানা লোকে আমার ডাক পড়েছিল। ফিরে এসেছি। কিন্তু সেখানকার কুহেলিকা এখনো আমার শরীর-মনকে ঘিরে রয়েছে। মনে হচ্ছে, আমাকে তিনি তাঁর অন্তিমপথের আসন্ন অনুবর্তন নির্দেশ করে গেছেন। সেই পথযাত্রী আমার পক্ষে আমার বয়সে শোকের অবকাশ দীর্ঘ হতে পারে না। শোক দেশের হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের সাধনায় যিনি তাঁর কৃতিত্ব অসমাপ্ত রেখে যান নি, বিদায় নেওয়ার দ্বারা তিনি দেশকে বঞ্চিত করতে পারেন না। যা অজর যা অমর তা রইল। শারীরিক বিচ্ছেদের আঘাতে সেই সম্পদের উপলব্ধি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, যেখানে তিনি সত্য সেখানে তাঁকে বেশি করে পাওয়ার সুযোগ ঘটবে। বন্ধুরূপে আমার যা কাজ সে আমার যখন শক্তি ছিল তখন করতে ত্রুটি করি নি। কবিরূপে আমার যা কর্তব্য সেও আমার পূর্ণ সামর্থ্যের সময় প্রায় নিঃশেষ ক’রে দিয়েছি– তাঁর স্মৃতি আমার রচনায় কীর্তিত হয়েই রয়েছে।