সখা ওহে কে বলিল নাহি তুমি আর!
রোগতাপজর্জরিত ফেলি দেহভার
অজর অমর রূপে হয়ে জ্যোতির্ময়
নবাকাশে নববেশে হয়েছ উদয়।
সে চিত্র তুলিতে নারে চিত্রকর বটে,
ওঠে না সে দেহছায়া ভানুচিত্রপটে,
কিন্তু সেই সূক্ষ্মছবি চিন্ময় কায়া
চিদাকাশে সদা ভাসে– দিব্য তার ছায়া।
সেই তব চিরস্ফুর সুমধুর হাস
যন্ত্রণারও মাঝে যাহা হইত বিকাশ;
অপ্রতিম ধৈর্য তব– আত্মার সে বল–
রোগ তাপ মাঝে যাহা থাকিত অটল;
অনন্ত সে জ্ঞানস্পৃহা– ভেদিয়া আকাশ
সুদূর নক্ষত্রমাঝে হত যা প্রকাশ;
একনিষ্ঠ প্রেম সেই একপত্নীব্রত
সখাসনে যার কথা হইত নিয়ত;
এই সব সূক্ষ্মতত্ত্ব মিলি একসাথে
জ্যোতির্ময় সূক্ষ্ম তনু রচিয়া তাহাতে
কোন্ দিব্য পথে কোন্ সমুন্নত লোকে
গেছ চলি– এড়াইয়া রোগ-তাপ-শোকে।
সাধনা, আষাঢ়, ১৩০২
কেশবচন্দ্র সেন
আমাদের দেশে আশীর্বাদ করে শতায়ু হও। সে আশীর্বাদ দৈবাৎ হয়তো কখনো ফলে কখনো ফলে না। কিন্তু বিধাতা যাঁকে আশীর্বাদ করেন তিনি দেহযাত্রার সীমা অতিক্রম ক’রে শত শত শতাব্দীর আয়ু লাভ করে থাকেন। সেই বর লাভ করেছেন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন। উপনিষদ বলেন য এতদ্বিদুরমিতাস্তে ভবন্তি। যাঁরা তাঁকে জানেন তাঁরা মৃত্যুর অতীত হন, সেই অমৃত তাঁর জীবনে পেয়েছেন কেশবচন্দ্র, সেই অমৃত তিনি বিশ্বজনকে নিবেদন করেছেন, সেই তাঁর প্রসাদ স্মরণ করে তাঁর আগামী বহু শতবার্ষিকীর প্রথম শতবার্ষিকীর দিনে সেই অমিতায়ুকে আমাদের অভিবাদন জানাই।
১৩ পৌষ, ১৩৪৫, রবীন্দ্রভবন-সংগ্রহ
খান আবদুল গফ্ফর খান
অল্পক্ষণের জন্যে আপনি আমাদের মধ্যে এসেছেন কিন্তু সেই সৌভাগ্যকে আমি অল্প বলে মনে করি নে। আমার নিবেদন এই যে আমার এ কথাকে আপনি অত্যুক্তি ব’লে মনে করবেন না যে আপনার দর্শন আমাদের হৃদয়ের মধ্যে নূতন শক্তি সঞ্চার করেছে। প্রেমের উপদেশ মুখে ব’লে ফল হয় না, যাঁরা প্রেমিক তাঁদের সঙ্গই প্রেমের স্পর্শমণি, তার স্পর্শে, আমাদের অন্তরে যেটুকু ভালোবাসা আছে তার মূল্য বেড়ে যায়।
অল্পক্ষণের জন্য আপনাকে আমরা পেয়েছি কিন্তু এই ঘটনাকে ক্ষণের মাপ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। যে মহাপুরুষদের হৃদয় সকল মানুষের জন্য, সকল দেশই যাঁদের দেশ, তাঁরা যে-কালকে উপস্থিতমতো অধিকার করেন তাকে অতিক্রম করেন, তাঁরা সকল কালের। এখানে আপনার ক্ষণিক উপস্থিতি আশ্রমের হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে রইল।
আপনার জীবন সত্যে প্রতিষ্ঠিত। এই সত্যের প্রভাব আপনি চারি দিকে কী রকম বিকীর্ণ করেন এই অল্প সময়ের মধ্যে তা আমরা অনুভব করেছি। জেনেছি আমাদের সকল কর্ম এই সত্যবোধের অভাবে প্রতিদিন ব্যর্থ হচ্ছে। অপরাজেয় সত্যের জোরেই প্রেমের মন্ত্রে এই শতধাবিদীর্ণ দুর্ভাগ্য দেশের আত্মঘাতী ভ্রাতৃবিদ্বেষের বিষ অপনয়ন করবেন, বিধাতার এই সংকল্পেই আপনার আবির্ভাব। আপনার সেই চরিত্রশক্তির কিছু উদ্যম আমাদের আশ্রমবাসীর মনে আপনি সঞ্চার করে গেছেন তাতে আমার সংশয় নেই। আপনি আমাদের কৃতজ্ঞচিত্তের অভিবাদন গ্রহণ করুন।
একান্তমনে এই কামনা করি ভগবানের প্রসাদে দীর্ঘজীবী হয়ে আমাদের পীড়িত দেশকে আরোগ্যের পথে নিয়ে যান।
১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪
ছাত্র মুলু
দুর্গম স্থানে যাইবার, অজানা লক্ষ্য সন্ধান করিবার প্রতি মানুষের একটি স্বাভাবিক উৎসাহ আছে, বিশেষত যাদের বয়স অল্প। এই যাত্রাকালে নিজের শক্তি প্রয়োগ করিয়া পদে পদে বাধা অতিক্রম করাই আমাদের প্রধান আনন্দ। কেননা, এইরকম নিজের শক্তির পরিচয়েই মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রবলতা।
এই কারণে আমার মত এই যে, শিক্ষার প্রথম ভূমিকা সমাধা হইবার পরেই ছাত্রদিগকে এমন পাঠ দিতে হইবে যাহা তাহাদের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন। অথচ শিক্ষক এই কঠিন পাঠ তাহাদিগকে এমন কৌশলে পার করাইয়া দিবেন যে, ইহা তাহাদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসাধ্য না হয়। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রণালী এমন হওয়া উচিত, যাহাতে ছাত্রেরা পদে পদে দুরূহতা অনুভব করে, অথচ তাহা অতিক্রমও করিতে পারে। ইহাতে তাহাদের মনোযোগ সর্বদাই খাটিতে থাকে এবং সিদ্ধিলাভের আনন্দে তাহা ক্লান্ত হইতে পায় না।
এখানকার বিদ্যালয়ে আমি যখন ইংরেজি শিখাইবার ভার লইলাম, তখন এই মত-অনুসারে আমি কাজ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। পঞ্চম, চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর ইংরেজি শিক্ষার দায়িত্ব আমার হাতে আসিল। তৃতীয় শ্রেণীতে আমি যে-সকল ইংরেজি রচনা পড়াইতে শুরু করিলাম, তাহা সাধারণত কলেজে পড়ানো হইয়া থাকে। অনেকেই আমাকে ভয় দেখাইয়াছিলেন যে, এরূপ প্রণালীতে শিক্ষা অগ্রসর হইবে না।
মুলু আমার এই ক্লাসের ছাত্র ছিল। পড়াতে সে কাঁচা এবং পড়ায় তাহার মন নাই বলিয়া তাহার সম্বন্ধে অভিযোগ ছিল। শিশুকাল হইতেই তাহার শরীর সুস্থ ছিল না বলিয়া প্রণালীবদ্ধভাবে পড়াশুনা করার অভ্যাস তাহার ঘটে নাই। এইজন্য নিয়মিত ক্লাসের পড়ায় মন দেওয়া তাহার পক্ষে বিতৃষ্ণাকর এবং ক্লান্তিজনক ছিল।
বাল্যকালে ক্লাসের পড়ায় আমার অরুচি নিরতিশয় প্রবল ছিল, এ কথা আমি অনেকবার কবুল করিয়াছি। এইজন্য প্রাচীন বয়সে শিক্ষকের পদ গ্রহণ করিয়াও পাঠে কোনো ছাত্রের অমনোযোগ বা অরুচি লইয়া ক্রোধ বা অধৈর্য আমাকে শোভা পায় না। পাঠে যাহাতে ছেলেদের মন লাগে এ কথা আমি বিশেষভাবে চিন্তা না করিয়া থাকিতে পারি না; অর্থাৎ পাঠে অনবধান বা শৈথিল্যের জন্য সকল দোষ ছেলেদের ঘাড়ে চাপাইয়া ভর্ৎসনা এবং শাস্তির জোরে মাস্টারির কাজ চালানো আমার পক্ষে অসম্ভব।