শতাব্দীর অধিক কাল হল আমরা শক্তিশালী পাশ্চাত্য জাতির শাসনশৃঙ্খলে বাঁধা আছি। কিন্তু যন্ত্রশক্তির এই চরম বিকাশের দিনেও এই বিংশ শতাব্দীতে আমরা উপবাসী, আমরা রোগজীর্ণ, দারিদ্র্যে আমরা সর্বতোভাবে পঙ্গু। যে-বিদ্যা অপমান ও দুর্গতি থেকে মানুষকে রক্ষা করে তার আমরা স্পর্শ পাই নি বললেই হয়। এই শিক্ষা জাপানের হয়েছে, আমাদের হয় নি যদিও বুদ্ধিতে আমরা জাপানির চেয়ে কম নই। চোখের সামনেই দেখছি, জাপান এমন প্রবল হয়ে উঠল যে, এই ক্ষুদ্র দ্বীপবাসীর য়ুরোপের গর্বান্ধ জাতিদের অহংকার পদে পদে খর্ব হচ্ছে। পাশ্চাত্যের বিদ্যা আয়ত্ত করে শতাব্দীর অনতিকালের মধ্যে জাপান যখন এই গৌরব লাভ করলে, তখন আমাদের মনের দ্বারে একটা প্রবল আঘাত লাগল, জাগরণের জন্যে আহ্বান এল আমাদের অন্তরে। এশিয়ার পাশ্চাত্যতম ভূখণ্ডে দেখলুম তুর্কি– যাকে য়ুরোপে Sick-man of Europeবলে অবজ্ঞা করত, সে কী রকম প্রবল শক্তিতে অসম্মানের বাঁধন ছিন্ন করে ফেলল। য়ুরোপের প্রতিকূল মনোবৃত্তির সামনে সে আপনার জয়ধ্বজা তুলে ধরলে। এশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন দেশে এই আত্মগৌরব লাভের দৃষ্টান্ত দেখে আমাদের দুর্গতিগ্রস্ত ইতিহাসের আওতার আবছায়ার ভিতরে একটা আশ্বাসের আলো প্রবেশ করল। মনে হচ্ছে অসাধ্যও সাধ্য হয়। স্বাধীনতার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত নয়– যা চাই, তা পাব। মূল্য দিতে হবে, সে মূল্য দেবার লোক উঠবে।
এই যে এশিয়ার আকাশের উপরে তুর্কির বিজয়পতাকা উড়ছে, সেই পতাকাকে যিনি সকলরকম ঝড়ঝাপটের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছেন– সেই দূরদর্শী, বীর, সেই রাষ্ট্রনেতার পরলোকগত আত্মাকে প্রগতিকাঙক্ষী আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি যে কেবল তুর্কিকে শক্তি দিয়েছেন তা তো নয়, সেই শক্তিরথের চক্রঘর্ঘর ভারতবর্ষের ভূমিকেও কাঁপিয়ে তুলছে। একটা বাণী এসেছে তাঁর কাছ থেকে, তিনি বুঝিয়েছেন যে, সংকল্পের দৃঢ়তার কাছে, বিরাট অধ্যবসায় ও অক্ষুণ্ন আশার কাছে, দুরূহতম বাধাও চিরস্থায়ী হতে পারে না। এই কামালপাশা একদিন নির্ভয়ে দুর্গমপথে যাত্রা করেছিলেন। সেদিন তাঁর সামনে পরাভবের সমূহ সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সংকল্পকে তিনি কখনো বিচলিত হতে দেন নি। য়ুরোপের উদ্যত নখদন্তভীষণ সিংহকে তার গুহার মুখেই তিনি ঠেকিয়েছেন। এশিয়াকে এই হল তাঁর দান– এই উৎসাহ।
তাঁর জীবনী সম্বন্ধে সব-কিছু জানা নেই, বলবার সময়ও নেই। কেবল এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, তুর্কিকে তিনি যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছেন, সেইটেই সব চেয়ে বড়ো কথা নয়, তিনি তুর্কিকে তার আত্মনিহিত বিপন্নতা থেকে মুক্ত করেছেন। মুসলমান ধর্মের প্রচণ্ড আবেগের আবর্তমধ্যে দাঁড়িয়ে, ধর্মের অন্ধতাকে প্রবলভাবে তিনি অস্বীকার করেছেন। যে-অন্ধতা ধর্মেরই সব চেয়ে| বড়ো শত্রু, তাকে পরাভূত করে তিনি কী করে অক্ষত ছিলেন, আমরা আশ্চর্য হয়ে তাই ভাবি। তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, সে বীরত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্লভ। বুদ্ধির গৌরবে অন্ধতাকে দমন করা তাঁর সব চাইতে বড়ো মহত্ত্ব, বড়ো দৃষ্টান্ত।
আমরা অন্য সম্প্রদায়ের কথা বলতে চাই নে, বলা নিরাপদ নয়। নিজেদের দিকে যখন তাকাই তখন মন নৈরাশ্যে অভিভূত হয়। ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে যা বলবার তা বলেছেন স্বয়ং মুসলমানবীর কামালপাশা, বলেছেন পারস্যের রেজা শা পহ্লবী।
তুর্কিকে স্বাধীন করেছেন বলে নয়, মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র দিয়েছেন বলেই কামালের অভাবে আজ সমগ্র এশিয়ার শোক। যে-হতভাগ্য জাতি তাঁর মন্ত্র গ্রহণ করে নি, তার অবস্থা শোচনীয়। তিনি তুর্কিকে যে প্রাণশক্তি দিয়ে গেছেন, তার অবসান হয়তো হবে না কিন্তু আমরা– হতভাগ্যের দল– এই এশিয়ায় কার দিকে তাকাব। জাপানের দিকে মুখ তোলবার দিন আর আমাদের নেই। এখন এইমাত্র প্রত্যাশায় আমরা সান্ত্বনা পাই যে, প্রাণে আঘাত পেয়েই চীনের প্রাণশক্তি দ্বিগুণ বলিষ্ঠ হয়ে জাপানকে পরাস্ত করবে। যদি সে পরাজিত হয় তবু সে পরাভূত হবে না। এত বড়ো জাত যদি জাগতে পারে, তবে সেই জাগরণের শক্তি ভারতকে প্রভাবান্বিত করবে। তাতে পরোক্ষভাবে ভারতেরই লাভ।
তোমরা প্রগতিপথের তরুণ যাত্রী আজ তোমাদের সম্মেলনের দিনে, সমস্ত এশিয়ার সম্মুখে যিনি প্রগতির পথ উদ্ঘাটিত করেছেন, যাঁর জয়গৌরবের ইতিহাসে সমস্ত এশিয়া মহাদেশের বিজয় সূচনা করছে সেই মহাবীর কামালের উদ্দেশে ভারতের নবযুগের অভিবাদন আমরা প্রেরণ করি।
আনন্দবাজার পত্রিকা,৯ পৌষ, ১৩৪৫
কৃষ্ণবিহারী সেন
গত জ্যৈষ্ঠ মাসে আমাদের সোদরপ্রতিম পরমাত্মীয় বন্ধু কৃষ্ণবিহারী সেনের পরলোকপ্রাপ্তি হইয়াছে। তাঁহার বান্ধবেরা সকলেই অবগত আছেন অবিচলিত ধৈর্যে এবং অগাধ পাণ্ডিত্যে তিনি যেমন প্রবীণ ছিলেন তাঁহার হৃদয়টি তেমনি বালকের মতো স্বচ্ছ সরল এবং সদাপ্রফুল্ল ছিল; সংসারের রোগ শোক দুশ্চিন্তা কিছুতেই তাঁহাকে পরাস্ত করিতে পারে নাই। তাঁহার ন্যায় বহু অধ্যয়নশীল উদারবুদ্ধি সহৃদয় ব্যক্তি বঙ্গদেশে অতি বিরল। এই বন্ধুবৎসল স্বদেশহিতৈষী ঈশ্বরপ্রেমিক মহাত্মা মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে বঙ্গসাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, “সাধনা’র পাঠকগণ তাহার পরিচয় পাইয়াছেন। এই মনস্বী পুরুষের সহায়তায় বঙ্গভাষা বিশেষ আশান্বিত হইয়া উঠিয়াছিল; সে আশা পূর্ণ না করিয়াই তিনি অন্তর্হিত হইয়াছেন। নিম্নলিখিত কবিতাটি আমরা শোকাতুর ভক্তবন্ধুদত্ত পুষ্পাঞ্জলি স্বরূপে সেই মৃত মহাত্মার স্মরণার্থে উৎসর্গ করিলাম।–