আনন্দবাজার, ২৬ ফাল্গুন, ১৩৪২
কামাল আতাতুর্ক
এশিয়াতে একসময় এক যুগ এসেছিল, যাকে সত্যযুগ বলা যেতে পারে, তখন এখান থেকে সভ্যতার মূল উৎসগুলি উৎসারিত হয়েছিল, নানাদিকে নানাদেশে। প্রাচীন এশিয়ার যে আলোকের উৎস যে সভ্যতার দীপালী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার নানা আলোক জ্বালিয়েছিল চীন, ভারত, আরব, পারস্য, তাদের ধর্মে, কর্মে আচরণে ও জ্ঞানে। সেই আলোক থেকে শিখা গ্রহণ করে সভ্যতার প্রকাশ হয় পাশ্চাত্যদেশে বিশেষ করে ধর্মের ব্যাপারে। একসময়ে এশিয়াতে যে-শিখা প্রজ্বলিত ছিল, তার নির্বাপণের দিন এল, ক্রমে ঘনীভূত হয়ে এল প্রদোষের অন্ধকার। তখন ভিতরের লজ্জা গোপন আর অন্তরের গৌরব রক্ষার জন্য আমরা বার বার নাম জপ করছিলুম ভীষ্ম, দ্রোণ, ভীমার্জুনের, আর তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলুম, বীর হামির, রানা প্রতাপ, এমন-কি বাংলা দেশের প্রতাপাদিত্য পর্যন্ত। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে বুঝতে পারি যে, অতীতের গৌরব ও বর্তমানের তুচ্ছতা নিয়ে আমাদের মনের ভিতর প্রবল বেদনা নিহিত ছিল। এই অতীতের দোহাই দেওয়া নিষ্ফলতা আঁকড়ে থাকতে গিয়ে আমরা পদে পদে অপমানিত হয়েছি। এই সভ্যতার মূলে যে স্বাতন্ত্র্য ছিল এবং যে সংস্কৃতি গ্রামে গ্রামে প্রচারিত ও পরিব্যাপ্ত হয়েছিল, সে সমস্তকে পশ্চিমের বন্যা এসে ডুবিয়ে একাকার করে দিয়েছে।
ক্রমে বিদেশী ইস্কুলমাস্টারের হাতে আমাদের শিক্ষা যতই পাকা হয়েছে ততই ধারণা হতে লাগল যে, অক্ষমতা আমাদের মজ্জাগত, অজ্ঞতা অন্তর্নিহিত, অন্ধসংস্কার ও মূঢ়তার বোঝা বয়ে পাশ্চাত্যের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে থাকবে চিরদিন। তখন আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিলাম যে, বিদেশী শাসনকর্তাদের দ্বারা চালিত হওয়ার বাইরে আমাদের চলৎশক্তি নেই। এদের অনুগ্রহ গণ্ডূষের জন্যে যুগান্তকাল পর্যন্ত অঞ্জলি পেতে থাকাই আমাদের ভাগ্যে নির্দিষ্ট। আপন অধিকারে আপন শক্তিতে জিতে নিতে হবে এমন দুঃসাহসকে তখনকার কংগ্রেসী বীরেরাও মনে স্থান দেন নি। তাঁরা আবেদনের ঝুলি নিয়ে রাজকর্মচারীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন; মুষ্টিভিক্ষার সকরুণ আবদার নিয়ে বার বার দ্বাররক্ষীদের হাতে তাঁদের লাঞ্ছনাও ঘটল। তখন আমরা ভেবেছিলুম যে, স্বল্পতমে সন্তুষ্ট থাকাটাই যেন আমাদের সুদীর্ঘতমকালের একমাত্র গতি। ওরা কেড়ে নেবে আর আমরা বিনা নালিশেই দেব, আর সেই দানেরই সামান্য কিছু উচ্ছিষ্ট থেকে পেট ভরাবার প্রত্যাশার চেয়ে উপরে উঠতে মন সে দিন সাহস পায় নি। নতমস্তকে মেনে নিয়েছি, পাশ্চাত্য চড়ে আছে দুর্গম উচ্চে আর প্রাচ্য গড়াচ্ছে সর্বজনের পদদলিত ধূলিশয্যায়। থেকে থেকে শঙ্খ ঘণ্টা বাড়িয়ে শিবনেত্র হয়ে বলেছি আমরা আধ্যাত্মিক, আর যারা আমাদের কান মলে তারা বস্তুতান্ত্রিক। হই-না-কেন রোগে জীর্ণ, উপবাসে ক্ষীণ, অশিক্ষায় নিমগ্ন, ছোটো বড়ো সকল প্রকার দুর্গ্রহের কাছে নিঃসহায়, তবু ওদের মতো ম্লেচ্ছ নই। আমরা ফোঁটা কাটি, মালা জপি, স্নানের যোগ এলে চারদিক থেকে হাজার হাজার লোকের আঁধি লেগে যায় স্বর্গলাভের লোভে, আর ওদের যত লোভ আর যত লাভ সবই এই মর্ত্যলোকের সীমানায়– ধিক্। পিঠে মার এসে পড়ে বাস্তবের দেশে আর চুন হলুদ লাগাতে যাই অবাস্তব লোকে।
এমন সময় একটা যুগান্ত দেখা দিল বিনা ভূমিকায়। এশিয়ার পূর্ব প্রান্তে মধ্য প্রভাতের অভ্যুদয় হল। অনেকদিন অন্ধকারে থেকে আমরা কখনো ভাবতেই পারি নি যে, দিনরথের আবর্তন কোনোদিন আবার প্রাচ্যদিগন্তে পৌঁছতে পারে। আমরা একদিন অবাক বিস্ময়ে দেখলাম যে, দূরতম প্রাচ্যে ক্ষুদ্রতম জাপান তার প্রবল প্রতিপক্ষকে সহজেই পরাস্ত করে সভ্য সমাজের উচ্চ আসনে চড়ে বসল; প্রচণ্ড পাশ্চাত্য সভ্যতার ভাণ্ডারে যে শক্তি ও যে বিদ্যা পুঞ্জিত ছিল জাপান তা অধিকার করল অতি অল্প সময়ের মধ্যে। দীর্ঘ ইতিহাসের বন্ধুর পন্থায় ক্রমশ পুষ্ট, ক্রমশ ব্যাপ্ত, বহু চেষ্টায় নানা সংগ্রামে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমের অমোঘ বিজয় বীর্যকে আপন স্বাধীনতার সিংহদ্বার দিয়ে অর্ধশতাব্দীর মধ্যে আবাহন করে আনলে। এ যে এত সহজে লভ্য এ কথা আমরা ভাবতে পারি নি। সবিস্ময়ে আশ্বস্ত হয়ে বুঝতে পারলেম, ব্যাপারটা দুরূহ নয়। যে যন্ত্রবিদ্যার জোরে মানুষ আত্মপোষণ ও আত্মরক্ষা করতে পারে সম্পূর্ণভাবে, সেটা আয়ত্ত করতে দীর্ঘকালের তপস্যা লাগে না। এমন-কি Conscription-এর সাহায্যে কুচকাওয়াজ করিয়ে বছর কয়েকের মধ্যে ভারতীয় জনসাধারণকে সৈনিক ব্যবসায়ে অভ্যস্ত করা নিশ্চয়ই সম্ভবপর। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে যাকে বলে শ্রেয়, তার পথ অন্তরের পথ, সেটা সহজ নয়। তার জন্যে প্রস্তুত হতে সময় লাগে, লড়াই করতে হয় নিজেরই সঙ্গে। মহাত্মাজির নির্দেশ হল শ্রেয়োনীতির জোরেই স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, বাহুবলের জোরে নয়। তাঁর কথা যারা মেনে নিয়েছে তারা আত্মার শক্তি কামনা করছে। এই পথের সাধনা বিলম্বে সিদ্ধ হয়।
এই অন্তরের রাস্তা ছাড়া একটা বাহিরের রাস্তাও আছে, স্বতন্ত্রতার লক্ষ্য। সেটা অন্নের পথ, আরোগ্যের পথ, দৈন্যলাঘবের পথ। বিজ্ঞানের সাধনা এই পথে, সে জয়ী করে জীবনসংগ্রামে। সে পথে মানুষের শয়তানির বাধা নেই। এমন-কি সে দলে টেনে নেয় বিজ্ঞানকে, কিন্তু সেজন্যে বিজ্ঞানকে দোষ দেওয়া অন্যায়, কেননা বিজ্ঞানের স্বাভাবিক সম্বন্ধ বুদ্ধির সঙ্গে, শ্রেয়োনীতির সঙ্গে নয়। এখানে দোষ দিতে হয় সেই-সকল ধর্মমতকে যে-সকল মত মানুষকে অপমানিত করে, পীড়িত করে, তার বুদ্ধিকে অন্ধ করে, পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে, তার বিচারবর্জিত আচারকে চলার পথে বোঝা করে তোলে।